প্রথম পাতা
তবুও সরতে চান না কেমিক্যাল ব্যবসায়ীরা
জিয়া চৌধুরী
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, রবিবার, ১০:৩৭ পূর্বাহ্ন
ভাইয়ের খোঁজে ছবি হাতে আনোয়ারা ছবি: জীবন আহমেদ
নিমতলী থেকে চুড়িহাট্টা। লাশের মিছিল। যে কেমিক্যালের আগুনে পুড়েছিল নিমতলীর ১২৪ প্রাণ সেই কেমিক্যালই যমদূত হয়ে আসে চুড়িহাট্টায়। ভয়াবহ আগুন কেড়ে নেয় অন্তত ৬৭টি তরতাজা প্রাণ। নিমতলী ট্র্যাজেডির পরই আওয়াজ উঠেছিল পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম সরিয়ে নেয়ার। গঠন হয়েছিল তদন্ত
কমিটি।
কমিটি সুপারিশ ও করেছিল। কিন্তু নয় বছরেও সেই সুপারিশের বাস্তবায়ন হয়নি। নয় বছর পর চকবাজার ট্র্যাজেডি। আবারো একই দাবি, একই আওয়াজ। কিন্তু যাদের লোভের আগুনে পুড়লো এতোগুলো প্রাণ সেই গুদাম মালিকরা কিছুতেই গুদাম সরাতে চান না। এই দলে আছেন অনেক ব্যবসায়ীও। গতকাল অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ওয়াহেদ ম্যানসনের নিচতলায় অক্ষত থাকা রাসায়নিক মজুত সরানোর সময় ব্যবসায়ীরা অনেকে প্রকাশ্যেই তাদের এমন অবস্থান জানান দেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি মেয়রের সামনেই তাদের অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করে উচ্চবাচ্য করেন। যদিও সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে পুরান ঢাকাকে যেকোনো মূল্যে রাসায়নিক গুদাম মুক্ত করার।
চকবাজার ট্র্যাজেডির পর চুড়িহাট্টা যেন এক বিধ্বস্ত জনপদ। চকবাজার মোড় থেকে শেখ আজগর আলী লেন ধরে ওয়াহেদ ম্যানশন। চুড়িহাট্টা জামে মসজিদের পাশ ঘেঁষা হায়দর বক্স লেন কিংবা ওয়াহেদ ম্যানশন ছাড়িয়ে ওয়াটার ওয়ার্কস রোড পুরো এলাকা শোকে মুহ্যমান। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার তিনদিন পরেও স্বাভাবিক হয়নি এখানকার শ’খানেক পরিবারের জীবন। ওয়াহেদ ম্যানশনের তিন দিকের সড়কে শত শত কালো রংয়ের ব্যানার জানান দিচ্ছে প্রাণ হারানোর শোক। গতকাল বেলা একটার কিছু আগে ঘটনাস্থলে যান ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন। পোড়া, বিধ্বস্ত ওয়াহেদ ম্যানশনের নিচতলায় থাকা রাসায়নিকের গুদাম ঘুরে দেখেন তিনি। দুপুর দেড়টা নাগাদ গুদাম থেকে বের হয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন দক্ষিণ সিটির মেয়র। অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানির ঘটনায় শোক জানিয়ে বলেন, আজ থেকে পুরান ঢাকার রাসায়নিকের গুদাম সরানোর কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলো। দাহ্য ও ভয়াবহ সব ধরনের রাসায়নিকের গুদাম পুরান ঢাকা থেকে না সরানো পর্যন্ত সিটি করপোরেশনের এমন অভিযান চলবে। নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তায় প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে বাড়ির মালিক, পঞ্চায়েত কমিটি ও কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের প্রতিও আহ্বান জানান মেয়র। গুদাম সরানোর কাজে সহযোগিতা না করলে সবার আগে বাড়ির মালিকদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেবারও হুঁশিয়ারি দেন সাঈদ খোকন। পুলিশের কাছে থাকা আগুনের সিসিটিভির ফুটেজের কথা উল্লেখ করে মেয়র বলেন, আমি নিশ্চিত হয়েছি যে একটি গাড়ির সিএনজি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। যা পরে হোটেলের গ্যাস সিলিন্ডারেও ছড়িয়ে যায়। এরপর রাসায়নিক থেকে আগুন ছড়িয়েছে কিনা তা পুলিশ ও তদন্তকারী সংস্থাগুলো খতিয়ে দেখবে।
পুরান ঢাকা এলাকায় আর কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাণহানি হতে দেয়া যাবে না বলেও জানান মেয়র। সাঈদ খোকনের বক্তব্যের মাঝেই কিছুটা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন পুরান ঢাকার কেমিক্যাল ও পারফিউম ব্যবসায়ীরা। মেয়রের বক্তব্যের মধ্যেই তারা ‘সিলিন্ডার সিলিন্ডার’ বলে শোরগোল করতে থাকেন। গণমাধ্যমে রাসায়নিকের গুদাম নিয়ে নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশেরও সমালোচনা করেন কেমিক্যাল ব্যবসায়ীরা। বুধবার রাতে আগুনের বিস্ফোরণ গ্যাস সিলিন্ডার থেকেই হয়েছে বলে নিশ্চিত করেন বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী। তারা জানান সারা দেশে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কারণেই বেশিরভাগ অগ্নিকাণ্ড ঘটছে। গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ বন্ধ না করা গেলে আগুনের ঘটনা কমানো যাবে না বলে হইচই করতে থাকেন ব্যবসায়ীরা। শিল্প মন্ত্রণালয় ও সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে আদতে রাসায়নিক গুদাম সরানোর কাজ শুরু হলেও বেশিরভাগ ব্যবসায়ী ও বাড়ির মালিকের সুর পুরোপুরি ভিন্ন। দক্ষিণ সিটির মেয়র সাঈদ খোকনের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউম মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা গুদাম স্থানান্তরে সায় দিলেও পেছনে বেশিরভাগ ব্যবসায়ী ছিলেন নাখোশ।
ব্যবসায়ী সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আরিফুর রহমান বলেন, পুরান ঢাকায় প্রায় দুই হাজারের মত কেমিক্যাল ও পারফিউম ব্যবসায়ী আছেন। নিমতলী ঘটনার পর প্রায় ৬০০ ব্যবসায়ী তাদের গুদাম সরিয়ে নিয়েছে। চুড়িহাট্টার ঘটনার পর ঝুঁকি এড়াতে তারা পুরোপুরি সরে যেতে চান বলে জানান। তিনি বলেন, কেরানীগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতার কারণে ব্যবসায়ীরা এতো দিনেও ব্যবসা স্থানান্তর করতে পারেননি। তবে মোহাম্মদ রাসেল নামে একজন ব্যবসায়ী বলেন, আমরা বারবার করে বলেছি কেমিক্যালের কারণে কোনো ধরনের বিস্ফোরণ ঘটেনি। গ্যাস সিলিন্ডার থেকেই আগুন লেগেছে। অথচ ওই বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে শুধু শুধু কেমিক্যাল ব্যাবসায়ী ও বাড়ির মালিকদের হয়রানি করা হচ্ছে। নবকুমার দত্ত সড়কের আরেক বাসিন্দা ও বাড়ির মালিক নাঈম আহমেদ বলেন, ওয়াহেদ ম্যানশন রোডের কয়েক বাসা পরেই আমার চাচার বাসা।
আমাদের নিজেদের বাড়িও একেবারে কাছে। কেমিক্যাল থেকে কোনো ধরনের বিস্ফোরণ না ঘটলেও গুদাম সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। এতে কয়েকশ’ ব্যবসায়ী ও বাড়ির মালিক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দাহ্য নয় এমন সব কেমিক্যাল গোডাউন সরানোর পক্ষে অনেক ব্যবসায়ী আপত্তি জানিয়েছেন। তবে, শিল্প মন্ত্রণালয়ের ও সিটি করপোরেশনের তৎপরতায় ওয়াহেদ ম্যানশন থেকে রাসায়নিক পণ্য সরানোর প্রক্রিয়া শনিবার দুপুর থেকেই শুরু হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওয়াটার ওয়ার্কস সড়কের একজন বাসিন্দা বলেন, পুরান ঢাকার বাড়িরগুলোর বেশিরভাগ মালিক অধিক লাভের আশায় বাড়ির নিচতলা ও বিভিন্ন ফ্লোর ভাড়া দেন। মানুষের কাছে ফ্ল্যাট ভাড়া দেয়ার চেয়ে বিভিন্ন কারাখানা ও কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের কাছে দেয়ার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ বেশি। ওয়াহেদ ম্যানশনের আশেপাশের কয়েকটি সড়কে গিয়েও এমন কথার প্রমাণ পাওয়া যায়। কে বি রুদ্র রোড, কাজী রিয়াজউদ্দিন রোড, পোস্তা এলাকা, লালবাগ, উমেশ দত্ত রোড, বকশীবাজার, কাজী রিয়াজউদ্দিন রোডের কেল্লার মোড়সহ আশেপাশের এলাকায় কারখানা ও গোডাউন হিসেবে ভাড়া দিতে চেয়ে সদ্য টাঙানো টুলেট লিফলেট দেখা গেছে। কারাখানা ও গোডাউন হিসেবে ভাড়া দিতে চাওয়া কয়েকজন বাড়ির মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে ভাড়া নিতে গেলে গুনতে হবে অগ্রিম কয়েক লাখ টাকা। ভাড়াও সাধারণ বসবাসের ফ্ল্যাটের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। বকশিবাজার এলাকার বাসিন্দা সরকারি কর্মকর্তা আজহারুল ইসলাম বলেন, ঐতিহ্য ও মুনাফার কারণে এখানকার অনেক পরিবার বহু বছরের পুরনো এসব ব্যবসা হাতছাড়া করতে চান না।
অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি থাকার পরও কয়েকশ’ কোটি টাকার ব্যবসার হারানোর লোভে তারা পুরান ঢাকা থেকে সরতে চাচ্ছেন না। এমন ঝুঁকির মধ্যে এই এলাকায় আর বসবাস করতে রাজি নন তিনি। চকবাজার ও আশেপাশের কয়েকজন ভাড়াটিয়ার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল তারাও বাসা বদল করতে চান। পরিবার-প্রিয়জনদের নিয়ে কোনো ধরনের ঝুঁকিতে বাস করার পক্ষে নন এসব ভাড়াটিয়ারা। এদিকে, চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিক দুই ভাই ও সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হওয়া প্রাইভেটকারের গাড়ির মালিকসহ অজ্ঞাত ১২ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন অগ্নিকাণ্ডে নিহত হওয়া জুম্মনের (৫০) ছেলে ও স্থানীয় বাসিন্দা মো. আসিফ (২৮)।
মামলায় একই উদ্দেশ্যে অবহেলাপূর্বক অগ্নিসংযোগের কারণে মৃত্যু ঘটানোসহ ক্ষতিসাধনের অপরাধে পেনাল কোডের ৩০৪(ক)/৪৩৬/৪২৭/৩৪ ধারা উল্লেখ করা হয়েছে। মামলায় মৃত হাজী ওয়াহেদের দুই ছেলে মো. হাসান ও সোহেল ওরফে শহীদকে আসামি করা হয়েছে। মামলার এজাহারে বাদী মো. আসিফ বলেন, হাজী ওয়াহেদের দুই ছেলে আর্থিকভাবে লাভবান হতে আগুন লেগে মানুষের জানমালের ক্ষতি হবে জেনেও তাদের চারতলা ফ্যামিলি বাড়ির বিভিন্ন তলায় দাহ্য পদার্থ ব্যবসায়ীদের গোডাউন হিসেবে ভাড়া দেয়। আসামিদের ৬৫/৬৬ নম্বর নন্দকুমার দত্ত রোডের বাড়িটির দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ তলায় থাকা বডি স্প্রে, পলিথিনের দানা ও কেমিক্যালে আগুন লেগে মোট ৬৭ জন মানুষের প্রাণহানি হয় বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে। আগুনের ঘটনায় প্রায় বিশ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে মামলায়, ট্রান্সমিটারে আগুন লাগার কথা উল্লেখ করা হলেও স্থানীয়রা জানান অগ্নিকাণ্ডে তিনটি ট্রান্সফরমারের একটিও ক্ষতিগ্রস্ত বা বিস্ফোরিত হয়নি। চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া বিদ্যুৎ ব্যবস্থা স্বাভাবিক করতে কাজ করছে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি)। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী প্রকৌশলী হরিচাঁদ হালদার জানান, আগুনে তিনটি বিদ্যুতের খুঁটি, ১৮০ মিটার এইচটি ১১ কেভি এরিয়াল লাইন ও ছয় স্প্যান এলটি তার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডে কোনো ধরনের ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণ হয়নি বলেও মানবজমিনকে জানান এই প্রকৌশলী। হরিচাঁদ হালদার বলেন, অনেকে বলছেন ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণে আগুন লেগেছে। এটা কোনোভাবেই সত্য নয়। আমরা আমাদের প্রতিবেদনে বিষয়টি উল্লেখ করেছি। আপাতত আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত তিনটি ভবনে বিদ্যুতের সংযোগ দেয়া যাচ্ছে না। এছাড়া আশেপাশের এলাকায় শিগগিরই বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
কমিটি।
কমিটি সুপারিশ ও করেছিল। কিন্তু নয় বছরেও সেই সুপারিশের বাস্তবায়ন হয়নি। নয় বছর পর চকবাজার ট্র্যাজেডি। আবারো একই দাবি, একই আওয়াজ। কিন্তু যাদের লোভের আগুনে পুড়লো এতোগুলো প্রাণ সেই গুদাম মালিকরা কিছুতেই গুদাম সরাতে চান না। এই দলে আছেন অনেক ব্যবসায়ীও। গতকাল অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ওয়াহেদ ম্যানসনের নিচতলায় অক্ষত থাকা রাসায়নিক মজুত সরানোর সময় ব্যবসায়ীরা অনেকে প্রকাশ্যেই তাদের এমন অবস্থান জানান দেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি মেয়রের সামনেই তাদের অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করে উচ্চবাচ্য করেন। যদিও সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে পুরান ঢাকাকে যেকোনো মূল্যে রাসায়নিক গুদাম মুক্ত করার।
চকবাজার ট্র্যাজেডির পর চুড়িহাট্টা যেন এক বিধ্বস্ত জনপদ। চকবাজার মোড় থেকে শেখ আজগর আলী লেন ধরে ওয়াহেদ ম্যানশন। চুড়িহাট্টা জামে মসজিদের পাশ ঘেঁষা হায়দর বক্স লেন কিংবা ওয়াহেদ ম্যানশন ছাড়িয়ে ওয়াটার ওয়ার্কস রোড পুরো এলাকা শোকে মুহ্যমান। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার তিনদিন পরেও স্বাভাবিক হয়নি এখানকার শ’খানেক পরিবারের জীবন। ওয়াহেদ ম্যানশনের তিন দিকের সড়কে শত শত কালো রংয়ের ব্যানার জানান দিচ্ছে প্রাণ হারানোর শোক। গতকাল বেলা একটার কিছু আগে ঘটনাস্থলে যান ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন। পোড়া, বিধ্বস্ত ওয়াহেদ ম্যানশনের নিচতলায় থাকা রাসায়নিকের গুদাম ঘুরে দেখেন তিনি। দুপুর দেড়টা নাগাদ গুদাম থেকে বের হয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন দক্ষিণ সিটির মেয়র। অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানির ঘটনায় শোক জানিয়ে বলেন, আজ থেকে পুরান ঢাকার রাসায়নিকের গুদাম সরানোর কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলো। দাহ্য ও ভয়াবহ সব ধরনের রাসায়নিকের গুদাম পুরান ঢাকা থেকে না সরানো পর্যন্ত সিটি করপোরেশনের এমন অভিযান চলবে। নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তায় প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে বাড়ির মালিক, পঞ্চায়েত কমিটি ও কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের প্রতিও আহ্বান জানান মেয়র। গুদাম সরানোর কাজে সহযোগিতা না করলে সবার আগে বাড়ির মালিকদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেবারও হুঁশিয়ারি দেন সাঈদ খোকন। পুলিশের কাছে থাকা আগুনের সিসিটিভির ফুটেজের কথা উল্লেখ করে মেয়র বলেন, আমি নিশ্চিত হয়েছি যে একটি গাড়ির সিএনজি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। যা পরে হোটেলের গ্যাস সিলিন্ডারেও ছড়িয়ে যায়। এরপর রাসায়নিক থেকে আগুন ছড়িয়েছে কিনা তা পুলিশ ও তদন্তকারী সংস্থাগুলো খতিয়ে দেখবে।
পুরান ঢাকা এলাকায় আর কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাণহানি হতে দেয়া যাবে না বলেও জানান মেয়র। সাঈদ খোকনের বক্তব্যের মাঝেই কিছুটা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন পুরান ঢাকার কেমিক্যাল ও পারফিউম ব্যবসায়ীরা। মেয়রের বক্তব্যের মধ্যেই তারা ‘সিলিন্ডার সিলিন্ডার’ বলে শোরগোল করতে থাকেন। গণমাধ্যমে রাসায়নিকের গুদাম নিয়ে নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশেরও সমালোচনা করেন কেমিক্যাল ব্যবসায়ীরা। বুধবার রাতে আগুনের বিস্ফোরণ গ্যাস সিলিন্ডার থেকেই হয়েছে বলে নিশ্চিত করেন বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী। তারা জানান সারা দেশে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কারণেই বেশিরভাগ অগ্নিকাণ্ড ঘটছে। গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ বন্ধ না করা গেলে আগুনের ঘটনা কমানো যাবে না বলে হইচই করতে থাকেন ব্যবসায়ীরা। শিল্প মন্ত্রণালয় ও সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে আদতে রাসায়নিক গুদাম সরানোর কাজ শুরু হলেও বেশিরভাগ ব্যবসায়ী ও বাড়ির মালিকের সুর পুরোপুরি ভিন্ন। দক্ষিণ সিটির মেয়র সাঈদ খোকনের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউম মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা গুদাম স্থানান্তরে সায় দিলেও পেছনে বেশিরভাগ ব্যবসায়ী ছিলেন নাখোশ।
ব্যবসায়ী সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আরিফুর রহমান বলেন, পুরান ঢাকায় প্রায় দুই হাজারের মত কেমিক্যাল ও পারফিউম ব্যবসায়ী আছেন। নিমতলী ঘটনার পর প্রায় ৬০০ ব্যবসায়ী তাদের গুদাম সরিয়ে নিয়েছে। চুড়িহাট্টার ঘটনার পর ঝুঁকি এড়াতে তারা পুরোপুরি সরে যেতে চান বলে জানান। তিনি বলেন, কেরানীগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতার কারণে ব্যবসায়ীরা এতো দিনেও ব্যবসা স্থানান্তর করতে পারেননি। তবে মোহাম্মদ রাসেল নামে একজন ব্যবসায়ী বলেন, আমরা বারবার করে বলেছি কেমিক্যালের কারণে কোনো ধরনের বিস্ফোরণ ঘটেনি। গ্যাস সিলিন্ডার থেকেই আগুন লেগেছে। অথচ ওই বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে শুধু শুধু কেমিক্যাল ব্যাবসায়ী ও বাড়ির মালিকদের হয়রানি করা হচ্ছে। নবকুমার দত্ত সড়কের আরেক বাসিন্দা ও বাড়ির মালিক নাঈম আহমেদ বলেন, ওয়াহেদ ম্যানশন রোডের কয়েক বাসা পরেই আমার চাচার বাসা।
আমাদের নিজেদের বাড়িও একেবারে কাছে। কেমিক্যাল থেকে কোনো ধরনের বিস্ফোরণ না ঘটলেও গুদাম সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। এতে কয়েকশ’ ব্যবসায়ী ও বাড়ির মালিক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দাহ্য নয় এমন সব কেমিক্যাল গোডাউন সরানোর পক্ষে অনেক ব্যবসায়ী আপত্তি জানিয়েছেন। তবে, শিল্প মন্ত্রণালয়ের ও সিটি করপোরেশনের তৎপরতায় ওয়াহেদ ম্যানশন থেকে রাসায়নিক পণ্য সরানোর প্রক্রিয়া শনিবার দুপুর থেকেই শুরু হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওয়াটার ওয়ার্কস সড়কের একজন বাসিন্দা বলেন, পুরান ঢাকার বাড়িরগুলোর বেশিরভাগ মালিক অধিক লাভের আশায় বাড়ির নিচতলা ও বিভিন্ন ফ্লোর ভাড়া দেন। মানুষের কাছে ফ্ল্যাট ভাড়া দেয়ার চেয়ে বিভিন্ন কারাখানা ও কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের কাছে দেয়ার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ বেশি। ওয়াহেদ ম্যানশনের আশেপাশের কয়েকটি সড়কে গিয়েও এমন কথার প্রমাণ পাওয়া যায়। কে বি রুদ্র রোড, কাজী রিয়াজউদ্দিন রোড, পোস্তা এলাকা, লালবাগ, উমেশ দত্ত রোড, বকশীবাজার, কাজী রিয়াজউদ্দিন রোডের কেল্লার মোড়সহ আশেপাশের এলাকায় কারখানা ও গোডাউন হিসেবে ভাড়া দিতে চেয়ে সদ্য টাঙানো টুলেট লিফলেট দেখা গেছে। কারাখানা ও গোডাউন হিসেবে ভাড়া দিতে চাওয়া কয়েকজন বাড়ির মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে ভাড়া নিতে গেলে গুনতে হবে অগ্রিম কয়েক লাখ টাকা। ভাড়াও সাধারণ বসবাসের ফ্ল্যাটের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। বকশিবাজার এলাকার বাসিন্দা সরকারি কর্মকর্তা আজহারুল ইসলাম বলেন, ঐতিহ্য ও মুনাফার কারণে এখানকার অনেক পরিবার বহু বছরের পুরনো এসব ব্যবসা হাতছাড়া করতে চান না।
অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি থাকার পরও কয়েকশ’ কোটি টাকার ব্যবসার হারানোর লোভে তারা পুরান ঢাকা থেকে সরতে চাচ্ছেন না। এমন ঝুঁকির মধ্যে এই এলাকায় আর বসবাস করতে রাজি নন তিনি। চকবাজার ও আশেপাশের কয়েকজন ভাড়াটিয়ার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল তারাও বাসা বদল করতে চান। পরিবার-প্রিয়জনদের নিয়ে কোনো ধরনের ঝুঁকিতে বাস করার পক্ষে নন এসব ভাড়াটিয়ারা। এদিকে, চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিক দুই ভাই ও সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হওয়া প্রাইভেটকারের গাড়ির মালিকসহ অজ্ঞাত ১২ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন অগ্নিকাণ্ডে নিহত হওয়া জুম্মনের (৫০) ছেলে ও স্থানীয় বাসিন্দা মো. আসিফ (২৮)।
মামলায় একই উদ্দেশ্যে অবহেলাপূর্বক অগ্নিসংযোগের কারণে মৃত্যু ঘটানোসহ ক্ষতিসাধনের অপরাধে পেনাল কোডের ৩০৪(ক)/৪৩৬/৪২৭/৩৪ ধারা উল্লেখ করা হয়েছে। মামলায় মৃত হাজী ওয়াহেদের দুই ছেলে মো. হাসান ও সোহেল ওরফে শহীদকে আসামি করা হয়েছে। মামলার এজাহারে বাদী মো. আসিফ বলেন, হাজী ওয়াহেদের দুই ছেলে আর্থিকভাবে লাভবান হতে আগুন লেগে মানুষের জানমালের ক্ষতি হবে জেনেও তাদের চারতলা ফ্যামিলি বাড়ির বিভিন্ন তলায় দাহ্য পদার্থ ব্যবসায়ীদের গোডাউন হিসেবে ভাড়া দেয়। আসামিদের ৬৫/৬৬ নম্বর নন্দকুমার দত্ত রোডের বাড়িটির দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ তলায় থাকা বডি স্প্রে, পলিথিনের দানা ও কেমিক্যালে আগুন লেগে মোট ৬৭ জন মানুষের প্রাণহানি হয় বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে। আগুনের ঘটনায় প্রায় বিশ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে মামলায়, ট্রান্সমিটারে আগুন লাগার কথা উল্লেখ করা হলেও স্থানীয়রা জানান অগ্নিকাণ্ডে তিনটি ট্রান্সফরমারের একটিও ক্ষতিগ্রস্ত বা বিস্ফোরিত হয়নি। চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া বিদ্যুৎ ব্যবস্থা স্বাভাবিক করতে কাজ করছে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি)। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী প্রকৌশলী হরিচাঁদ হালদার জানান, আগুনে তিনটি বিদ্যুতের খুঁটি, ১৮০ মিটার এইচটি ১১ কেভি এরিয়াল লাইন ও ছয় স্প্যান এলটি তার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডে কোনো ধরনের ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণ হয়নি বলেও মানবজমিনকে জানান এই প্রকৌশলী। হরিচাঁদ হালদার বলেন, অনেকে বলছেন ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণে আগুন লেগেছে। এটা কোনোভাবেই সত্য নয়। আমরা আমাদের প্রতিবেদনে বিষয়টি উল্লেখ করেছি। আপাতত আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত তিনটি ভবনে বিদ্যুতের সংযোগ দেয়া যাচ্ছে না। এছাড়া আশেপাশের এলাকায় শিগগিরই বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়ে যাবে।