শেষের পাতা

প্লেসমেন্ট শেয়ার নিয়ে পুঁজিবাজারে অস্থিরতা

এমএম মাসুদ

২০ মার্চ ২০১৯, বুধবার, ৯:৩৬ পূর্বাহ্ন

গত কয়েক দিন ধরে পুঁজিবাজারে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে প্রাইভেট প্লেসমেন্ট শেয়ারের বাণিজ্য। এই পদ্ধতিতে ব্যাপক অনিয়মের মাধ্যমে শেয়ার বেচাকেনা হচ্ছে বলে অভিযোগ বাজার সংশ্লিষ্টদের। পুঁজিবাজারে চলমান মন্দার প্রধান কারণ হিসেবে বেপরোয়া প্লেসমেন্ট বিক্রিকেও দায়ী করেছেন তারা। ওদিকে চলমান প্লেসমেন্টের ভয়াবহতা নিয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকেও সমালোচনা হয়েছে। একই সঙ্গে বৈঠকে প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে ইস্যু করা শেয়ারের ওপর তিন বছরের লক-ইন বা বিক্রয় নিষেধাজ্ঞার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কাছে একটি প্রস্তাব পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। উল্লেখ্য, একটি কোম্পানি প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও), রাইট শেয়ার ছেড়ে বা প্রাইভেট প্লেসমেন্টে শেয়ার ইস্যু করার মাধ্যমে বাজার থেকে কোম্পানির মূলধন উত্তোলন করতে পারে। কোনো কোম্পানি আইপিওতে আসার আগে ইস্যু ব্যবস্থাপক বা পরিচালকদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে পছন্দসই লোকদের কাছে কিছু শেয়ার বিক্রি করে, এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় প্রাইভেট প্লেসমেন্ট বা প্রি-আইপিও প্লেসমেন্ট শেয়ার। বর্তমানে প্লেসমেন্ট শেয়ারের ওপর এক বছরের লক-ইন আছে।

জানা গেছে, ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে ধসের কারণ অনুসন্ধানে ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বাধীন তদন্ত প্রতিবেদনেও অনিয়ন্ত্রিত প্লেসমেন্ট বাণিজ্যকে অন্যতম কারণ বলেও বলা হয়।

বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, বর্তমানে অনেক অযোগ্য কোম্পানি প্লেসমেন্টে শেয়ার বিক্রি করছে। এছাড়া প্রিমিয়ামে প্লেসমেন্ট বিক্রি করে অনেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন ছাড়াও প্লেসমেন্ট বিক্রির মতো ঘটনা ঘটছে। আর এই অনৈতিক বাণিজ্য চালিয়ে যেতে একটি চক্র বিভিন্নভাবে বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করার চেষ্টা করছে।

সূত্র জানায়, প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে ইস্যু করা শেয়ারের ওপর ৩ বছরের লক-ইন বা বিক্রয় নিষেধাজ্ঞা চায় ডিএসই। কোনো কোম্পানি প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে বাজারে আসার আগে প্লেসমেন্টে শেয়ার ইস্যু করে থাকলে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে। এ লক-ইন আরোপ হলে শুধু বিক্রি নয়, ওই শেয়ার ব্যাংকে জামানত রাখা এবং হস্তান্তরও আইপিও পরবর্তী তিন বছর পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। বিএসইসির কাছে একটি প্রস্তাব পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডিএসই। প্রস্তাবে ডিএসই প্লেসমেন্ট শেয়ারের পাশাপাশি প্লেসমেন্ট শেয়ারের বিপরীতে প্রাপ্ত বোনাস শেয়ারের ওপরও তিন বছরের লক-ইন আরোপের অনুরোধ জানাবে।

ডিএসইর এক পরিচালক বলেন, প্লেসমেন্টের নামে এক ধরনের অরাজকতা শুরু হয়েছে। কিছু অসাধু উদ্যোক্তা ব্যবসা সম্প্রসারণের প্রয়োজনে নয়, রাতারাতি বড় লোক হওয়ার অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে প্লেসমেন্টে শেয়ার বিক্রি করছে। এসব কোম্পানি পুঁজিবাজারে আইপিওর মাধ্যমে যে পরিমাণ শেয়ার বিক্রি করছে, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি শেয়ার বিক্রি করছে প্লেসমেন্টের মাধ্যমে। তাদের শেয়ারবাজারে আসার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, প্লেসমেন্টের মাধ্যমে বরাদ্দ শেয়ার বিক্রির সুযোগ করে দেয়া। এসব শেয়ার কয়েকগুণ দামে বিক্রি করে তারা কোম্পানির মূল বিনিয়োগ তুলে নেয়াসহ বিপুল অর্থ হাতি?েয় নি?চ্েছ। আর দুর্বল মৌলের এসব কোম্পানির শেয়ার শেষ পর্যন্ত সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাঁধে চাপছে। লক-ইনের মেয়াদ বাড়ানো হলে এই ধরনের অপতৎপরতা কিছুটা কমে আসবে।

ডিএইর এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, একটি কোম্পানি প্রতিটি ২০ টাকা করে ১০০ কোটি টাকার প্লেসমেন্টে শেয়ার বিক্রি করছে। ইতিমধ্যে এই গ্রুপটির আরেকটি কোম্পানি তালিকাচ্যুত হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানটির ন্যায় আরো অনেকে কোম্পানির নামে কিছু ব্যক্তি অনৈতিকভাবে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।

এদিকে প্লেসমেন্ট নিয়ে আলোচনাকে পূর্ণতা দিয়েছে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়শন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি শাকিল রিজভীর এক ফেসবুক স্ট্যাটাস। গত সপ্তাহে তিনি এক স্ট্যাটাসে বলেন, প্লেসমেন্টের জন্য প্রতিনিয়ত বাজার থেকে টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। একদিকে প্লেসমেন্টধারীরা কোম্পানি তালিকাভুক্ত হওয়ার পর ২-৩ গুণ লাভে শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলে নিচ্ছে। অন্যদিকে তাদের এই লাভ দেখে অন্য অনেক বিনিয়োগকারী সেকেন্ডারি বাজার থেকে টাকা তুলে নিয়ে প্লেসমেন্ট শেয়ার কিনছে। তিনি বলেন, চলমান প্লেসমেন্টে একটি চক্র কৌশলে প্রতিটি শেয়ারে ৫-১০ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। তারা ১০ টাকার শেয়ার ১৫-২০ টাকায় বিক্রি করছে। কিন্তু তার কোনো রেকর্ড নেই। আর এই রেকর্ডহীন প্রিমিয়ামের অর্থ কোম্পানিতে ঢুকছে না। এই ব্যবসার মাধ্যমে বিপুল টাকা নিয়ে কেটে পড়ছে চক্রটি।

শাকিল রিজভী বলেন, আইপিও পূর্ব প্রাইভেট প্লেসমেন্ট একটি স্বাভাবিক পক্রিয়া। যা বন্ধের পক্ষে আমরা নই। অনেক সময় ব্যবসা সমপ্রসারণের জন্য জরুরি প্রয়োজনে উদ্যোক্তারা প্লেসমেন্টে শেয়ার ইস্যু করে মূলধন সংগ্রহ করতেই পারেন। কারণ আইপিওতে মূলধন সংগ্রহের প্রক্রিয়া বেশ দীর্ঘ। কিন্তু বর্তমানে যেভাবে প্লেসমেন্ট হচ্ছে, তা ব্যবসা সমপ্রসারণে নয় বরং অসাধু উদ্দেশ্যেই হচ্ছে।
ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, শেয়ারবাজারে এখন প্রধান সমস্যা হচ্ছে অনৈতিকভাবে প্লেসমেন্ট বেচাকেনা। এখন যেভাবে প্লেসমেন্ট হচ্ছে, তাতে শেয়ারবাজার ধসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাই প্লেসমেন্ট শেয়ারে তিন বছর লক ইন করা উচিত বলে মনে করেন তিনি। যে বিষয়ে ডিএসইর পর্ষদ সভায় এরইমধ্যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আগামীতে প্রত্যেকটি কোম্পানির আইপিও অনুমোদনে শর্ত হিসাবে প্লেসমেন্ট শেয়ারে তিন বছর লক ইনের জন্য বিএসইসিতে সুপারিশ করা হবে। এছাড়া প্লেসমেন্টের শেয়ারের ওপর ঘোষিত বোনাস শেয়ারেও তিন বছরের লক ইনের সুপারিশ করা হবে।

ডিএসইর পরিচালক হানিফ ভূঁইয়া বলেন, সেকেন্ডারি বাজারের বাহিরে প্লেসমেন্ট বাজার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। টাকা হাতিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে এই বাজারে প্রিমিয়াম নামক বাণিজ্য গড়ে তোলা হয়েছে। বর্তমানে কোম্পানির জন্য প্লেসমেন্টে শেয়ার ইস্যু নয়, প্রিমিয়ামে টাকা হাতিয়ে নেয়াই মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা প্রতিরোধ নিয়ন্ত্রক সংস্থার সক্রিয় ভূমিকা রাখা দরকার।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status