এক্সক্লুসিভ

নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন

দরিদ্র্যতা নয় লোভের বলি

মানবজমিন ডেস্ক

২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, শনিবার, ৮:৫৮ পূর্বাহ্ন

গ্যাস দিয়ে চলে এমন একটি গাড়ি ঢাকার এক মার্কেটের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, তখনই গাড়িটির পেছনে থাকা ওই গ্যাস সিলিন্ডারটি বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণের ফলে গাড়িটি কয়েক ফুট উঁচুতে উঠে যায় এবং রাস্তার পাশে থাকা রেস্টুরেন্টের কয়েকটি গ্যাস সিলিন্ডারেও আগুন ছড়িয়ে পরে। সেখান থেকে কাছের একটি ভবনের নিচতলায় থাকা প্লাস্টিকের দোকানে আগুন লাগে। আগুন ছড়িয়ে পরে পাশে থাকা আরেকটি দোকানে অবৈধভাবে মজুত করা রাসায়নিকে। ফলে সৃষ্টি হয় তীব্র এক বিস্ফোরণের।

সেখান থেকেই ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে পরা আগুন রাস্তায় থাকা বাইসাইকেল, রিকশা, গাড়ি মানুষসহ সবকিছুকে পুড়িয়ে দিয়েছে। নারকীয় এ ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ১১০ জন মানুষ। সামপ্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে শত শত মানুষ অগ্নিকাণ্ডে নিহত হয়েছে। যার জন্য দায়ী করা হয় ঘিঞ্জি ও অনিরাপদ অবকাঠামোকে। মোহাম্মদ রাকিব নামের এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, সেসময় অনেক মানুষ পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছিল। আমি ভয় পেয়ে টাকা-পয়সা ফেলেই রেস্টুরেন্ট থেকে পালিয়ে গেছি। তিনি দেখেছেন, একজন রিকশাচালক আগুন থেকে বাঁচতে প্রাণপণ চেষ্টা করা সত্ত্বেও আগুনে পুড়ে মারা গেছেন।

বাংলাদেশ একটি অত্যন্ত জনবহুল রাষ্ট্র। এর আয়তন যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য লোয়ার সমান। কিন্তু জনসংখ্যা প্রায় ৫০ গুণ। অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে স্থপতি নিজামুদ্দিন আহমেদ বলেন, দরিদ্রতার কারণে নয়, এর জন্য দায়ী লোভ। যারা এই ভবনে রাসায়নিক মজুত করেছে তারা সবাই ধনী। তাদের গাড়ি আছে, ভালো বাড়ি আছে। তাদের সন্তানরা বিদেশে পড়াশোনা করে। সরকারি কর্মকর্তাদের উচিত ছিল, সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের দরজায় কড়া নাড়া এবং তাদের এসব নিয়ে দূর হতে বলা। কিন্তু তারা সেটা করেন নি। ফায়ার সার্ভিসের আগুন নেভানোর দৃশ্যটি দেখে একটি যুদ্ধকালীন সময় মনে হচ্ছিল। পুড়ে যাওয়া গাড়ির রঙ ঝলসে যাওয়া দরজা ঝুলে আছে। উদ্ধারকর্মীরা ভেতর থেকে মরদেহ বের করে পরিষ্কার সাদা ব্যাগে ভরছে।

হাসপাতালগুলোতে উদ্বিগ্ন স্বজনরা গলা বাড়িয়ে দেয়ালে ঝোলানো হাতে লেখা মৃত ও জীবিতদের লিস্ট দেখছে। মুক্তা নামের এক মা কেঁদে কেঁদে বলছিলেন, কেন শুধু আমি ও আমার সন্তানই এই দুঃস্বপ্নের শিকার হলাম? আমি এখন কি করব? দুঃখজনক হলেও সত্য যে এসব চিত্র নতুন নয়। বাংলাদেশে অগ্নি ও নিরাপত্তার অভাবজনিত কারণে একেরপর এক দুর্ঘটনা ঘটেই চলছে।

২০১০ সালে ঢাকায় এক অগ্নিকাণ্ডে ১২০ জন নিহত হয়েছিলেন। বিদ্যুতের ট্রান্সফর্মার বিস্ফোরণ থেকে অবৈধভাবে মজুত রাখা রাসায়নিকে আগুন লেগে এ দুর্ঘটনার সূত্রপাত হয়। বুধবারের দুর্ঘটনার সঙ্গে যার চরম মিল পাওয়া যায়। ৯ বছর আগের সেই দুর্ঘটনার মতো এবারো ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ভয়াবহ ট্রাফিক জ্যাম ভেদ করে ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। ২০১০ সালের ঘটনার পর সরকারি কর্মকর্তারা এর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আইন অনুযায়ী, আবাসিক ভবনে কোনো ধরনের বিপদজনক বস্তু মজুত অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। কিন্তু এই আইনগুলো প্রায়ই এড়িয়ে যাওয়া হয় যথাযথ প্রয়োগ ও কখনো কখনো দুর্নীতির কারণে। বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন ধনী ব্যবসায়ীরা রুটিনমাফিক সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে থাকে কিংবা তাদের ব্যবসা কোথায় রয়েছে সেটি সম্পর্কে ভুল তথ্য দিয়ে থাকে।

২০১২ সালে ঢাকার উপকণ্ঠেই একটি পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ড ঘটে। সেটি একটানা ১৭ ঘণ্টা ধরে জ্বলছিল। এরপর দমকলকর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। পরে জানা যায় কারখানাটির জরুরি অবতরণের স্থানটি এত সঙ্কুচিত ছিল যে সেখানে কয়েক ডজন মানুষ আটকা পরে যায়। সে ঘটনায় ১১৫ জন নিহত হয়েছিলেন যাদের বেশিরভাগই ছিলেন দরিদ্র শ্রমিক। এর ঠিক এক বছরের মাথায়ই আট তলা একটা পোশাক কারখানা ধসে প্রায় ১১০০ মানুষ নিহত হন।

বৃহস্পতিবার দমকলকর্মীরা জানিয়েছেন, বিস্ফোরণের উৎস সম্পর্কে জানতে তারা অনুসন্ধান চালাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের মতে, প্রাকৃতিক গ্যাস দিয়ে চলা বাহনগুলো গ্যাসোলিনের মতোই নিরাপদ। তবে, যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণত প্রাকৃতিক গ্যাস দিয়ে নিজস্ব বাহন চালানো হয় না। তবে, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে গ্যাস দিয়ে চলতে পারে এমন গাড়ির বিশাল বাজার রয়েছে।

চকবাজার এলাকা পুরান ঢাকায় অবস্থিত। এটি ঘিঞ্জি এবং এখানকার রাস্তাগুলো সাপের মতো আঁকাবাঁকা ও সংকীর্ণ। ফলে সেখানে বাস বা ট্রাক চলাচল করতে পারে না। বুধবার এই কারণেই দমকল বাহিনীর ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে অনেক সময় লেগে যায়। ঘটনার সময় সেখানে থাকা একজন রেস্টুরেন্ট ম্যানেজার জানান, সেসময় রাস্তাগুলো ছিল লোকে লোকারণ্য। ভয়ার্ত মানুষ প্রাণ বাঁচাতে রাস্তা দিয়ে ছোটাছুটি করছিল। স্থপতি নিজামুদ্দিন আহমেদ বলেন, ঢাকার কর্তৃপক্ষ বছরখানেক আগেই ট্যানারিগুলোকে শহরের বাইরে সরিয়ে নিতে সফল হয়েছে। এখন এটি এ ধরনের ব্যবসার ক্ষেত্রেও করা দরকার। তিনি আরো বলেন, পরিবার পরিকল্পনার মতো বিভিন্ন জনসচেতনতামূলক ইস্যুতে আমাদের সফলতা রয়েছে। তাই এটিও আমরা চাইলেই করতে পারি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status