এক্সক্লুসিভ

গোলান হাইটসে কার স্বার্থ কী?

অনিম আরাফাত

১৮ জানুয়ারি ২০১৯, শুক্রবার, ৭:৩১ পূর্বাহ্ন

উনিশ শ’ সাতষট্টি সালের যুদ্ধে সিরিয়ার গোলান মালভূমি বা গোলান হাইটস দখল করে নিয়েছিল ইসরাইল। দখলকৃত সেই গোলান হাইটসে গত বছর ব্যাপক হামলা চালায় ইরান। এরপর সিরিয়ায় অবস্থিত প্রায় সকল ইরানি স্থাপনায় বিমান হামলা চালিয়ে হামলার জবাব দেয় ইসরাইল। ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে দ্বন্দ্ব বহুকালের। ইদানীং আরব রাষ্ট্রগুলোকে সঙ্গে নিয়ে ইরানকে মোকাবিলায় ইসরাইলের তৎপরতাও চোখে পড়ার মতো। কিন্তু দখলকৃত গোলান হাইটসে ইরানি হামলার এরকম কড়া জবাব সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, গোলান কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
ইসরাইল কিভাবে গোলান
হাইটস দখল করেছিল?
গোলান হাইটসের মোট আয়তন প্রায় ১৮০০ বর্গকিলোমিটার। এলাকাটি ইসরাইল ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত। যার বেশির ভাগই ইসরাইল দখল করে নিয়েছে। এর মধ্যে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোই ইসরাইলের দখলে। তবে ১৯৬৭ সালের জুন মাস পর্যন্ত গোলান ছিল সিরিয়ার অংশ। আরব-ইসরাইল ৬ দিনের যুদ্ধে ইসরাইলের কাছে গোলানের নিয়ন্ত্রণ হারায় সিরিয়া। সে বছর মিশর, জর্ডান ও সিরিয়া সম্মিলিতভাবে ইসরাইলে হামলা চালায় ও যুদ্ধ ঘোষণা করে। আরব-ইসরাইল অন্যান্য যুদ্ধের মতো এটিতেও আরবদের পরাজয় হয়। ৬ দিন ব্যাপী এ যুদ্ধ চলায় এটি ইতিহাসে ৬ দিনের যুদ্ধ নামেই পরিচিত। এ যুদ্ধেই সিরিয়া থেকে গোলান হাইটস দখল করে ইসরাইল, যা এখনো দখল করে রেখেছে দেশটি। একইসঙ্গে, মিশরও তার গুরুত্বপূর্ণ সিনাই উপদ্বীপ হারায় ইসরাইলের কাছে।
দখলের পরে নতুন সংকট
ইসরাইল গোলান দখল করে নিলেও প্রথম দিকে একে নিজের এলাকা বলে ঘোষণা করতে পারেনি। অপরদিকে সিরিয়া সবসময়ই নিজের হারানো এলাকা ফেরত পেতে তৎপর ছিল। কিন্তু ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণ থেকে ফিরিয়ে আনা সহজ কাজ ছিল না। পাশাপাশি মিশরও তার হারানো সিনাই উপদ্বীপ ফিরে পেতে নতুন নতুন প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। ১৯৭৩ সালে সিরিয়া ও মিশর দুদিক থেকে পুনরায় ইসরাইল আক্রমণ করে। সেদিন ইহুদিদের উপস থাকার দিন বা পবিত্র ইয়ম কিপুরের সময় চলায় একেই আদর্শ সময় ধরে নেয় দেশ দুটি। ইতিহাসে এটি ইয়ম কিপুরের যুদ্ধ নামে পরিচিত। ১৯৭৩ সালের ৬ থেকে ২৫শে অক্টোবরের মধ্যে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মিশরীয় ও সিরিয়ার সেনারা যুদ্ধবিরতি রেখা ভেদ করে সিনাই উপদ্বীপ ও গোলান মালভূমিতে ঢুকে পড়ে। প্রথম দিকে এ যুদ্ধে ব্যাপক সফলতা লাভ করে সিরিয়ার সেনারা। এ সময় যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে ও সোভিয়েত ইউনিয়ন মিশর-সিরিয়াকে সহায়তা করতে থাকে। কিন্তু তিন দিনের মধ্যেই ইসরায়েলিরা সিরিয়ার সেনাদের গোলান থেকে পিছু হটিয়ে দেয়। মিশরীয় সীমান্তেও সিনাই নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার পাশাপাশি কায়রোর আশেপাশেও হামলা চালায় ইসরাইল। ফলে সিনাই ও গোলান উভয়ই ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণে থেকে যায়।  ১৯৮১ সালে ইসরাইল গোলানকে নিজের অংশ বলে ঘোষণা দেয়। সামপ্রতিক কালেও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ গোলান হাইটস সবসময় ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণেই থাকবে। দখলের পর থেকেই গোলানে ইসরাইল বড় ধরনের সামরিক উপস্থিতি বজায় রেখেছে। ইতিমধ্যে সেখানে ৩০টি ইহুদি বসতি স্থাপন করা হয়েছে যেখানে প্রায় ২০,০০০ মানুষ বসবাস করছে।
ইসরাইলের এই দখল কি আন্তর্জাতিক আইনে বৈধ?
না, আন্তর্জাতিক মহল কখনোই ইসরাইলের এই দখল ও গোলানকে নিজের এলাকা দাবিকে স্বীকৃতি দেয়নি। একইসঙ্গে জাতিসংঘ সিনাই, গোলান ও পশ্চিম তীর থেকে ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহারের নির্দেশও দেয়। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ীও ইসরাইল চাইলেই সিরিয়ার একটি অংশ দখল করে রাখতে পারে না। কিন্তু ইসরাইল এসবের তোয়াক্কা করছে না। ২০১১ সালে শুরু হওয়া সিরিয়া যুদ্ধ শেষ দিকে থাকায় নতুন করে গোলান নিয়ে বোঝাপড়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু তখন গোলানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মহলকে কড়া বার্তা দেয়। ইসরাইল স্পষ্ট করে বলে দেয়, গোলানের নিয়ন্ত্রণ তারা ছাড়বে না।
গোলান কেন ইসরাইলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ?
ইসরাইল গোলান হাইটসের নিয়ন্ত্রণ রাখতে চায় মূলত দুটি কারণে। প্রথমত, ইহুদিবাদি এ রাষ্ট্রটি চায় তার নিয়ন্ত্রিত এলাকা বৃদ্ধি করতে। অপর কারণটি হচ্ছে, সিরিয়ার বিরুদ্ধে একটি বাফার জোন প্রতিষ্ঠা। গোলান হাইটস সমতল থেকে বেশ উঁচু হওয়ায় এখান থেকে সিরিয়ার অভ্যন্তরে নজরদারি করতে সুবিধা পায় ইসরাইল। যেকোনো যুদ্ধে এরকম স্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ  ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়া ইসরাইল নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে অভিনব একটি পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের অস্তিত্ব কোনো আরব রাষ্ট্রই সহজে মেনে নিতে পারেনি। তারা বারবার ইসরাইল আক্রমণ করেছে। কিন্তু বেশ কয়েকবার দেশগুলো ইসরাইলের কাছে নিজের এলাকা হারিয়েছে। এ সুযোগ হাতছাড়া না করে ইসরাইল নিজের স্বীকৃতি আদায়ের শর্তে সেসব অঞ্চল ফিরিয়েও দিয়েছে। ইসরাইলের এই পদ্ধতি ‘ল্যান্ড ফর পিস’ নামে পরিচিত। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠার এ পদ্ধতি আরব-ইসরাইল সম্পর্কের শুরুতেও অবদান রেখেছে। ১৯৭৯ সালে সিনাই ফেরত পাবার জন্য মিশর-ইসরাইল শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৮২ সালের পর ইসরাইল পুরোপুরি সিনাই উপদ্বীপ মিশরকে ফিরিয়ে দেয়। ইসরাইল হয়ত গোলান মালভূমি নিয়েও এরকম আরেকটি শান্তি চুক্তির আশা করছে। প্রতিবেশী আরব দেশগুলোকে কাছে টানতে এবং নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে ইসরাইলের এই চিন্তা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
গোলান নিয়ে ইরানের কি স্বার্থ?
সিরিয়া যুদ্ধে ইরানের যুক্ত হওয়ার পর থেকে দেশটিকে ইসরাইল তার জন্য হুমকি মনে করছে। গোলান হাইটসে ইরান হামলাও চালিয়েছে। সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদকে সাহায্য করতে এসেছে ইরান এটি সত্যি হলেও গোলানে ইরানের তেমন কোনো স্বার্থ থাকার কথা না। তারপরেও গোলান নিয়ে ইরানি তৎপরতার কারণ কি! সত্যিটা হচ্ছে, সেখানে দেশটির বিনিয়োগ যতটা না বাস্তবিক তার থেকে বেশি প্রতীকী। ইরান বোঝাতে চায় সে ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। কিন্তু ইরান সত্যিকার অর্থে ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধে আগ্রহী নয়। দেশটির কাছে যুদ্ধের থেকে যুদ্ধ যুদ্ধ অবস্থাটা সৃষ্টি করাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর গোলান ইস্যু নিয়ে ইরান সেই কাজটিই করে চলেছে। পাশাপাশি, নিজে সরাসরি যুক্ত না হয়ে লেবাননের হেজবুল্লাহকে ইসরাইলে হামলায় মদত দিচ্ছে ইরান। এ থেকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান দেখাতে চায় ইরান। কিন্তু একইসঙ্গে ইসরাইলের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধের ঝুঁকিও এরিয়ে চলছে দেশটি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status