প্রথম পাতা

কয়েক সেকেন্ডে ঘিরে ফেলে ‘আগুনের সুনামি’

শুভ্র দেব

২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, রবিবার, ১০:৩৩ পূর্বাহ্ন

রাত ১০টা ৩২ মিনিট। চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদের সামনের নবদত্ত সড়কের রাজমহল রেস্তোরাঁর কারিগর নান রুটি তৈরিতে ব্যস্ত। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন দু’জন ক্রেতা। রেস্তোরাঁর প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে আছেন কালো প্যান্ট ও নীল টি-শার্ট পরা আরেক যুবক। রেস্তোরাঁর সামনের সড়কে তখন আবছা অন্ধকার। সড়কে তীব্র যানজট। জটে আটকা সারিবদ্ধ রিকশা, গাড়ি। তার পাশ দিয়ে চাপাচাপি করে পথচারীরা যাওয়া আসা করছিলেন। ১০টা ৩২ মিনিট ২৬ সেকেন্ডে হঠাৎ বিস্ফোরণের শব্দ, আগুনের স্রোত ধেয়ে আসে হোটেলের দিকে। হোটেলের কারিগর, দুই ক্রেতাসহ অন্য পথচারীরা তখন দিগভ্রান্ত হয়ে ছোটেন। লেলিহান আগুনে নিমিষেই গ্রাস করে সামনের পুরো সড়ক।

যানজটে  থাকা রিকশা, ভ্যান জ্বলছিল। তার পাশেই একটি দোকানে থাকা পারফিউমের কৌটাগুলো বিস্ফোরকের মতো শব্দ করে ছড়িয়ে পড়ছিল সড়কে। চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাতের এই চিত্র ধরা পড়েছে রাজমহল রেস্তোরাঁর সিসিটিভি ফুটেজে। ওই ফুটেজে দেখা যায় মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে সামনের সড়কটি নরককুণ্ডে পরিণত হয়। আগুন ধেয়ে আসায় সেখানে থাকা কেউ কেউ পালাতে পারলেও অনেকে যেখানে ছিলেন সেখানেই পুড়ে অঙ্গার হন। কেউ প্রাণ বাঁচতে ওয়াহেদ ম্যানশনের ভেতরে গিয়েছিলেন দৌড়ে। পরে সেখানে তাদের মৃত্যু হয়েছে আগুনে পুড়ে। সিসিটিভির দুটি ভিডিও ফুটেজ দেখে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত হয়েছে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। তবে, সেটি গাড়ির গ্যাস সিলিন্ডার না কি গাড়িতে পরিবহনের জন্য রাখা সিলিন্ডার বিস্ফোরণে হয়েছে সেটি এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী শাহাদাত হোসেন মানবজমিনকে বলেন, রাত ১০টার দিকে তিনি ওই সড়ক দিয়ে অফিস থেকে তার ফেবিদাউসের বাসায় ফেরেন। বাসায় পৌঁছে মোটরসাইকেলে করে রওয়ানা দেন ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পার্শ্ববর্তী সাগুন কমিউনিটি সেন্টারে। সঙ্গে ছিলেন তার ১৩ বছর বয়সী সাফিন ও কাজিন আল আমিন। ১০টা ২৫ মিনিটে মোটরসাইকেল নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে তিনি রাত সাড়ে ১০টার দিকে এসে পৌঁছান চুরিহাট্টা মসজিদের দক্ষিণ কোনার ডাইল পট্টি সড়কে। তখন আমার সামনে একটি মোটরসাইকেলে একজন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। শাহাদাত বলেন, আমি যখন মসজিদের কোনায় ওয়াহেদ মঞ্জিলের পশ্চিম দিকে অবস্থান করি তখন মসজিদের সামনের সড়কে তীব্র যানজট ছিল। পায়ে হেঁটে চলাচলের কোনো উপায় ছিল না। শুধুমাত্র আমার বাম দিকের চাঁদনীঘাট যাবার সড়কটি কিছুটা সচল ছিল। ঠিক তখনই হঠাৎ এক বিকট শব্দ শুনতে পাই। শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে ভুমিকম্পের মতো ওয়াহেদ মঞ্জিলের ২য় তলার পুরো দেয়ালটি আমার গাঁ ঘেঁষে ভেঙে পড়ে। এতে করে আমি আমার ছেলে ও কাজিন আল আমিন আঘাতপ্রাপ্ত হই। আমার হাত ও শরীরের বেশ কিছু অংশে ইটের আঘাত লাগে। এ ছাড়া আমার ছেলের মাথায় ও আল আমিনের কাঁধে আঘাত লেগে তার চারটি হাড় ভেঙে যায়। আমি তখন মোটরসাইকেল ছেড়ে দেই।

শাহাদাত বলছিলেন, আমি মোটরসাইকেলের চাবি রেখেই তড়িঘড়ি করে নেমে যাই। নামার সময় দেখি আমার পেছনের অনেক মানুষের মাথায়, শরীরের বিভিন্ন অংশে দেয়াল ভেঙে পড়ে তারা মাঠিতে লুটে পড়েছেন। এ ছাড়া আশপাশের দোকানগুলোর ব্যবসায়ী ক্রেতারা বাঁচার জন্য সাটার বন্ধ করে দেন। পরে জানতে পারি তারা আর বেঁচে নাই। শাহাদাত আরো বলেন, আল্লাহ আমাদের তিন জনের উপর রহমত নাজিল করেছেন। তা না হলে আমাদেরও বাঁচার কোনো উপায় ছিল না। চোখের সামনে থাকা অনেকেই হয়তো পুড়ে মারা গেছে। কারণ ওই মুহূর্ত পালিয়ে বাঁচার কোনো উপায় ছিল না। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে যখন আগুন আমাদের দিকে ধেয়ে আসছিল তখন চারদিকে শুধু দাউ দাউ আগুন দেখছিলাম আর একটার পর একটা বিকট শব্দ। আগুন ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। তখন আমার ছেলেটাকে নিয়ে বামের ওই সড়ক দিয়ে বের হয়ে যাই। এতটাই আতঙ্কিত ছিলাম অনেক দূর যাবার পরেও পেছন দিকে তাকাই নি। শাহাদাত বলেন, আমি যখন অফিস থেকে বাসায় ফিরছিলাম তখন আমি ওয়াহেদ মঞ্জিলের সামনে একটি পিকআপ ভ্যানে চারটি সিলিন্ডার দেখেছিলাম। ওই সিলিন্ডারগুলো তারা আনলোড করছিল। আমি যেখানে ছিলাম তার খুব কাছ থেকে সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়েছে। তাই নিশ্চিত হয়েই বলছি ওয়াহেদ মঞ্জিলের সামনে পিকআপ ভ্যানে থাকা সিলিন্ডার থেকেইে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। তিনি বলেন, ঘটনার সময়ই আমার নিমতলির অগ্নিকাণ্ডের কথা মনে হয়েছে। কারণ সেখানেও একই অবস্থা হয়েছিল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সেখানে আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে।

ঘটনার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী ওই এলাকার সবজি বিক্রেতা মিন্টু মিয়া বলেন, ঘটনার সময় আমি চুরিহাট্টা মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করছিলাম। সড়কে প্রচণ্ড যানজট থাকার কারণে ক্রেতারা দাঁড়ানোর সুযোগ পাচ্ছিল না। তাই বিক্রি বাট্টা কম ছিল। যানজটের মধ্যেই আমার সামনে ২টি মোটরসাইকেল, ১টি প্রাইভেটকার, ১টা ভ্যান, ১টি ডিম ভর্তি গাড়িসহ অনেক গাড়ি যানজটের কারণে আটকা  ছিল। এ ছাড়া রাস্তার ওই পাশে একটি সিএনজি অটোরিকশার সামনে একটি প্রাইভেটকার ও পেছনে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ছিল। মিন্টু বলেন, আমি ওই সময় ভ্যানের তরকারি সাজিয়ে রাখছিলাম। তখন নাকের মধ্যে একটা গন্ধ আসে। তাই আমি এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলাম। ঠিক তখনই বিকট এক শব্দের সঙ্গে সঙ্গে একটি গাড়িকে শূন্যের ওপর উড়তে দেখি। চারদিকে শুধু দাউ দাউ আগুন আর আগুন, সঙ্গে বিকট শব্দ। আগুনের লেলিহান শিখাগুলো গিয়ে লাগছিল বিদ্যুতের তারে। সঙ্গে সঙ্গে আগুনের উত্তাপ আরো বাড়তে থাকে। যানজটে আটকে পড়া যানবাহনগুলো পুড়তে থাকে। দিকভ্রান্ত পথচারী ও যাত্রীরাও বাঁচার জন্য চিৎকার চেচামেচি করতে তাকে। প্রবেশ করেন আশপাশের দোকানে। মিন্টু বলেন, উপায়ন্তর না পেয়ে আমিও বাঁচার জন্য মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করি। পাঁচতলায় উঠে দেখি একের পর এক বিকট শব্দে কি যেন বিস্ফোরিত হচ্ছে। আর আগুনের তীব্রতা আরো বাড়ছিল। এক ভবন থেকে আরেক ভবনে ছড়িয়ে পড়ে আগুন।

ঘটনার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী রাজমহল রেস্তোরাঁর পরিচালক মো. আমজাদ শিকদার মানবজমিনকে বলেন, সাড়ে ১০টার দিকে যখন আমি বাসায় যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ঠিক তখন আমার বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি এসে বললো, চাচা একটু চা খেয়ে যান। আমার হোটেলে সামনে দাঁড়িয়ে চা খেয়ে আমি ক্যাশিয়ার রাকিবকে বলছিলাম তাহলে আমি বাসায় যাচ্ছি। এই কথাটা শেষ করার আগেই হঠাৎ এক বিকট শব্দ শুনতে পাই। পেছনে তাকিয়ে দেখি প্রচণ্ড বেগে হোটেলের দিকে ধেয়ে এসেছে আগুন। আমি তখন হোটেলের সব ক্রেতা ও স্টাফদের বাইরে আসার কথা বলি। আমরা সবাই বাইরে গিয়ে তাকিয়ে দেখি একটির পর একটি বিস্ফোরণ হচ্ছে। তারপর আগুনের মাত্রা মারাত্মকভাবে বেড়ে যায়। ফলে আর কিছু দেখা যায়নি। আমজাদ শিকদার বলেন, পরে আমি দোকানের সিসি ক্যামেরায় দেখতে পাই কিভাবে আগুন লেগেছে। যেখানে আগুন লেগেছে সেখানে ফার্মেসি, টেইলার্স ও কেমিক্যালের দোকান ছিল। আমি দেখেছি ঠিক টেইলার্সের দোকানের সামনে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। এরপর আমি আর কিছু বলতে পারি নাই। আমি শুধু আমার দোকানটা বাঁচবে কি না সেই চিন্তা করেই কান্নাকাটি করছিলাম। কারণ কয়েক সেকেন্ডের ভেতরেই সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়।

খোরশেদ আলম নামের এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, আমার অবস্থান ছিল মসজিদের উত্তরপাশে। কাজ শেষে বাসায় ফিরছিলাম। রাস্তায় প্রচণ্ড যানজট দেখে আমি ফুটপাতের ওপর দিয়ে হাঁটছিলাম। তখন হঠাৎ বিকট শব্দ শুনতে পাই। পেছনে তাকিয়ে দেখি ওয়াহেদ মঞ্জিলের সামনে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। বিকট বিকট শব্দ আর শূন্যে ভাসছিল প্রাইভেট কার ও পিকআপ ভ্যান। যানজটে আটকা পড়া মানুষগুলো নড়াচড়ার সুযোগ পাচ্ছিল না। একদিকে যানবাহনের চাপ আর অন্যদিকে গ্যাসের আগুনে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। পালিয়ে যাবার সুযোগ পায়নি। খোরশেদ বলেন, মুহূর্তের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে যায় ওয়াহেদ মঞ্জিলের দ্বিতীয় তলায়। আগুন সেখানে পৌঁছার পরপরই আবার বিস্ফোরণ শুরু হয়। ফলে সেখানে আশ্রয় নেয়া ব্যক্তিরা আর বাঁচার সুযোগ পায়নি। কিছুক্ষণের মধ্যে সেই আগুন আশপাশের ভবনগুলোতে আঘাত হানে।

চুড়িহাট্টার ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানি হয়েছে অন্তত ৬৭ জনের। মারাত্মকভাবে আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে চিকিৎসা নিতে আসেন মোট ৫০ জন। এর মধ্যে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৩৯ জন। বাকি ১১ জনের ৯ জন বার্ন ইউনিটের আইসিইউতে। এ ছাড়া ১ জন অর্থোপেডিক ও ১ জন ওয়ান স্টপ সেন্টারে। নিহতদের মধ্যে গতকাল পর্যন্ত ৪৮ জনের মরদেহ তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আর অজ্ঞাত ১৯ জনের পরিচয় শনাক্তের জন্য ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করেছে সিআইডি। অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে নিখোঁজদেও নাম ঠিকানা সংগ্রহের কাজ করছেন দুর্যোগ ও ত্রাণমন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আকরাম হোসেন গতকাল মানবজমিনকে বলেন, ঘটনাস্থলে আমাদের পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তারা নিখোঁজদের নাম ঠিকানা সংগ্রহ করছেন। গতকাল পর্যন্ত আমরা ১৮ জনের তালিকা করতে পেরেছি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status