প্রথম পাতা

‘রাতভর ব্যালট বাক্স পাহারা দিয়েছি’

মরিয়ম চম্পা

১৫ মার্চ ২০১৯, শুক্রবার, ১০:১৫ পূর্বাহ্ন

শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্যানেল থেকে শামসুন নাহার হলের ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন। তার প্যানেলের সদস্য সংখ্যা মোট ৮ জন। প্রত্যেকেই জয়লাভ করেছেন। সাহসী ইমি জড়িত ছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একবার ডিবি পুলিশ ধরে নিয়ে যায় তাকে। এত কিছুর পরেও দমে থাকেন নি অদম্য ইমি। ভোটের মাঠে মেধা আর অদম্য সাহস দিয়ে কীভাবে বিজয় ছিনিয়ে আনতে হয় সেটা জানেন লড়াকু এই শিক্ষার্থী।

নির্বাচনে তার বিজয় প্রসঙ্গে মানবজমিনের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেন ইমি। বলেন, নির্বাচনে লড়াইয়ের বিষয়ে বলতে গেলে বলতে হয় আমরা যখন ৮ জন মিলে সিদ্ধান্ত নেই নির্বাচন করবো আসল লড়াইটা মূলত সেখান থেকেই শুরু হয়। বড় কিছু না হলেও ছোটখাটো অনেক প্রতিবন্ধকতা ছিল। নমিনেশন পেপার তোলার পর প্রথমদিন হলের সামনে প্রভোস্ট ম্যামের চোখের চাহনি দেখে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। এরপর হলের ক্ষমতাসীন দলের ৪ প্রার্থী আমাদের বিরুদ্ধে তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক রিপোর্ট করে বন্ধ করার অপবাদ দেয়। রুমে রুমে গিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থী ও ভোটারদের কাছে আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হয়। এটা নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে মিথ্যা নিউজ করানোসহ অনেক অপচেষ্টা করা হয়েছে আমাদের দমাতে।

ক্ষমতাসীনরা অনেক আগে থেকেই তাদের পোস্টার দিয়ে পুরো হল ছেয়ে ফেলেছিল। এসময় আমরা নিজেরা রাত জেগে হাতে লিখে পোস্টার তৈরি করে সকালে হলের সামনে ৯টি পোস্টার লাগাই। সন্ধ্যায় দেখি পোস্টার নেই। এ বিষয়ে হল প্রশাসনের কোনো সহযোগিতা পাইনি। এভাবে টুকটাক কাদা ছোড়াছুড়ি চলতে থাকে। এরপর আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। নির্বাচনের আগের দিন সন্ধ্যা থেকে সারা রাত জেগে আমাদের ভোটকেন্দ্রগুলো কড়া নজরদারিতে রাখি। যাতে করে নির্বাচনের পুরো বিষয়টা আমাদের নখদর্পণে থাকে। আমরা প্রার্থীরা পালাক্রমে পাহারা বসাই। প্রভোস্ট ম্যামের রুমে সকল ব্যালট বাক্স রাখা ছিল। যেটা আমার ২০১ নং কক্ষ থেকে দেখা যায়। রাত ২টার পর থেকে ভোর পর্যন্ত আমি রুমের বারান্দার সানসেটে বসে ছিলাম। নজর রেখেছি যাতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে। ফলে রাতের বেলা ভোট কারচুপির চেষ্টা আমাদের কারো চোখে পড়েনি।

আমাদের কাছে তথ্য ছিল যে, নির্বাচনের দিন ভোরবেলা মেয়েদের লাইনে দাঁড় করিয়ে দেয়া হবে। এবং ওই লাইনই নাকি চলতে থাকবে। এজন্য আমরা আমাদের মেয়েদেরকে আগে থেকে দাঁড় করিয়ে দেই। যাতে এই ধরনের সমস্যার মধ্যে পড়তে না হয়। আমাদের আরেকটি প্লাস পয়েন্ট ছিল সাধারণ ভোটার শিক্ষার্থীরা খুব সকাল সকাল ভোট দিতে চলে আসে। ফলে ভোটের লাইনের যে দীর্ঘসূত্রতা সেটা আমাদের ফেস করতে হয় নি। এ ছাড়া ভোট গ্রহণের সব নিয়মগুলো শুরু থেকে খুব সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এ জন্য প্রশাসনকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাতে চাই।

এ ছাড়া ভোট গ্রহণের আগে প্রত্যেকটি ব্যালট বাক্স ম্যামরা আমাদের খুলে দেখিয়েছেন। ছোট্ট একটি ব্যালট বাক্স নিয়ে আমাদের সন্দেহ ছিল সেটাও দুই ঘণ্টা পর খুলে দেখানো হয়েছে। ভোট গণনার কার্যক্রম আমাদের প্রত্যেক প্রার্থীর চোখের সামনে সম্পন্ন হয়েছে। এটিই মনে হয় আমাদের হলে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে আমি মনে করি। এক পর্যায়ে ভোট গণনার জন্য প্রভোস্ট ম্যামের অফিসে নিয়ে যেতে চাইলে আমরা বাধা দেই। এসময় সাধারণ শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়। একটি প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়েছিল। নির্বাচনে যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল তাদেরকে একদম ফলাফল ঘোষণার পরে ভোটকেন্দ্র থেকে বের হতে দেয়া হয়। সত্যি বলতে শামসুন নাহার হলের নির্বাচন একটি নজির স্থাপন করেছে।

রোকেয়া হলের শিক্ষার্থীরা এখন আন্দোলন ও অনশন করছে। তারা যদি এই কাজটি এখন না করে একদম শুরুতে করতেন তাহলে হয়তো এটা করতে হতো না। কারণ নির্বাচনে একধরনের বাধা-বিপত্তি আসবে সেটা তো সকলেই জানতাম। কাজেই তারা চাইলে পুরো বিষয়টি আরেকটু স্মার্টলি হ্যান্ডেল করতে পারতো। যেমনটা মৈত্রী হলের ছাত্রীরা করে দেখিয়েছে। এ ছাড়া আমাদের হলের প্রশাসনের যে দায়িত্বশীল আচরণ ছিল বাকি হলের প্রশাসন এমন আচরণ করতে পারতেন। তবে সব মিলিয়ে আমাদের হলের নির্বাচন ভালো হয়েছে। কিন্তু পুরো নির্বাচন নিয়ে যদি বলি এক্ষেত্রে আমি তো খুবই হতাশ। বিশেষ করে ছেলেদের হল। আমাদের হলে মোট ভোট কাস্ট হয়েছে ১৭শ’ ৬০টি। এরমধ্যে আমি পেয়েছি ১ হাজার ৭৩টি। এবং আমার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ভিপি প্রার্থী ছাত্রলীগ সমর্থিত জিয়াসমিন শান্তা পেয়েছে ৫০৬টি ভোট। পুরো নির্বাচন সম্পন্ন করতে আমাদের প্যানেলের ৮ সদস্যের খরচ হয়েছে প্রায় ১২ হাজার টাকা।

ইমি বলেন, ভবিষ্যতে কোনো রাজনীতি করার ইচ্ছা নেই। শুধুমাত্র হল জীবনে বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে মুক্তি পেতে এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের মুক্ত করতে এই নির্বাচন করা। হলে নিয়মিত পানি থাকে না। মাস্টার্স পর্যন্ত ডাবলিং করতে হয়। আমাদের মায়েদের হলে আসতে দেয়া হয় না। আসতে হলে প্রায় ১ সপ্তাহ আগে দরখাস্ত করতে হয়। আমাদের নির্বাচনী ইশতেহারে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ‘মা আসবে হলে’। এ ছাড়া আমাদের নির্বাচনের ইশতেহারের কৌশলটি ছিল একটু ব্যতিক্রমধর্মী। প্রত্যেক মেয়ের রুমে পৃথকভাবে মেয়েদেরকে সাদা কাগজ দিয়েছি। ওখানে ছিল ‘নিজেরাই করি নিজেদের ইশতেহার’। যেখানে হলের মেয়েরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের দাবি-দাওয়াগুলো লিখে জানায়। কাজেই কিছুটা হলেও যেন এই সমস্যার সমাধান করতে পারি সে লক্ষ্যে কাজ করার চেষ্টা করবো। যাতে করে জুনিয়র কেউ যেন আমার মতো ভুক্তভোগী না হয়।  

ইমির গ্রামের বাড়ি খুলনার পাইকগাছায়। বাবা শেখ গোলাম ইকবাল জামালপুর যমুনা ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরিতে চাকরি করেন। সেই সূত্রে এখানেই তার বেড়ে ওঠা। জামালপুর যমুনা সারকারখানা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও স্থানীয় কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। তিন ভাইবোনের মধ্যে ইমি সবার বড়। মা মনোয়ারা বেগম গৃহিণী।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status