বাংলারজমিন

রংপুরে শতকোটি টাকার মধু উৎপাদনের সম্ভাবনা

জাভেদ ইকবাল, রংপুর থেকে

১৪ জানুয়ারি ২০১৯, সোমবার, ৭:৪৭ পূর্বাহ্ন

রংপুর বিভাগের ৫ জেলায় সরিষা ক্ষেত এবং লিচু বাগানে পরিকল্পিতভাবে মৌমাছির চাষ করা হলে মধু উৎপাদনের মাধ্যমে বছরে শতকোটি টাকা আয়ের অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন হবে বলে কৃষি বিশেষজ্ঞগণ অভিমত পোষণ করেছেন। এর ফলে একদিকে বিপুলসংখ্যক বেকার পুরুষ ও নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। পাশাপাশি চাষির বাড়তি আয়ের সাথী ফসল হিসেবে নতুন সম্ভাবনাময় পণ্য হিসেবে তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিশাল এক সহায়ক শক্তির সৃষ্টি হবে। কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, রংপুর অঞ্চলের রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট এবং নীলফামারী জেলায় বিপুল পরিমাণ লিচু বাগান এবং বিস্তীর্ণ সরিষা ক্ষেতে মৌমাছির চাষ করে প্রতি বছর শতকোটি টাকা মূল্যের মধু উৎপন্ন করার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। ইতিমধ্যে কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের কারিগরি সহযোগিতায় গত কয়েক বছর ধরে এসব জেলায় বিভিন্ন সরিষা ক্ষেত এবং লিচু বাগানে মৌমাছির চাষ করার পাশাপাশি চাষিরা সাথী ফসল হিসেবে বাড়তি আয়ের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে এই কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের মৌমাছি চাষ সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ জনান, প্রতিটি মৌবক্সে প্রতি মওসুমে ন্যূনতম ৪ থেকে ৫ কেজি করে মধু পাওয়া যায়। এছাড়া মৌচাষের প্রকল্পভুক্ত সরিষা ক্ষেতের ফলনও অন্তত ২০ ভাগ বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি ওই এলাকায় বিভিন্ন ফলের গাছের মুকুল এবং ফসলের ক্ষেতে মৌমাছির ব্যাপক সমাগমের মাধ্যমে প্রচুর পরাগায়নের সৃষ্টি হয়। এ কারণে ওইসব ফলের বাগান এবং ক্ষেতের ফলনও কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়। এই কর্মসূচির আওতায় গত অর্থ বছরে এসব জেলার বিভিন্ন সরিষা ক্ষেতে ৫ হাজারের বেশি মৌ বক্স স্থাপনের লক্ষ্যমাত্রা ধরে এই অঞ্চলে ৩ হাজার ৩১৪টি মৌমাছির বক্স স্থাপন কারা হয়েছে। এর মাধ্যমে চাষিরা সাথী ফসল হিসেবে বাড়তি আয়ের সুযোগ তৈরি করতে পেরে অর্থনৈতিকভাবে প্রচুর লাভবান হয়েছে। এই কর্মসূচির আওতায় কুড়িগ্রাম এবং গাইবান্ধা জেলায় সবচেয়ে বেশি সাফল্য অর্জন হয়েছে বলে জানা গেছে। কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রংপুর বিভাগের রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট এবং নীলফামারী এই ৫ জেলায় গত রবি মৌসুমে প্রায় ৩২ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ করা হয়। এসব সরিষা ক্ষেতের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার হেক্টর জমিতে মধু উৎপন্নের লক্ষ্যমাত্রা  নিয়ে ৫ হাজার  ৫৫টি মৌমাছির বক্স স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তবে গোটা মওসুম জুরে এসব সরিষা ক্ষেতে ৩ হাজার ৩১৪টি মৌ বক্স স্থাপন করে গত মৌসুমে ৫৫ হাজার ২০০ কেজির বেশি পরিমাণ মধু উৎপন্ন হয়েছে বলে  সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। তবে চাষকৃত সকল সরিষা ক্ষেত মৌচাষ প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হলে কেবল এসব সরিষা ক্ষেত থেকেই প্রতি মৌসুমে অন্তত ৪ লাখ কেজির বেশি মধু উৎপন্নের মাধ্যমে প্রায় ২০ কোটি টাকা আয় করা সম্ভব হতো। এছাড়া এই অঞ্চলের লিচু বাগানের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে মৌমাছির চাষ করে আরও অন্তত ২০ থেকে ২৫ লাখ কেজি মধু উৎপন্ন করা সম্ভব হবে। এর মাধ্যমে প্রায় শতকোটি টাকা মূল্যের মধু উৎপন্নের অপার সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এসব উৎপাদিত মধু দেশের স্থানীয় বাজারের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে একদিকে যেমন বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। অপর দিকে পশ্চাৎপদ এবং  অবহেলিত এই অঞ্চলের বিপুলসংখ্যক বেকার যুবকের কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত সৃষ্টি হবে। পাশাপাশি দক্ষ জনশক্তির এক অপার ভাণ্ডারও তৈরি হবে। প্রাপ্ত সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থ বছরের গত মৌসুমে রংপুর জেলায় সরিষা চাষ করা হয়েছে ৭ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে ১০৬ হেক্টর জমির সরিষা ক্ষেতে ৯৮টি মৌ বক্স স্থাপন করে ২০৫ কেজি এবং জেলার ৪৬৪ হেক্টর জমিতিে চাষকৃত লিচু বাগানের মধ্যে ৪৫ হেক্টরে ৭২৫টি মৌ বক্স স্থাপন করে ৯ হাজার ৭১০ কেজি মধু উৎপন্ন হয়েছে। কুড়িগ্রাম জেলায় ১২ হাজার ৮৫৩ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩ হাজার ৪৬৯ হেক্টর সরিষা ক্ষেতে ২ হাজার ৪০১টি মৌ বক্স স্থাপন করে ৫২ হাজার ৭৪০ কেজি। গাইবান্ধা জেলায় ৬ হাজার ৯৯০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬৫০ হেক্টর সরিষা ক্ষেতে ৬০৩টি মৌ বক্স স্থাপন করে ২ হাজার ৫০ কেজি। নীলফামারী জেলায় ৪ হাজার ১৩০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ করা হয়েছে। এর মধে ১৩১ হেক্টর সরিষা ক্ষেতে ৩৯টি মৌ বক্স স্থাপন করে ১৫৫ কেজি। লালমনিরহাট জেলায় ১ হাজার ৭৯৫ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৫ হেক্টর সরিষা ক্ষেতে ২০৫টি মৌ বক্স স্থাপন করে ৮৫ কেজি মধু উৎপন্ন হয়েছে। মৌমাছি চাষে কৃষকদের সহায়তার জন্য কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর প্রয়োজনীয় কারিগরি সহায়তা প্রদান করছে। মৌমাছি চাষের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট এলাকার চাষিরা সাথী ফসল হিসেবে বাড়তি আয়ের সুযোগ পেয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে নতুন কর্মসংস্থানের। সীমিত পর্যায়ে মৌমাছি চাষে সাফল্য অর্জিত হওয়ায় রংপুর বিভাগের ৫ জেলায় গত রবি মৌসুমে প্রায় পৌনে ৩ কোটির বেশি টাকা মূল্যের ৫৫ হাজার কেজিরও বেশি মধু উৎপন্ন হয়েছে। কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর রংপুরের উপপরিচালক ডক্টর মোহাম্মদ সরওয়ারুল হক জানান, রংপুর অঞ্চলে লিচু এবং সরিষা ক্ষেতে মৌচাষ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মৌচাষ ইতিবাচক প্রভাব হিসেবে ব্যাপক সাফল্যের কাজ করছে। ফলে চাষিরাও এতে ক্রমান্বয়ে উৎসাহিত হচ্ছে। বিশেষ করে নদী তীরবর্তী চড় এলাকা সহ বির্স্তীন সরিষার ফসলের মাঠে মৌচাষে চাষিরা উৎসাহিত হয়ে তা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে দক্ষ মৌয়ালের অভাবে অনেকেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে মৌচাষে এগিয়ে আসতে পারছে না বলে তিনি জানান। দেশের উত্তরাঞ্চলের সিরাজগঞ্জ এবং বগুড়ার কিছু এলাকায় দক্ষ মৌয়াল আছে তারাই প্রত্যেক মৌসুমে এসে সীমিত পর্যায়ে এই এলাকায় মৌয়ালের দায়িত্ব পালন করে থাকে। সিরাজগঞ্জের মৌসুমি মৌয়াল চান মিয়া জানান, প্রত্যেক গ্রীষ্ম মৌসুমে তারা এই অঞ্চলে মধু সংগ্রহের জন্য আসেন। সাধারণত এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে মধু সংগ্রহ শুরু হয়। মৌয়ালরা অভিযোগ করে জানান, আমাদের দেশে লিচু বাগানে মৌচাষ বা মধু সংগ্রহের জন্য কোনো নিয়ম শৃঙ্খলা নেই। বাজারজাত করার ব্যাপারেও কোনো পরিকল্পিত উদ্যোগ নেই। এ ব্যাপারে সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে কেবল মৌচাষ করেই রংপুর অঞ্চলের চাষিরা আর্থ-সামাজিক উন্নয়নসহ স্বাবলম্বী হতে পারবে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status