প্রথম পাতা

যে কৌশলে ব্যাংকের টাকা হাতিয়ে নিতো ওরা

রুদ্র মিজান

২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, রবিবার, ১০:৩৪ পূর্বাহ্ন

‘হ্যালো স্যার পার্টি’। একটি ভয়ঙ্কর চক্র। প্রতারণার পদ্ধতি অভিনব। তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে মুহূর্তের মধ্যে লুটে নেয় ব্যাংকে সংরক্ষিত টাকা। এভাবে অল্প দিনে শত শত মানুষের সর্বস্ব লুটে নিয়েছে এই চক্র। চক্রটি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে আছে। ইতিমধ্যে এই চক্রের ফাঁদে পড়ে পথে বসেছেন অনেকেই। কেউ কেউ সহযোগিতা নিয়েছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে চক্রের সদস্যরা। তাদের প্রযুক্তির ব্যবহার ও কৌশলের সঙ্গে সফল হতে পারছিল না আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর চক্রের হোতাসহ কয়েক সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। জিজ্ঞাসাবাদে দিয়েছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। প্রতিদিনই কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা লুটে নিতো তারা।

নিঃস্ব হতেন প্রতারণার শিকার ব্যক্তিরা। গত এক বছরে চার শতাধিক মানুষ এই চক্রের প্রতারণার শিকার হয়েছেন। প্রতারণার শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে একজন সমির রঞ্জন বৈদ্য। তিনি রাজধানীর পশ্চিম ধানমণ্ডির নিরিবিলি হাউজিং সংলগ্ন শঙ্কর এলাকার বাসিন্দা। চাকরি করেন একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে। ঘটনাটি ঘটে গত বছরের ১০ই অক্টোবরে। হঠাৎ সমিরের মোবাইলফোনে কল। ‘হ্যালো স্যার, আমি রাশেদ ডাচ্‌বাংলা ব্যাংকের কাস্টমার কেয়ার থেকে বলছি...।’ তারপর লাইনটি কেটে যায়। নম্বরটি চেক করেন সমির রঞ্জন বৈদ্য। হ্যাঁ, নম্বর ঠিকই আছে। এই নম্বর থেকেই ব্যাংকের বিভিন্ন ক্ষুদেবার্তা আসে তার ফোনে। ভাবতে ভাবতেই আবার কল আসে। এবার একটি মোবাইলফোন নম্বর থেকে। আগের দেয়া পরিচয় পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি। ভরাট কণ্ঠে, সুন্দর উচ্চারণে ওই ব্যাংক কর্মকর্তা পরিচয় দানকারী ব্যক্তি জানান দুঃসংবাদটি।

তিনি বলেন, ‘আমাদের সার্ভারে সমস্যা হচ্ছে। আপনার অ্যাকাউন্টটি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এ থেকে কোনো টাকা হয়তো আর উত্তোলন করতে পারবেন না।’ কথা শুনে মাথা থেকে ঘাম ঝরছিল। অনেক কষ্টে কিছু টাকা জমিয়েছেন ব্যাংকে। এই টাকা খোয়া গেলে কী হবে তার। কিন্তু ভাবনার আর সময় দেন না ব্যাংক কর্মকর্তা পরিচয় দেয়া ওই ব্যক্তি। তিনি দ্রুত বলেন, ‘এটি আমরা এখনই সমাধানের চেষ্টা করছি। প্লিজ আপনার পাসওয়ার্ডটি বলুন। আশা করছি সমাধান হয়ে যাবে।’

কথা শুনে আশ্বস্ত হন সমির। পাসওয়ার্ড জানিয়ে দেন। এরপরই ঘটে মূল ঘটনা। মোবাইলফোনে ক্ষুদেবার্তা আসতে থাকে ব্যাংকের ব্যবহৃত নম্বর থেকে। একে একে ছয়টি ক্ষুদেবার্তা। ডাচ্‌বাংলা ব্যাংকের নেক্সাস ডিজিটাল কার্ড থেকে অ্যাকাউন্টে থাকা ১ লাখ ১৫ হাজার ৪৫২ টাকা থেকে মোট ১ লাখ ১৪ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে পাঁচ কিস্তিতে ২০ হাজার টাকা করে ১ লাখ ও আরেক কিস্তিতে ১৪ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়। তাৎক্ষণিকভাবে এটিএম কার্ডের ব্যালেন্স চেক করে সত্যতা পান। এভাবেই সর্বস্ব নিয়ে যায় প্রতারক চক্র। দীর্ঘদিন পর এ বিষয়ে গত ১৯শে ফেব্রুয়ারি হাজারীবাগ থানায় মামলা করেছেন সমির বৈদ্য।

মামলাটি তদন্তে মাঠে নামেন মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা। তথ্য-প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে শুরু হয় তদন্ত। নেক্সাস পে ও রকেট নম্বরের সূত্র ধরে তদন্ত করলেও অপরাধীদের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না কিছুতেই। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নানা প্রযুক্তি ও কৌশল ব্যবহার করে পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে নিরাপদে থাকার চেষ্টা করছিল চক্রটি। অবশেষে সন্ধান পাওয়া গেছে ভয়ঙ্কর এই চক্রের। চক্রের হোতা আরিফুল ইসলাম (২৬)। ফরিদপুরের মধুখালীর ডোমাইন পূর্বপাড়ার নিয়ামত আলীর পুত্র। এই চক্রে অন্তত আরো ১৫-২০ জন সম্পৃক্ত রয়েছে।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়েই লেখাপড়ার ইতি টেনে সৌদি আরবে পারি দিয়েছিল আরিফুল ইসলাম। সেখানে পরিশ্রম করে টাকা রুজি করতে গিয়ে জানতে পারে সহজ উপায়ে নিজ এলাকাতেই লাখ লাখ টাকা আয় করছে তার পরিচিতজনরা। এই প্রতারণার পথে তখন থেকেই হাঁটতে শিখেছে একই এলাকার আবদুস সালাল খানের পুত্র ইমতিয়াজ খান অনিক (২৩)। সম্পর্কে আরিফুলের ভাতিজা। ইমতিয়াজের কাছ থেকে গল্প শুনে প্রলোবদ্ধ হয় আরিফুল। গত বছরের শুরুর দিকে দেশে ফিরে গড়ে তোলে এক বিশাল চক্র। চক্রটি ঢাকা, কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, কুমিল্লাসহ বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে আছে। চক্রের অন্যান্য সদস্যদের কাজ হচ্ছে, রকেট, ইউক্যাশ, এমক্যাশ, ক্যাশ ইন, বিকাশসহ বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের গ্রাহকদের ফোন নম্বর সংগ্রহ করা। এজন্য সংশ্লিষ্ট এজেন্টের দোকানে গ্রাহকবেশে গিয়ে কৌশলে এন্টি খাতার ছবি ধারণ করে চক্রের সদস্যরা। তারপর এই ছবি পাঠানো হয় আরিফুল ইসলামের কাছে।

আরিফুল তার ফোনে ব্যবহার করতো একটি বিশেষ এ্যাপস। ওই এ্যাপসের সহযোগিতায় হুবুহু ব্যাংক, বিকাশসহ যেকোনো কাস্টমার কেয়ারের নম্বর সৃষ্টি করে কল দিতে পারে। হুবুহু নম্বর হওয়ার কারণে গ্রাহক সহজেই বিশ্বাস করে সংশ্লিষ্ট কাস্টমার কেয়ার থেকেই তাকে কল দেয়া হয়েছে। তারপর দ্রুত টাকা উত্তোলন করে একাধিক বেনামে নিবন্ধনকৃত নম্বর ব্যবহার করে তা ক্যাশ করতো। এসব কৌশলের কারণে দীর্ঘদিন ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল এই চক্র। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি।

মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার নিশাত রহমানের নেতৃত্বে তথ্য প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে চিহ্নিত করা হয় চক্রের সদস্যদের। তারপর অবস্থান নিশ্চিত হয়ে একাধিক অভিযান চালিয়ে গত ২৩শে ফেব্রুয়ারি আরিফুল ইসলাম, ইমতিয়াজ খানসহ চারজনকে গ্রপ্তার করা হয়েছে। অন্যরা হচ্ছে- কেরানীগঞ্জের রাজেন্দ্রপুর বাঘৈর গ্রামের মৃত সৈয়দ খবির মীরের পুত্র সৈয়দ হৃদয় হোসেন, বরিশালের বাকেরগঞ্জের সুন্দরকাঠি গ্রামের সালাম হাওলাদারের পুত্র ইমরান হোসেন।

এ বিষয়ে এডিসি নিশাত রহমান মানবজমিনকে বলেন, এটি একটি ভয়ঙ্কর চক্র। তারা শত শত মানুষকে নিঃস্ব করেছে। আমরা প্রায়ই প্রতারকদের গ্রেপ্তার করছি। কিন্তু এই প্রতারকদের কৌশল, পদ্ধতি আমাদের কাছে নতুন। এই চক্রে আরো অনেকে জড়িত থাকতে পারে। এ বিষয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে রিমান্ড প্রয়োজন। প্রতারণা সম্পর্কে সবাইকে সচেতন থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে কোনো প্রতারক ছাড়া কেউ গোপন নম্বর জানতে চাইবে না। প্রতারকরা অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি পিন নম্বর না চেয়ে এটার পরে ওটা চাপুন- এসব বলেও প্রতারণা করে থাকে। এসব কোনো কথাতেই সাড়া দেয়া যাবে না। যদি কোনো কারণে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে সমস্যা হয় অফিসে সশরীরে গিয়ে অভিযোগ করতে হবে বলে জানান তিনি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status