শেষের পাতা

পরস্পরবিরোধী অবস্থানে ঢাকা-লন্ডন

শামিমাকে বাংলাদেশে প্রবেশের অনুমতি দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না

কূটনৈতিক রিপোর্টার

২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, শুক্রবার, ৯:৫৪ পূর্বাহ্ন

আইএস গার্ল শামিমাকে নিয়ে লন্ডন ও ঢাকা পরস্পরবিরোধী অবস্থানে। তাকে কোনো অবস্থাতেই গ্রহণ করা হবে না মর্মে বাংলাদেশ সরকারের স্বপ্রণোদিত এক বিবৃতিতে ওই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, ‘আইএস ব্রাইড’ শামিমা বেগম বাংলাদেশি নাগরিক নন। তাকে বাংলাদেশে প্রবেশের অনুমতি দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ২০১৫ সালে বৃটিশ নাগরিক শামিমা তার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত পিতা-মাতার সঙ্গ ত্যাগ করে লন্ডন থেকে পালিয়ে সিরিয়া গিয়ে আইএস যোদ্ধার সঙ্গে জীবন শুরু করেন। এখন ৪ বছরের আইএস জীবনের ইতি টানতে চান তিনি। সিরিয়া ক্যাম্পে সদ্য জন্ম দেয়া নবজাতককে নিয়ে তিনি জন্মস্থান বৃটেনে ফিরতে চান, যেখানে তার জীবনের ১৫টি বছর কেটেছে।

কিন্তু বৃটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ তাকে গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। শামিমার পরিবার বরাবর পাঠানো এক চিঠিতে তার নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলেও জানিয়ে দিয়েছেন। ফলে নাগরিকত্ব হারানো শামিমার আশ্রয় এখন কোথায় হবে? সেই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। তাকে নিয়ে মাতামাতি সারা দুনিয়ায়। সেখানে নাম আসছে বাংলাদেশের। বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলছেন, শামিমার পিতা-মাতা যেহেতু বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বৃটিশ নাগরিক, তাই শামিমাও বাংলাদেশে নাগরিকত্ব চাইতে পারেন! কিন্তু না শামিমা নিজেই সেই সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন। জানিয়েছেন তিনি বাংলাদেশি নন, তিনি বৃটিশ নাগরিক। পৈতৃক সূত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পৃক্ততাও উড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। আইনজীবী মারফত বলেছেন, কোনোকালেই তিনি বাংলাদেশি পাসপোর্ট নেন নি বা বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন নি। শামিমাকে উদ্ধৃত করে বিবিসি বলছে, তিনি বলেছেন, আমার একটিই নাগরিকত্ব আছে। তা হলো বৃটেনের নাগরিকত্ব। যদি তা কেড়ে নেয়া হয়; তবে আমার আর কিছুই থাকবে না। আমার মনে হয় না তাদের (বৃটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সরকারের) এমনটা করার অধিকার আছে।

এটা হলো একটি জীবন পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত। শামিমা এও বলেছেন, তার সরকার নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে বা পরে তার সঙ্গে কোনো আলোচনা করেন নি। তার ভাষায়- ‘তারা আমার সঙ্গে কথাও বলে নি।’ শামীমা নিজেই যখন বলছেন তিনি বাংলাদেশি নন, তখনও আলোচনা থেমে নেই। ঘুরে ফিরে আসছে বাংলাদেশের নাম। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকারের নীতিনির্ধারকরা নড়েচড়ে বসেছেন। তাকে নিয়ে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা এবং চিঠি চালাচালির প্রেক্ষিতে বুধবার মধ্যরাতে সরকারের কড়া অবস্থানের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দেয়া হয়। মুহূর্তে তা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্ব মিডিয়ায়। ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারি করা এক বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছে যে, শামিমা বেগমকে ভুলভাবে বাংলাদেশ ও বৃটেনের যৌথ নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। সরকার দৃঢ়ভাবে বলছে, শামিমা বাংলাদেশের নাগরিক নন। তিনি জন্মসূত্রে বৃটেনের নাগরিক। বাংলাদেশের যৌথ নাগরিকত্বের জন্য তিনি কখনোই আবেদন করেন নি। অভিভাবকের দিক  থেকে যোগসূত্র থাকলেও শামিমা কখনোই বাংলাদেশে আসেন নি। সুতরাং তাকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেয়ার  কোনো প্রশ্নই আসে না।

কেবল আইএস সংশ্লিষ্ট শামিমাই নয়, যেকোনো ধরনের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলেও সরকারি ওই বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে। ঢাকার ওই বিবৃতি ছাড়াও অনলাইন গার্ডিয়ানের সঙ্গে কথা বলেছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এমপি। সেখানে প্রায় অভিন্ন ভাষায় তিনি শামিমা প্রশ্নে বাংলাদেশের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। প্রতিমন্ত্রী তার প্রতিক্রিয়ায় জানান, শামিমার নাগরিকত্ব বাতিলের বৃটিশ সিদ্ধান্তের কথা তিনি জেনেছেন মিডিয়ার রিপোর্ট থেকে। গার্ডিয়ান লিখেছে, বাংলাদেশের এমন কড়া অবস্থান বৃটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাজিদ জাভিদের জন্য সরাসরি একটি চ্যালেঞ্জ। সাজিদ বুধবার তার দেশের এমপিদের বলেছেন, ১৯ বছর বয়সী শামিমার নাগরিকত্ব বাতিলের ক্ষেত্রে কোনো শিথিলতা দেখানো হবে না। এ বিষয়ে বৃটেনের অবস্থান পোক্ত। তারা তার নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার বিষয়ে বুঝে শুনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এটা অনেকটা ‘স্থির সংকল্প’। বৃটিশ সংবাদ মাধ্যম বলছে, শামিমা প্রশ্নে বাংলাদেশি অভিবাসন আইন নিয়ে ঢাকা ও লন্ডন দৃশ্যত দুই রকম কথা বলছে।

শামিমার সন্তান বৃটেনের নাগরিক: বৃটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
এদিকে বৃটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হাউস অব কমন্সে নিশ্চিত করেছেন, ইসলামিক  স্টেটে যোগ দেয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তরুণী শামিমার সন্তান  জেরাহ আইন অনুযায়ী যুক্তরাজ্যের নাগরিক। বৃটিশ আইনে বলা হয়েছে, বাবা-মায়ের নাগরিকত্ব বাতিল হয়ে গেলেও সংশ্লিষ্ট সন্তানটির নাগরিকত্বের ওপর তার  কোনো প্রভাব নেই। একই মতামত ব্যক্ত করেছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। বৃটিশ ট্যাবলয়েড দ্য সান আরো উল্লেখ করেছে,  জেরাহর বাবা, সংশ্লিষ্ট আইএস জঙ্গি, যেহেতু নেদারল্যান্ডসের নাগরিক, সেহেতু জেরাহ  নেদারল্যান্ডসের নাগরিকত্বও পেতে পারে। শামিমা জানিয়েছেন, সে যুক্তরাজ্যে ফিরতে চায়। কিন্তু তার যুক্তরাজ্যে ফেরা নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ সরাসরি বলে দিয়েছেন, যুক্তরাজ্যের যেসব নাগরিক আইএসে যোগ দিয়েছিল, তাদেরকে দেশে ফিরতে বাধা  দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে তিনি দ্বিধাবোধ করবেন না। ইউনিভার্সিটি অব রিডিংয়ের আইন, সংঘাত ও বৈশ্বিক উন্নয়নের অধ্যাপক রোজ অ্যান ফ্রিডম্যান মন্তব্য করেছেন, ‘আমরা যতদূর জানি, তার বাংলাদেশের নাগরিকত্ব  নেই, তার ছেলেরও নেই।

বৃটিশ নাগরিকত্ব নিয়ে যুক্তরাজ্যে ফেরার পূর্ণ অধিকার তার রয়েছে। আপনি যদি বৃটিশ নাগরিক হন, তাহলে বিশ্বের যেখানে যে অবস্থায়ই জন্ম  হোক না কেন, আপনার সন্তান বৃটিশ নাগরিকত্ব পেয়ে যাবে।’ সাজিদ জাভিদও হাউস অব কমন্সে এটুকু স্বীকার করে নিয়েছেন,  জেরাহর বৃটিশ নাগরিকত্ব রয়েছে। তবে শামিমার নাগরিকত্ব যেহেতু বাতিল করে দেয়া হয়েছে, সেহেতু  সে আর যুক্তরাজ্যে ফিরতে পারবে না। লন্ডনের বেথনেল গ্রিন একাডেমি স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলেন শামিমা। ২০১৫ সালে আমিরা আব্বাস ও খাদিজা সুলতানা নামের আরো দুই কিশোরীকে সঙ্গে নিয়ে আইএসে যোগ দিয়েছিল সে। পরিবারকে একদিনের জন্য বাইরে যাওয়ার কথা বলে প্রথমে তুরস্ক গিয়েছিল তারা।

সেখান থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে সিরিয়ায় প্রবেশ করে ওই তিন কিশোরী। জিহাদিদের বিয়ে করে সন্তানদের যুদ্ধে পাঠানোর পরিকল্পনা করেছিল তারা। শামিমা স্কাই নিউজকে বলেছিল, রাকায় পৌঁছে ইংরেজি জানা যোদ্ধাকে বিয়ের আবেদন করে সে। ১০ দিন পর ২৭ বছর বয়সী এক ডাচ্‌ নাগরিকের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। তার স্বামী পরে সিরীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এরপর দুই সপ্তাহ আগে বাঘুজ থেকে পালিয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয় তারা।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status