প্রথম পাতা

কোচিং বৃত্তে শিক্ষা, ৩২ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য

নূর মোহাম্মদ

১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, মঙ্গলবার, ১০:১১ পূর্বাহ্ন

লক্ষ্য ভালো ফল বা জিপিএ-৫। এই লক্ষ্যের  পেছনে ছুটছে শিক্ষার্থীরা। ভালো ফলের জন্য ভালো মানের স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরাও নিজ প্রতিষ্ঠানে ভরসা রাখতে পারছে না। ছুটছে কোচিং সেন্টারে। আর এসব কোচিং সেন্টারে আছেন ওইসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা। বলতে গেলে অনেকটা কোচিং  বৃত্তে বন্দি হয়ে পড়েছে দেশের মূল শিক্ষা ব্যবস্থা। সম্প্রতি উচ্চ আদালতে কোচিং বন্ধের নীতিমালা বৈধ ঘোষণা করায় এখন আর স্কুল কলেজের শিক্ষকরা কোচিং করাতে পারবেন না। কোচিং নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের। কোচিং ঘিরে বছরে অন্তত ৩২ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়। ফলে এই বাণিজ্য ঘিরে গড়ে উঠেছে বড় একটি সুবিধাভোগী সিন্ডিকেট। কোচিং নিয়ে আলোচনা সমালোচনার মধ্যে গত বছর রাজধানীর সরকারি প্রতিষ্ঠানের ৫২২ জন শিক্ষককে চিহ্নিত করে তাদের দ্রুত বদলির সুপারিশ করে দুর্নীতি দমন কমিশন। কিন্তু তাদের একজন শিক্ষককেও এ পর্যন্ত বদলি করা যায়নি। অভিযোগ আছে এই শিক্ষকরা কোচিং সিন্ডিকেটে জড়িত।

দেশজুড়ে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠা কোচিং সেন্টারগুলো রাজধানীসহ দেশের বড় বড় নামকরা স্কুল কলেজের শিক্ষকরা চালান। এক দশক ধরে চলা রমরমা এ বাণিজ্যে এক শ্রেণির শিক্ষা ব্যবসায়ীরা হয়েছে কোটিপতি। প্রাথমিক ও অষ্টম শ্রেণিতে সমাপনী পরীক্ষা চালু করার পর থেকেই কোচিং বাণিজ্য আরো রমরমা হয়ে উঠে। বিভিন্ন মহল থেকে কোচিং বন্ধের দাবি উঠার পর সিন্ডিকেট ভাঙতে তৎপরত হয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত বছর সংস্থাটি রাজধানী ২৪টি স্কুলের ৫২২ জন শিক্ষককে ঢাকার বাইরে বদলির সুপারিশ করে। তাদের ২৫ জনকে বদলির আদেশ দেয়ার পরে তা প্রত্যাহার হয়। কেন তাদের বদলি করা যায়নি এ প্রশ্নের উত্তর নেই কারও কাছে।

রাজধানীতে ৫২২ শিক্ষকের সিন্ডিকেট:  রাজধানীর ২৪টি সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা ক্লাসে পাঠদানের চেয়ে প্রাইভেট পড়ানোর কাজেই বেশি ব্যস্ত। বছরের পর বছর ধরে একই স্কুলে থেকে এসব শিক্ষকরা কোচিং বাণিজ্য করে আসছেন। হয়েছেন বিপুল অর্থ বিত্তের মালিক। শিক্ষা প্রশাসনকে অনৈতিক সুবিধা দিয়ে বছরের পর বছর ঢাকার একই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। রাজধানীর এমন ৫২২ জন শিক্ষকের তালিকা সংগ্রহ করে বদলির সুপারিশ করেছে দুদক। তার আগে দুদকের পরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদীন শিবলীর নেতৃত্ব পাঁচ সদস্যের একটি দল ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন সরকারি স্কুল পরিদর্শন করে এসব শিক্ষকদের নাম সংগ্রহ করেন। অনুসন্ধানে তারা জানতে পান, ২৪টি সরকারি স্কুলের ৫২২ জন শিক্ষক ১০ বছর থেকে ৩৩ বছর পর্যন্ত একই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। এসব শিক্ষককে সরকারি নীতিমালা বা নির্দেশিকা অনুসারে বদলি করা হয়নি বা হচ্ছে না।

দুদকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৫২২ জন শিক্ষকের মধ্যে গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের ৩২ জন, মোহাম্মদপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ২৬ জন, ধানমণ্ডি গভর্নমেন্ট বয়েজ হাইস্কুলের ১৭ জন, মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ২৪ জন, শেরেবাংলা সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ২৭ জন, সরকারি বিজ্ঞান কলেজ সংযুক্ত হাইস্কুলের ২৫ জন, খিলগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ৩১ জন, তেজগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ২১ জন, গণভবন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ২৪ জন, মিরপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৯ জন, ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের ২৯ জন শিক্ষক রয়েছেন। এ ছাড়া নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৯, নারিন্দা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ৩১, আরমানিটোলা সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ২১, ঢাকা গভর্নমেন্ট মুসলিম হাইস্কুলের ৯, ইসলামিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮, মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৩২, বাংলাবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ২২, টিকাটুলী কামরুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৩০, তেজগাঁও সরকারি বালিক উচ্চ বিদ্যালয়ের ২৮, শেরে বাংলা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ২৪, ধানমণ্ডি কামরুন্নেছা সরকারি বিদ্যালয়ের ৭, ধানমণ্ডি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৯ এবং নিউ গভর্নমেন্ট গার্লস হাইস্কুলের ৭ জন শিক্ষক রয়েছেন।

এ ব্যাপারে মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক) প্রফেসর আবদুল মান্নান মানবজমিনকে বলেন, দুদকের সুপারিশের পর অভিযুক্ত শিক্ষকদের বদলির উদ্যোগ নেয়ার পরও তা আটকে যায়। তালিকাভুক্ত শিক্ষকদের বদলির বিষয়টি এখন মন্ত্রণালয়ের এখতিয়াভুক্ত। তারাই ভালো জবাব দিতে পারবে।

অন্যদিকে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার এক প্রতিবেদনে সারা দেশের ৫০৬ জন শিক্ষকদের তালিকা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে দেয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সর্বনিম্ন ১০ জন সর্ব্বোচ ৫০০ জন পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কোচিং পড়ান। কোচিং না করলে পরীক্ষায় নম্বর কমিয়ে দেয়া, ক্লাসে অনুপস্থিত দেখানো, পরীক্ষা হলে অহেতুক হয়রানি, অভিভাবকদের হুমকি দেয়া হয়। কোনো কোনো শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়ানো, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায়, নিজের কোচিং সেন্টারের বিজ্ঞাপন ক্লাস রুমে বিতরণ করা, অন্য কোচিং ক্লাস নেয়ার তথ্যও পেয়েছে গোয়েন্দা সংস্থাটি। এসব কোচিং বাণিজ্য বন্ধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি এবং মনিটরিং কমিটির কোনো তৎপরতা দেখতে পায়নি সংস্থাটি। কোচিং বন্ধে সংস্থাটি চারটি সুপারিশ করে।

এ সংস্থার প্রতিবেদনে কোচিংবাজ এসব শিক্ষকদের নাম, প্রতিষ্ঠানের নাম এবং তিনি কোথায় কোচিং পড়ান তার ঠিকানাও দেয়া হয়েছে। তিন ক্যাটাগরিতে সারা দেশের ৫০৬ জন শিক্ষকের নাম দেয়া হয়েছে শিক্ষামন্ত্রণালয়ে কাছে। এরমধ্যে আরমানিটোলা গভঃ হাইস্কুলে ৬ জন, নিউ গভঃ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ২ জন, আরমানিটোলা বংশাল ২ জন, সরকারি কামরুন্নেছা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় ৪ জন, মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৮ জন, মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ১৩ জন, তেজগাঁ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ১ জন, গর্ভমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলে ৫ জন শিক্ষক কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। রাজধানীর বাইরে নংসিংদী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৮ জন, টাঙ্গাইলে বিন্দুবাসিনী সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে ৯ জন, জামালপুর জেলা স্কুলে ৯ জন, জামালপুর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে ৫ জন, ময়মনসিংহে বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৪ জন, ফরিদপুর জেলা স্কুলে ৬ জন, ফরিদপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ জন, রাজবাড়ী সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে ৮ জন, রাজবাড়ী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৮ জন, শরীয়তপুরে পালং তুলাসার গুরুদাস সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ৫ জন, শরীয়তপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ জন, গোপালগঞ্জ এসএম মডেল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ৪ জন, চট্টগ্রামের কলেজিয়েট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৪ জন, নাসিরাবাদ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে ১২ জন, চট্টগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ৭ জন, সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয় চট্টগ্রামে ৪ জন, ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ জন, কুমিল্লা জেলা স্কুলে ১১ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাবেরা সোবহান সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ৪ জন, অন্নতা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ৭ জন, গর্ভঃ মডেল গার্লস হাই স্কুল ৫ জন, চাঁদপুর মাতৃপীঠ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ১১ জন, নোয়াখালীর সরকারি বালিকা বিদ্যালয় ৩ জন, নোয়াখালী জিলা স্কুল মাইজদী ১০ জন, খাগড়াছড়ি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, খাগড়াছড়ি সদর ৭ জন, ঝিনাইদহে সরকারি বালিকা স্কুলে ৮ এবং বালক স্কুলে ৭ জন শিক্ষক কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত। এ ছাড়াও কুষ্টিয়া জিলা স্কুলে ১০ জন, চুয়াডাঙ্গা ভি জে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ জন, চুয়াডাঙা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৪ জন, সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ৭ জন, বাগেরহাট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৩ জন, বাগেরহাট সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ১১ জন, রাজশাহী ল্যাবরেটরি হাই স্কুলে ৭ জন, শিরোইন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়-রাজশাহীতে ১০ জন, সরকারি পিএন উচ্চ বিদালয় রাজশাহীতে ১৩ জন, নাটোর সরকারি উচ্চ বালক উচ্চ বিদ্যালয় ৪ জন, নওগাঁ কেডি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ৭ জন, পাবনা জেলা স্কুলে ৪ জন, বগুড়া সরকারি বালিকা স্কুলে ৩ জন, জয়পুরহাটে রামদেও বাজলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ৭ জন, কুড়িগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ১১ জন, কুড়িগ্রাম সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ১০ জন, পটুয়াখালী সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয় (প্রভাতী শাখা) ৯ জন এবং দিবা শাখায় ১২ জন, পিরোজপুর সরকারি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৫ এবং বালক বিদ্যালয়ে ৪ জন, সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়-সিলেট ৩ জন, হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ৩ জন, সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয় ৭ জন শিক্ষক রয়েছেন।  এ ছাড়াও আলাদাভাবে রাজধানীর অন্যতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মতিঝিলের আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের কোচিং বাণিজ্যে যুক্ত ১২৮ শিক্ষকের তালিকা প্রকাশ করে দুদক। তালিকায় প্রতিষ্ঠানটির তিনটি ক্যাম্পাসের মধ্যে স্কুল শাখার ১০৯ এবং কলেজ শাখার ১৯ শিক্ষকের নাম রয়েছে।
২০১২ সালের ২০ জুন ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা-২০১২ জারি করে শিক্ষামন্ত্রণালয়। সে অনুসারে কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না। প্রতিষ্ঠান প্রধানের লিখিত অনুমতি সাপেক্ষে অন্য প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ১০ শিক্ষার্থীকে পড়াতে পারবেন। এই নীতিমালা লঙ্ঘন করলে শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিও স্থগিত করা হবে। কিন্তু বর্তমানে নীতিমালা সরকারি কাগজেই সীমাবদ্ধ, এর তেমন কোনো প্রয়োগ নেই।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status