প্রথম পাতা

ভালোবাসা কুড়ায় ভালোবাসা বিলায় ওরা

হাফিজ মুহাম্মদ

১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১০:২১ পূর্বাহ্ন

লিডোর আশ্রয় ভালোবাসায় পথশিশুদের দুঃখ ভোলা -নিজস্ব ছবি

তারা কেউ এতিম-অনাথ, কেউ প্রতিবন্ধী। কুড়িয়ে আনা হয়েছে রাস্তা-ফুটপাথ থেকে। আছে দুই বছর বয়সী শিশু থেকে ১৫ বছরের কিশোর-কিশোরী। এক সময় রাস্তায়-ফুটপাথে রাত-দিন কাটতো অনাহারে-অর্ধাহারে।  সেই শিশু-কিশোরদের মুখে এখন রাজ্যের হাসি। হাতে বই খাতা, কলম, রং পেন্সিল। ভালোবেসে কুড়িয়ে আনা এই শিশু-কিশোর এখন ভালোবাসা বিলাচ্ছে নিজেদের মধ্যে। তারা নিজেরাই দেখাশোনা করছে একে অন্যকে। তাদেরই একটি দল বিশেষ বিশ্বকাপে খেলতে লন্ডন যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ কাহিনী লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনে (লিডো) আশ্রয় পাওয়া শিশু-কিশোরদের। লিডো রাস্তা থেকে এতিম, অনাথ, প্রতিবন্ধী ও বিভিন্ন ধরনের যৌন হয়রানির শিকার পথশিশুদের কুড়িয়ে তাদের ভবিষ্যৎ গড়ে দিচ্ছে। দেখাচ্ছে আলোর পথ। কাউকে প্রাথমিক আশ্রয় কেন্দ্রে রেখে তাদের বাবা-মা খুঁজে বের করে তাদের কাছে পৌঁছে দেন। বাবা-মা খুঁজে পাওয়া শিশুদের লেখাপড়ার জন্য তিন বছরের বৃত্তির ব্যবস্থা করে দেয় সংস্থাটি।

যাদের পিতা-মাতার কোনো সন্ধান মিলে না তাদের বিভিন্ন পুনর্বাসন কেন্দ্রে হস্তান্তর করা হয়। আর যাদের পরিবারকে খুঁজে পাওয়া যায় না, যেসব শিশুরা বাবা-মা কারোই নাম বলতে পারে না এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী তাদের আশ্রয় হয় লিডোর নিজস্ব পিস হোমে। এখানে পরম যত্নে ফাদার এবং মাদাররা তাদের বড় করে তুলেন। শিশুরা প্রাথমিক লেখাপড়া পিস হোমেই করে। হাতে-কলমে শিখে নানারকম সৃজনশীল কাজ। নাচ, গান, তায়কোয়ান্দো, মার্শাল আর্ট, কম্পিউটারের নানা প্রোগ্রাম এসব শিশুদের অনেকেই ইতিমধ্যে রপ্ত করে ফেলছে। প্রথমবারের মতো এতিম শিশুদের নিয়ে আয়োজন করতে যাওয়া ক্রিকেট বিশ্বকাপে লিডোর আট শিশু নির্বাচিত হয়েছে। যারা ৩০শে এপ্রিল ইংলান্ডে অনুষ্ঠিত বিশেষ এ বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করবে। পিস হোমের কয়েকজন শিশু নিজেরা পড়ে আবার বাইরের স্কুলেও অন্যদের পড়াচ্ছে।

লিডোর ‘পিস হোম’ বসিলার ওয়াসপুর গার্ডেন সিটিতে নিজস্ব জায়গায়। এখানে লালিত পালিত হচ্ছে ৫২ জন শিশু-কিশোার। যাদের মধ্যে ২২ শিশু প্রতিবন্ধী। কয়েকজন শিশু তাদের মাদার ছাড়া আর কারো কাছে অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে না। কয়েকটি শিশুকে লিডোতে আনা হয়েছে ২/৩ বছর বয়সে। আবার কয়েকটি শিশু ৭/৮ বছর বয়সে আশ্রয় পেয়েছে লিডোতে। যারা এখন স্কুল, কলেজে পড়ছে। শারীরিক ও মানুষিক প্রতিবন্ধী শিশু যেমন এখানে তুলে আনা হয়েছে, তেমনি এমন শিশু রয়েছে যে একজন ক্যানসারের রোগী। এদের অনেকের মা-বাবা মারা গেছেন অথবা মা বা বাবা আরেকটি বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছেন। শিশুটি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পথে নেমে এসেছে। কেউ কেউ গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে পথে আশ্রয় নেয়। এই পথেই তারা আবার নানা নির্যাতনের শিকার হতে থাকে। এই শিশুদের পুনর্বাসনে লিডোর উদ্ধারকারী দলের সদস্যরা থানায় সাধারণ ডায়েরি করে এই শিশুদের হোমে নিয়ে আসেন। এখন এই শিশুরা মূলধারার স্কুলেও যাচ্ছে।

গতকাল লিডোর পিস হোমে দেখা যায় তাদের নানা কার্যক্রম। বিভিন্ন কাজে তারা ব্যস্ত সময় পার করছে শিশু কিশোররা। কেউ খেলাধুলা করছে তো আবার কেউ ব্যস্ত পড়ালেখায়। তারা সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে এসব করছে। তাদের সহযোগিতা করছেন তাদের তত্ত্বাবধায়ক সোহেল এবং তানিয়া। লিডোর পিস হোমের অনেক শিশুর ‘পিতা-মাতা’ এখন সোহেল তানিয়া। এছাড়া আরো ৫ জন মাদার তাদের সব ধরনের সেবা দিচ্ছেন প্রতিনিয়ত।

বসিলার এ পিস হোমে প্রবেশ করতেই দেয়ালে দেখা যায় বিভিন্ন রং তুলির কাজ, ওয়ালমেট ও কারুকার্জে সাজানো একটি দ্বিতল বাড়ি। সামনে একটি মোবাইল স্কুল ভ্যান থামানো। ভেতরে প্রবেশ করতেই শিশুদের ‘ড্যাড’ এবং ‘মম’ সোহেল এবং তানিয়া এগিয়ে আসেন। সোহেল শিশুদের বিভিন্ন অঙ্কন চিত্র দেখান। পিস হোমের সব কিছুই রাস্তা থেকে কুড়ানো এসব শিশুদের চিন্তা থেকে করা বলে জানান সোহেল। এরপরে শিশুরা একে এক তাদের প্রত্যেকের পরিচয় বলে। লিডোর যাত্রা শুরু ২০১০ সালে। কারিগর ফরহাদ হোসেন। হোমেই দেখা মিললো তার। কয়েকজন শিশুর রাস্তা থেকে তুলে আনার বৃত্তান্ত তুলে ধরেন লিডোর নির্বাহী। এসব শিশুদের একজন ‘ক’ নাম। যাকে আনুমানিক ৮-৯ বছর বয়সে ধর্ষণ করে রাস্তায় ফেলে দেয় দুর্বৃত্তরা। রাস্তা থেকে পথচারীরা তুলে থানায় নিয়ে যায়। পরে তাদের টিম খোঁজ পেয়ে শিশুটিকে তাদের আশ্রয়ে নেন। ডাক্তার দেখানোর পরে জানতে পারেন শিশুটি ৪ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। পরে পিস হোমেই শিশুটি আরেকটি ছেলে শিশুর জন্ম দেয়। এখন ধর্ষণের শিকার শিশুটি এবং তার দু’বছরের বাচ্চাটি লিডোর পিস হোমেই বড় হচ্ছে। আরেকটি শিশু হচ্ছে তমাল (ছদ্ম-নাম)। এ শিশুটি ছিল ভিক্ষুকদের গ্যাংয়ের শিকার।

শারীরিক প্রতিবন্ধী। হুইল চেয়ারেই তার দিন কাটে। ভিক্ষাবৃত্তি করা এ শিশুটিকে লিডোর স্বেচ্ছাসেবীরা তুলে নিয়ে এসে। এখন তার আশ্রয় বসিলার লিডোর পিস হোম। এখানে বড় হওয়া শিশুদের মধ্যে আক্তার, স্বপ্না আক্তার, আরজু রহমান, সানিয়া মির্জা, জেসমিন, রাসেল ইসলাম রুমেল, আবুল কাশেম, রুবেল ও নিজাম হোসেন ৮ জন নির্বাচিত হয়েছে প্রথমবারের মতো ইংলান্ডে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ‘স্ট্রিট চিলড্রেন ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপে’। তবে তাদের ইংল্যান্ডে যাওয়ার আগেই পড়তে হচ্ছে নানা প্রতিবন্ধকতায়। খেলার সময় ঘনিয়ে আসলেও তাদের পাসপোর্ট জটিলতায় আটকে গেছে। এদের মধ্যে নিজাম একাদশ শ্রেণিতে পড়ে। নিজাম শুধু ক্রিকেট নয় আরো নানা ধরনের কাজ শিখছেন। লিডোর দেয়ালে টাঙানো দেয়ালিকায় শুধু নিজামের হাতের ছাপ। এছাড়া আরো অনেক শিশুই তাদের হাতের ছাপ রেখেছেন লিডোর পিস হোমের দেয়ালে।

লিডো পরিচালিত হচ্ছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সহায়তায়। সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ফরহাদ হোসেন জানান, ‘একটি বাচ্চাও রাস্তায় থাকতে পারে না’ এ উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি এবং আরো কয়েকজন মিলে প্রতিষ্ঠা করেন লিডো। যদিও লিডো প্রতিষ্ঠার পূর্ব থেকেই তিনি উন্মুক্ত স্কুল পরিচালনা করে আসছেন ২০০০ সাল থেকে। এর আগেই তিনি ১৯৯০ সাল থেকে শিশুদের নিয়ে বিভিন্ন সেবামূলক পরিচালনা করে এসেছেন।

ফরহাদ হোসেন বলেন, লিডো ইতিমধ্যে ৮০০ এর অধিক পথ শিশুকে উদ্ধার করে তাদের নিজেদের প্রাথমিক আশ্রয় কেন্দ্র রেখে পরিবারের কাছে খুঁজে দিতে পেরেছে। আর আরো ৮০০ এর অধিক শিশুকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে হস্তান্তর করেছেন। ৬ জনের একটি নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবী  টিম রয়েছে যারা সর্বক্ষণ রাস্তায় ঘুরে ঘুরে শিশুদের উদ্ধার করে তাদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে নিয়ে যায়। সেখান প্রাথমিকভাবে ৬ সপ্তাহ রেখে চিকিৎসাসহ বিভিন্ন সেবা দেয়া হয়। এরপরে তাদের বাবা-মাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়। যাদের মা-বাবাকে পাওয়া যায় তাদের ফেরত দিয়ে স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয়। এক বছর করে তিন বছর পর্যন্ত তাদের বৃত্তি দেয়া হয়। তাদের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ রক্ষা করা হয়।

ফরহাদ হোসেন আরো বলেন, এ বছর লন্ডনের ‘স্ট্রিট চাইল্ড ইউনাইটেড এই বিশ্বকাপে’ খেলার জন্য লিডোকে আমন্ত্রণ জানায়। প্রতিটি দেশ থেকে চারজন ছেলে ও চারজন মেয়ে শিশুকে নির্বাচিত করা হয়েছে। এতে বাংলাদেশ, ইংল্যান্ডসহ ১০টি দেশের ৮০ জন পথশিশু (যারা এক সময় পথে ছিল) অংশ নিচ্ছে। কিন্তু তারা পাসপোর্ট করাতে গিয়ে ঝামেলায় পড়েছে নানাভাবে। তাদের আসল মা-বাবার পরিচয় না থাকায় পাসপোর্ট বিভাগ ফাইল নিচ্ছে না। আবার পাসপোর্ট বিভাগ নিলেও এরপরে ভেরিফিকেশনে গিয়ে ঝামেলায় পড়তে হবে বলে জানান। পাসপোর্ট বিভাগে আদালত থেকে তাদের রায় নিয়ে যেতে বলছে।

তিনি বলেন, সরকার এসব শিশুর দিকে সুনজর দিলে ওদের বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করা সহজ হবে। কেননা তারা এখন আর লিডোর বাচ্চা নয়। তারা বিশ্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে। তারা এ দেশের সম্মান বয়ে আনবে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status