বাংলারজমিন

আমন চাল সংগ্রহ অভিযান

কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সংশ্লিষ্টদের পকেটে ঢুকেছে লাভের টাকা

পঞ্চগড় প্রতিনিধি

১৩ মার্চ ২০১৯, বুধবার, ৫:৩৭ পূর্বাহ্ন

সরকারি মূল্য ৩৬ টাকা আর মিল মালিকরা পঞ্চগড় জেলার খাদ্য গুদামগুলোতে সরবরাহ করেছে ২৫ টাকা কেজি দরের চাল। এ হিসেবে এবারের আমন চাল সংগ্রহ মৌসুমে বন্ধ হাস্কিং মিল মালিক ও সংশ্লিষ্টদের পকেটে ঢুকেছে লাভের ১৩ কোটি ৭৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা। নীতিমালা ভঙ্গ করে করে যোগসাজশের মাধ্যমে সহজে সংশ্লিষ্টরা এ বিপুল টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নিলেও উৎপাদনকারী কৃষকরা হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত। বছরের পর বছর ধরে এ অবস্থা চলার কারণে কৃষকরা চাষাবাদে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। ভালো দাম পাওয়ার জন্য কৃষকরা ভুট্টাসহ রবি মৌসুমের অন্যান্য ফসল আবাদে আগ্রহী হচ্ছে। চলতি আমন মৌসুমে খাদ্য গুদামে চাল সরবরাহের জন্য জেলার ৫টি উপজেলার ৮টি অটো রাইস মিল ও ৪৩৬ জন হাস্কিং মিল মালিকের সঙ্গে চুক্তি করা হয়। সরকারি বরাদ্দ অনুযায়ী চুক্তিবদ্ধ এসব মিলারের কাছ থেকে ৩৬ টাকা কেজি হিসেবে ১৩ হাজার ৭৯৬ মেট্রিক টন চাল ক্রয় করা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়,  চুক্তিবন্ধ হাস্কিং মিলের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি মিল ছাড়া বেশিরভাগ মিলই বন্ধ। এসব মিলের মধ্যে অনেক মিলের কোন অস্তিত্বই নেই। আগের তালিকায় থাকা এসব হাস্কিং মিলকে এবারো বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এ মিল মালিকরা যে মানের চাল গুদামে সরবরাহ করেছে তা খুচরা বাজারে প্রতি কেজি চাল বিক্রয় হচ্ছে ২৭ টাকা কেজি দরে। অটো রাইস মিল থেকে এর চেয়ে আরো ২ টাকা কম দামে বাকিতে চাল নিয়ে গুদামে সরবরাহের পর তারা বিল তুলে চালের দাম পরিশোধ করেছে। এ সরবরাহকৃত চালের মূল্য ও সরকারি মূল্য অনুযায়ী তারা প্রতি টনে লাভ করেছে ১০ হাজার টাকা। বিগত কয়েক বছর ধরে অনেক হাস্কিং মিলের চুলো জ্বলেনি। চাতাল ফেটে ঘাস গজিয়েছে। নিয়ম না থাকলেও অভ্যন্তরীণ খাদ্যশস্য সংগ্রহ অভিযানে চাল সরবরাহের জন্য এসব মিল মালিককে কর্তৃপক্ষ আর্থিক সুবিধা নিয়ে বরাদ্দ দিচ্ছে। মিল-চাতাল বন্ধ থাকলেও অটো রাইস মিলের চাল কিনে তারা বরাদ্দের চাল সরকারি খাদ্য গুদামে সরবরাহ করছে। এতে করে হাস্কিং মিল মালিকদের পকেট ভারি হলেও যাদের সহযোগিতা করার জন্য সংগ্রহ অভিযান সেই কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। হাস্কিং মিলগুলো চালু থাকলে সরকারের পক্ষে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা অনেকটা সহজ হতো। এ সকল মিল পুনরায় চালু হলে স্থানীয় বাজারে চালের চাহিদা কমে গেলে অটো রাইস মিল মালিকরা সিন্ডিকেট করে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। এক সময় হাস্কিং মিল মালিকদের নিয়ন্ত্রণেই ছিল চালের বাজার। এসব মিলের মালিকরা মৌসুমসহ সারা বছর বাজার থেকে ধান ক্রয় করে নিজেদের মিল চাতালে প্রক্রিয়া শেষে উৎপাদিত চাল স্থানীয় বাজারে বিক্রয় করত। এছাড়া তাদের মিলে উৎপাদিত খুদ, কুড়া ও আকাড়ি গো-খাদ্যের চাহিদা পূরণ করত। সরকার তাদের কাছ থেকে বোরো ও আমন মৌসুমে খাদ্যশস্য হিসেবে চাল সংগ্রহ অভিযানে চাল সংগ্রহ করত। মৌসুমের সময় এসব মিলার বাজার থেকে এক সঙ্গে ধান ক্রয় করার কারণে বাজারে প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হওয়ার জন্য বাজারে ধানের দামও বেড়ে যেত। আর এর সুফল পেত কৃষকরা। সেই সঙ্গে হাজার হাজার শ্রমিক কাজের সুযোগ পেত। কিন্তু উৎপাদন খরচ বেশি ও অটো রাইস মিলের উৎপাদিত চালের কারণে বাজারে তাদের উৎপাদিত চালের চাহিদা কমে যাওয়ায় ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যেতে শুরু করে হাস্কিং মিলগুলো। হাস্কিং মিলগুলো চালু না থাকায় এসব মিল মালিকরা হাটবাজার থেকে কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয় করেনা। অনেক চাতালে মৌসূমের সময় গম, ভূট্টা, মরিচসহ কাঁচা তেজপাতা শুকাতে দিচ্ছে ব্যবসায়ীসহ স্থানীয় মানুষজন। অনেকে ব্যাংকের সিসি ঋণ চালু রাখার জন্য মিল-চাতাল একবারে বন্ধ করে দিতে পারছে না। পক্ষান্তরে অটো রাইস মিলের চালের প্রতি ক্রেতাদের আগ্রহ বাড়তে থাকার জন্য বর্তমানে প্রায় পুরো চালের উৎপাদন ও সিন্ডিকেট করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে অটো রাইস মিল মালিকরা। এদিকে, এ বছর জেলার ৫টি উপজেলায় ৯৭ হাজার ৯১৮ হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়। কিন্তু অর্জিত হয়েছে ৯৮ হাজার ৫১৫ হেক্টর। চাষাবাদকৃত জমি থেকে চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২ লাখ ৭৬ হাজার ৩৬০ টন। সেখানে চাল উৎপাদন হয়েছে ৩ লাখ ২০ হাজার ৭১ টন।  সরকার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তা উৎপাদেনর তুলনায় অতি নগন্য। সরকারের বাস্তবমুখী পদক্ষেপের অভাবে ধানের বাজার মূল্য নিয়ন্ত্রণ করছে অটো রাইস মিল মালিক ও বড় বড় ব্যবসায়ীরা। তাদের ওপর নির্ভর করছে ধান চালের দাম বাড়া কমা। তারা কম দামে ধান ক্রয় করে সরকারি ক্রয় মূল্যের সুবিধা নিচ্ছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রতি মণ মোটা ধানের দাম ৭০০ টাকার উপরে থাকলেও তা কমতে কমতে বর্তমানে এসে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৫০০ টাকায়। এতে কৃষকদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে।
পঞ্চগড় সদরের অটো রাইস মিল মালিক শরীফ হোসেন ও জিন্নাহ সিন্ডিকেট করে চালের মূল্য বাড়ানোর অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমরাও ভালো নেই। নানা কারণে আমাদেরও লোকসান গুনতে হচ্ছে। তবে তারা তাদের কাছ থেকে ২৫ টাকা কেজি দরের চাল নিয়ে হাস্কিং মিল মালিকরা খাদ্য গুদামে সরবরাহ করেছে বলে স্বীকার করেছেন।
হাস্কিং মিল বন্ধ থাকার পরও তাদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহের কথা স্বীকার করে পঞ্চগড় সদর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক জহিরুল ইসলাম বলেন, আমরা যে মানের চাল গুদামে নিয়ে থাকি সে মানের চাল হাস্কিং মিলে তারা উৎপাদন করতে পারছে না। গত ২-৩ বছর তারা তাদের উৎপাদিত চাল সর্টার মিলে সর্টিং করে খাদ্য গুদামে সরবরাহ করেছে। এতে করে তাদের অনেক ঝামেলায় পড়তে হয়। তাই তারা এখন সরাসরি অটো রাইস মিলের চাল সরবরাহ করছে। এ চাল আমাদের নিয়ম অনুযায়ী হওয়ায় তা আমরা সরাসরি খাদ্য গুদামে ঢুকার অনুমতি দিচ্ছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি মিলারদের কাছ থেকে টাকা নেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, চাল উৎপাদনের জন্য হাস্কিং মিল প্রস্তুত, শ্রমিকের মুজুরি ও সর্টার মিলে চাল সর্টিং করে খাদ্য গুদামে সরবরাহ করতে যে খরচ হবে তার তুলনায় বরাদ্দ কম। এ জন্য মালিকরা হাস্কিং মিল চালু করছে না।  জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক (অ.দা.) বাবুল হোসেন বলেন, মিলের কার্যক্রম চালু রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী হাস্কিং মিল মালিকদের সঙ্গে খাদ্য গুদামে চাল সরবরাহের জন্য চুক্তি করা হয়েছে। বরাদ্দপ্রাপ্ত মিলগুলো চালু আছে কিনা তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়া হবে। বরাদ্দের ব্যাপারে চাপ থাকে যা আপনারা জানেন। বন্ধ হাস্কিং মিলগুলোর ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে খাদ্য মন্ত্রণালয় চিন্তা ভাবনা করছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status