বাংলারজমিন

পাল্টে যাচ্ছে সরাইলের মৃৎশিল্পীদের দিনকাল

মাহবুব খান বাবুল, সরাইল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) থেকে

১৯ জানুয়ারি ২০১৯, শনিবার, ৮:০১ পূর্বাহ্ন

ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে সরাইলের মৃৎশিল্পীদের দিনকাল। তাদের শৈল্পিকতায় লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। মৃৎশিল্পের চাহিদা বেড়েছে অনেক। উপজেলা সদরে সৃষ্ট ‘ক্রিয়েটিভ কর্ণার’-এর মাধ্যমে গোটা সরাইলসহ বিভিন্ন জায়গায় ভালো দামে বিক্রি হচ্ছে তাদের তৈরি মৃৎশিল্প। সেইজন্য বেড়ে গেছে তাদের কর্মতৎপরতা। সংসারে ফিরে আসছে স্বাচ্ছন্দ্য। ছেলেমেয়েরা হচ্ছে স্কুলমুখী। সকলের মুখেই ফুটছে হাসি। আগের চেয়ে এখন অনেক পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি তারা। এখন আর তিন বেলার আহারের চিন্তা করতে হচ্ছে না তাদের। এ পরিবর্তনের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন সদ্য সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে ইসরাত। তবে এখনো কাটেনি তাদের নদী ভাঙনের আতঙ্ক। মাঝে মধ্যে তাদের রাতও কাটে নির্ঘুম।
সরজমিনে ঘুরে জানা যায়, মেঘনা নদীর পাড়ের পানিশ্বর গ্রামের পাল পরিবারগুলো যুগ যুগ ধরে বসবাস করছেন। বাপ-দাদার পেশাটা আঁকড়ে ধরেই কোনোরকমে বেঁচে আছেন তারা। প্রাকৃতিক নানা প্রতিকূলতা তাদের বারবার আঘাত করছে। প্রতি বছরই মেঘনায় বিলীন হচ্ছে তাদের বসতঘর। ভাঙনের সঙ্গে লড়াই করে অনেক পরিবারই চলে গেছেন অন্যত্র। ২০১৭ সালের ভাঙনে রেকর্ড পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তাদের। অনেককে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করতে হয়েছে। বর্তমানে মাত্র ৫০-৬০টি পরিবার রয়েছে। মাটি দিয়ে মান্ধাতা আমলের সামগ্রী তৈরি করে পাইকারি মূল্যে বিক্রি করছেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এ সময়ে এ পেশায় তিন বেলার আহার যোগাড়ই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। তাই অর্থাভাবে চিকিৎসা শিক্ষা ও ভালো জামা কাপড়ের কথা ভাবতেই পারছিলেন না তারা। বৃদ্ধ নারী পুরুষ কিশোর যুবক যুবতী ও শিশুদের চোখে মুখে ছিল নিদারুণ কষ্টের চাপ। হাজারো সমস্যার কথা বলতে গিয়ে তারা চোখের পানি ছেড়ে দিয়েছেন। লজ্জায় অনেকে কথা বলতে এসেও চলে গেছেন মলিন মুখে। তারপর মেঘনার ভয়াবহ ভাঙন তাদের একেবারে নিঃস্ব করে ফেলেছিল। নিরুপায় হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও অনেককে মেঘনার একেবারে কোলেই বসবাস করতে হচ্ছে। নদী ভাঙন ও পেশার বাজে অবস্থায় যখন পালপাড়ার বাসিন্দা মৃৎশিল্পীরা একেবারেই দিশাহারা। তখন পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে ইসরাত। প্রাথমিক অবস্থায় কয়েকটি পরিবারকে উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অনুদান দিলেন। সরকারি খাস জায়গায় বসবাস করার ব্যবস্থা করে দিলেন আরো কয়েকটি পরিবারকে। পরিবার ও প্রতিষ্ঠানে ব্যবহারযোগ্য আধুনিক ডিজাইনের সামগ্রী তৈরি করে বাজারজাতকরণের মাধ্যমে মৃৎশিল্পীদের আর্থিকভাবে সচ্ছল করার চিন্তা করলেন ইউএনও। পালপাড়ায় ঘুরে তিনি হিন্দু মুসলামান উভয় সম্প্রদায়ের মহিলাদের প্রশিক্ষণে নিয়ে আসলেন। চেয়ারম্যান দীন ইসলামের সহায়তায় ইউনিয়ন পরিষদের একাধিক গ্রুপের প্রশিক্ষণ দিলেন। সনদের সঙ্গে তাদের সম্মানী ভাতাও দিলেন। প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে তারা সকলেই উজ্জীবিত হলেন। ২০-২৫ রকমের সম্পূর্ণ নতুন সামগ্রী তৈরি করতে শিখলেন। তাদের হাতে চলে আসল আধুনিক পদ্ধতির শৈল্পিকতা। ঘুরে দাঁড়ালেন সকলেই। আগের চেয়ে কাজের গতিও বেড়ে গেল। নয়নাভিরাম চাকচিক্য পূর্ণ ভিন্ন ডিজাইনের ফুলদানি, কলমদানি, নৌকা, কুমির, চিংড়ি মাছ, পাখি, শাপলাফুল, গোলাপফুল, ঈগল পাখি, গরু, মহিষ, ব্যাংক, দেওয়ালিকা, কড়াই, দইয়ের পাতিল, চায়ের কাপ ও ভাত খাওয়ার প্লেট (সানকি)। আরো হরেক রকমের আসবাপপত্র। এগুলোর চাহিদা বৃদ্ধি করে বাজারজাতকরণের লক্ষ্যে উপজেলা সদরে করেছেন মেলা। স্থানীয় সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা ও সাবেক জেলা প্রশাসক রেজওয়ানুর রহমান উদ্বোধন করেছেন মেলা, ডিসপ্লে সেন্টার ও ক্রিয়েটিভ কর্ণার। উপজেলা সদরের ক্রিয়েটিভ কর্নারে এখন দিনরাত বিক্রি হচ্ছে মৃৎশিল্প সামগ্রী। সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছেন মো. মেহেদী হাসান। শুধু সরাইল নয়, ভিন্ন উপজেলা ও জেলার লোকজনও এখন ছুটে আসছেন ওই ক্রিয়েটিভ কর্নারে। পছন্দের সামগ্রী দেদার ক্রয় করছেন তারা। বিক্রিকৃত টাকা যাচ্ছে দরিদ্র অসহায় পালপাড়ার ওই মৃৎশিল্পীদের কাছে। আস্তে আস্তে তারা আগের চেয়ে বেশি অর্থ উপার্জনে সক্ষম হচ্ছেন। পাল্টে যাচ্ছে তাদের ২০-৩০ বছর আগের দিনকাল। পরিবারে ফিরে আসছে আর্থিক সচ্ছলতা। আগের চেয়ে ভালভাবে দিন কাটছে তাদের। সরাইলের বিলুপ্তপ্রায় মৃৎশিল্পও ফিরে পাচ্ছে হারানো যৌবন। রক্ষা হচ্ছে ইতিহাস। এর প্রভাব পড়বে গোটা সরাইলের মৃৎশিল্পীদের উপর। মেহেদী হাসান জানান, ক্রিয়েটিভ কর্নারের বয়স মাত্র দেড় মাস। ইতিমধ্যে ৩০-৩৫ হাজার টাকার সামগ্রী বিক্রি হয়েছে। চাহিদাও বাড়ছে নিয়মিত। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিমলা বালা পাল (৪৫), তানিয়া রানী পাল (১৫), চন্দনা পাল (৪০), শিল্পি রানী পাল, মিনু রানী পাল, স্মৃতি পাল ও সূচনা পালসহ আরো অনেকে বলেন, আগে মুড়িচিড়া খাইয়ে মাটি ফ্রি দিত। আর এখন এক নৌকা মাটির দাম ১০ হাজার টাকা। হাড় ভাঙা পরিশ্রম করে সামান্য লাভ হতো। নদী ভাঙার আতঙ্ক তো আছেই। মরতে বসেছিলাম। ইউএনও স্যার আমাদের জীবন বাঁচিয়েছেন। প্রশিক্ষণের পর সুন্দর জিনিস তৈরি করছি। অনেক টাকা কামাই করছি। খুবই ভালো আছি।
সরাইল উপজেলার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে ইসরাত বলেন, পুরাতন মডেলের নির্দিষ্ট কিছু সামগ্রী তৈরি করে অর্ধাহারে অনাহারে চলত পালপাড়ার মৃৎশিল্পীরা। তারপর মেঘনার অব্যাহত ভাঙনে তারা হয়ে পড়ে দিশাহারা। সেখানকার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে স্বাবলম্বী করা ও ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার লক্ষ্যেই পর্যায়ক্রমে ৫৫ জনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। তারা এখন সুনিপুণ দক্ষ কারিগর। তাদের উৎপাদিত সামগ্রীর বাজার তৈরি করতেই মেলা ও ক্রিয়েটিভ কর্নার করেছি। ভালো বিক্রি হচ্ছে। তাদের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ধারা অব্যাহত রাখলে বেঁচে যাবে এখানকার মৃৎশিল্প ও শিল্পীরা। আমার অবর্তমানে জনপ্রতিনিধিসহ সকলে মিলে সমাজে পিছিয়ে পড়া লোকদের জন্য করে যাবেন।  
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status