প্রথম পাতা

অনলাইনে ডলার বিক্রির নামে প্রতারণা

জিয়া চৌধুরী

২৭ মার্চ ২০১৯, বুধবার, ৯:৩৯ পূর্বাহ্ন

তথ্যপ্রযুক্তি আধুনিক জীবনকে যতটা সহজ করেছে, ঠিক তার বিপরীতে ডিজিটাল দুনিয়া হয়ে উঠছে নানা অপরাধের ভাণ্ডারও। কেনাকাটা করতে গেলে এখন আর যেমন বাজারে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না, খুব সহজেই অনলাইনে পাওয়া যায় পছন্দের পণ্য। তেমনি কেনাকাটার বিপরীতে ডেবিট, ক্রেডিট কার্ড কিংবা বিকাশে নিমিষেই পণ্য বা সেবার মূল্য পরিশোধ করা যায়। তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে কাজ করেন অথবা আউটসোর্সিং করেন এমন ব্যক্তিদের নিয়মিত ডলার কেনার প্রয়োজন হয়। তবে সেটি কাগুজে নোটের ডলার নয়, অনলাইনের ডিজিটাল ডলারে। যার মাধ্যমে লেনদেন সেরে নেন। অনলাইন মার্কেটপ্লেসে অ্যাকাউন্ট খোলা, ফেসবুক পেজ বুস্ট করা, সফটওয়্যার নবায়ন বা হালনাগাদের মতো নানা কাজে আন্তর্জাতিকভাবে পরিশোধের সহজ মাধ্যম মার্কিন ইউএস ডলার। এজন্য তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা মানুষজন অনলাইনে ডলার কিনে তা আবার ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় পরিশোধ করে দেন। আবার, বেটিং সাইটগুলোর জুয়াড়িদের জন্যও প্রয়োজন হয় এসব ডিজিটাল ডলার, যেটি মূলত অনলাইন কয়েন হিসেবেও পরিচিত। তবে, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কর্মরতদের ডলার চাহিদাকে পুঁজি করে বেশ কয়েকটি চক্র তরুণ প্রযুক্তিকর্মীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা।

পরিশ্রম করে আয় করা অর্থ খোয়া যাচ্ছে চোখের সামনেই। তবে, ভুয়া ফেসবুক আইডি ও জালিয়াতির মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিলেও এসব প্রতারকরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সেল বাই ডলার, সলিট লেনদেন, ট্রাস্টেড ডলার বাই অ্যান্ড সেল ও নেটেলার বাংলাদেশসহ নানা নামের প্রায় অর্ধশতাধিক ফেসবুক গ্রুপ হয়ে উঠেছে তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীদের ডলার কেনার নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। তবে, এসব গ্রুপে ঘাপটি মেরে বসে থাকেন প্রতারকরা। এসব প্রতারকদের একেক জন অন্তত ১০/১৫টি ভুয়া ফেসবুক আইডি খোলেন। এরপর বিক্রেতা সেজে গ্রুপে নিয়মিত পোস্ট দিতে থাকেন। কেউ ডলার কিনতে চাইলে তার সঙ্গে আলাপনের পর বিকাশে টাকা নিয়ে নেন। এরপর গায়েব হয়ে যায় ডলার বিক্রেতার নামে থাকা প্রতারক। নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় তার ভুয়া ফেসবুক আইডিও।

এভাবে একের পর এক ভুয়া ফেসবুক আইডি দিয়ে ডলার বিক্রির নামে প্রতারণা চলতে থাকে। অনলাইনে ডলার কিনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন এমন কয়েকজন জানিয়েছেন তারা পুলিশে অভিযোগ করেও তেমন কোনো প্রতিকার পাননি। মাহমুদুল ইসলাম নামে একজন মানজমিনকে জানান, মাস তিনেক আগে তিনি অনলাইনে ডলার কিনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হন। তিনি বলেন, ডলার কেনাবেচার একটি গ্রুপে মাসুদ নামে একজনের সঙ্গে ডলার কেনার বন্দোবস্ত করেন। মাসুদ নারায়ণগঞ্জে থাকায় একদিন পরে তাদের ধানমণ্ডিতে দেখা করার কথা। পরদিন অবশ্য মাসুদ না এসে তিনি তার এক প্রতিনিধিকে পাঠান। ওই ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে বিকাশে টাকা লেনদেন করেন মাহমুদুল। এর কিছুক্ষণ পর অপেক্ষা করেও তিনি তার কাঙ্ক্ষিত ডলার পাননি। পরে জানতে পারেন যে ব্যক্তি তার কাছ থেকে বিকাশে টাকা নেন সে আসলে মূল প্রতারক চক্রের সঙ্গে জড়িত নন। তবে প্রতারক মাসুদ বিক্রয়ডটকম থেকে একটি মুঠোফোন কিনে তার টাকা পরিশোধ করতে বেছে নেন ডলার বিক্রির ফন্দি। মুঠোফোনের বিক্রেতাকে পাঠান ডলার ক্রেতা মাহমুদুলের কাছে।

আর ডলার না পেয়ে প্রতারণার শিকার হন মাহমুদুল ইসলাম। পরে মাহমুদুল ইসলাম মোহাম্মদপুর থানায় একটি অভিযোগ করলেও ভুয়া ফেসবুক আইডি ব্যবহারের কারণে প্রতারক মাসুদকে আটক করা যায়নি। তবে মাহমুদুল ইসলাম ছাড়াও রিয়াদ খান, প্রীতম বসাক ও সাব্বির আহমেদসহ অন্তত দশজন অনলাইনে ডলার কিনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন বলে জানান। এদের প্রত্যেকে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার ডলার কিনতে গিয়ে প্রতারিত হন বলে জানান। এছাড়া, ডলার অ্যাকাউন্টে পাঠানোর পর আবার উইথড্র করে নেয়া, অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়েছে বলে টাকা না দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে অহরহ। এদিকে, ডলার কেনাবেচার এসব ফেসবুক গ্রুপগুলোতে গিয়ে যে কারো চোখ কপালে ওঠার উপক্রম হবে। মাত্র ৫০ ডলারের বিনিময়ে এসব গ্রুপে পাওয়া যাচ্ছে জাতীয় পরিচয়পত্র ও স্মার্টকার্ড। এক থেকে দুইশো টাকায় মিলছে ট্যাক্স আইডেনন্টিফিকেশন নম্বর বা টিন। এছাড়া, আউটসোর্সিং দুনিয়ায় তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীদের যত ধরনের ডকুমেন্ট প্রয়োজন হয় নিমিষেই তা বানানো হয়। বিক্রি হয় টাকার বিনিময়ে।

তবে, জাতীয় পরিচয়পত্র থেকে শুরু করে টিন নম্বর কিংবা ব্যাংক স্টেটমেন্ট, বিদ্যুৎ বিলের কাগজ কিংবা অন্য কোন সনদ এসবই নকল বা জাল। মূলত পেমেন্ট গেটওয়ে অ্যাকাউন্টধারীদের একেক জনের নামে বেশ কয়েকটি আইডি থাকে। অধিক আয়ের জন্য তারা একাধিক ওয়েবসাইটে নিজের নামে আইডি খোলেন। পেইজা, পাইওনিয়ার, আপওয়ার্ক, স্ক্রিল, পেপ্যাল ও নেটেলারের মতো কাজের ক্ষেত্রগুলোতে এসব ডকুমেন্ট দেখানোর প্রয়োজন পড়ে। সেক্ষেত্রে অনেক প্রযুক্তিকর্মী ভুয়া বানানো এসব স্মার্টকার্ড ও ডকুমেন্ট দিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলেন, নিজেদের কাজ চালান। তবে, এসব ভুয়া কাগজপত্র ব্যবহার করে ভার্চুয়াল দুনিয়ার বাইরেও নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ার সুযোগ আছে বলে মনে করেন তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী মেহরাব হোসেন রবিন। তিনি বলেন, সেলফি এনআইডিসহ নানা ডকুমেন্ট ভার্চুয়াল জগতের জন্য ব্যবহার করেন আউটসোর্সাররা। তবে, গ্রাফিক্সে অভিনব পদ্ধতিতে বানানো এসব এনআইডি ও টিন নম্বর কার্ড দিয়ে প্রযুক্তি দুনিয়ার বাইরের মানুষ প্রতারিত হতে পারেন। সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এদিকে নজর দেয়ার জোর তাগিদ দেন তিনি।

তবে ডলার কেনার ক্ষেত্রে আরো সচেতন হওয়ার পরামর্শ তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী ও আরআরএফ ইনস্টিটিউটের পরিচালক নাজিব রাফে ডিউক। তিনি বলেন, প্রতারকরা সবখানে ঘাপটি মেরে আছে। তবে আমাদের উচিত হবে সচেতন হয়ে কাজ করা। তাহলে প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে না। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাইবার সিকিউরিটি ও ক্রাইম ডিভিশনের উপ-পুলিশ কমিশনার আ ফ ম আল কিবরিয়া জানান, অনলাইনে ডলার বিনিময়কে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো বৈধতা দেয়নি। তবে, ভুক্তভোগী কেউ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করলে আমরা ব্যবস্থা নেবো। ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র ও টিন নম্বরের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান এর আগেও বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে ভুয়া এনআইডিসহ কয়েকটি চক্রকে আটক করা হয়েছে। গণমাধ্যমসহ কারো কাছে সুর্নির্দিষ্ট থাকলে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status