বিশ্বজমিন

ছোট্ট মেয়ে জ্যাকেলিন....

মানবজমিন ডেস্ক

১৭ ডিসেম্বর ২০১৮, সোমবার, ৮:৩৫ পূর্বাহ্ন

সাত বছর বয়সী ছটফটে জ্যাকেলিন আমেই কাল ম্যাকুইন। ধুলো-কাদায় ভরা আর নারকেল গাছে ঘেরা গুয়াতেমালার প্রত্যন্ত ছোট্ট গ্রাম সান অ্যান্টোনিও সেকোর্টেজে তার বেড়ে ওঠা। কয়েক সপ্তাহ আগে পিতার কাছ থেকে জীবনের প্রথম জুতা উপহার পেয়েছে সে। তখনই তার বাবা জানায়, তারা হাজার মাইল দূরের দেশ যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমাবে। উন্নত দেশে উন্নত জীবনের আশায় বেশ খুশিতেই কাটছিল জ্যাকেলিনের দিন। কিন্তু এ খুশি দীর্ঘস্থায়ী হয় নি তার জীবনে। যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে পড়ালেখা শেখা কিংবা জীবনে প্রথমবারের মতো খেলনা নিয়ে খেলা করার বদলে মার্কিন সীমান্তরক্ষীদের হেফাজতে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে তাকে। তার মৃত্যুতে টনক নড়েছে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষের। মধ্য আমেরিকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর জন্য অভিবাসীরা যে বিপদসংকুল দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়, শিশুটির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তা আবার সকলের নজরে এসেছে। আলোচনায় এসেছে নিরাপত্তারক্ষীরা আশ্রয়প্রার্থী অভিবাসীদের সঙ্গে কি ধরণের ব্যবহার করে তাও। জ্যাকেলিনের পরিবার জানিয়েছে, তার বাবা সীমান্ত পাড় করে দেবার জন্য এক মানব পাচারকারীকে টাকা দেয়।

যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে আশ্রয়প্রার্থণা করা তাদের পরিকল্পনা ছিল না। খড়ের ছাউনি দেয়া, নোংরা মেঝের ছোট কাঠের ঘরে বসে এ কথা জানাচ্ছিল তার পরিবার। এ ঘরেই জ্যাকেলিনের বেড়ে ওঠা। বাবা-মা ও তিন ভাই-বোন মিলে সেখানেই ঘুমাতো তারা। কয়েকটি বিছানার চাদর ও একটি রান্নার জায়গা ছাড়া উল্লেখযোগ্য কিছুই নেই সে ঘরে। তার ভাইয়েদের পরণে জীর্ণ পোশাক, কাদামাখা খালি পা। জ্যাকেলিনের দাদা ডোমিংগো কাল জানান, শস্য ও শিম চাষ করে তার পরিবার প্রতিদিন ৫ ডলার রোজগার করত। কিন্তু পুরো পরিবারের খরচ চালানোর জন্য এ অর্থ যথেষ্ট ছিল না। তাই জ্যাকেলিনের বাবা নেরি কাল তার প্রিয় সন্তান জ্যাকেলিনকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নেন। যাতে সেখান থেকে পরিবারের জন্য অর্থ পাঠাতে পারেন। এই যাত্রার কথা শুনে ছোট্ট জ্যাকেলিনও আনন্দে নেচে উঠেছিল। নেরি প্রায়ই জ্যাকেলিনকে নিয়ে নদীতে মাছ ধরতে যেতেন। এই হাজার হাজার মাইল দূরের পথ পাড়ি দেয়া তাদের জন্য আরো বেশি রোমাঞ্চকর হতে পারতো। কিন্তু ভাগ্য বিমুখ ছিল।

ক্লাউডিয়া ম্যাকুইন জ্যাকেলিনের মা। দুঃখভারাক্রান্ত  অবস্থায় জ্যাকেলিনের জীবনের কথা বলতে থাকেন তিনি। ছোট্ট জ্যাকেলিন গাছে উঠতে ভালোবাসত। আমাদের গ্রামের ১৩টি পরিবার যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি বানিয়ে অবস্থান করছে। যখন আমাদের এলাকার কেউ এ কাজে সক্ষম হত, তখন এলাকার মানুষ বাজি পুড়িয়ে সেই খুশি উদযাপন করত। আমাদের বিশ্বাস ছিল জ্যাকেলিন ও নেরিও যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে সফল হবে। পরিবারের দুর্দশা দূর করতে নেরি মরিয়া ছিল- আবারো বলতে থাকে জ্যাকেলিনের দাদা। যুক্তরাষ্ট্রে যাবার জন্য নেরি জমি বন্দক রেখে টাকা ধার নেয়।

টেক্সাসে অবস্থানকারী গুয়েতামালার রাষ্ট্রদূত তেকান্দি পানিয়াগুয়া বার্তা সংস্থা এপি কে জানান, নেরি কাল ও তার মেয়ে সাত দিন যাত্রা শেষে যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তে পৌঁছায়। শুক্রবার নেরি আমাকে জানিয়েছে, ৬ই ডিসেম্বর সীমান্তের কিছুটা আগে তাদেরকে নামিয়ে দেয়া হয়। সেখান থেকে দেড় ঘন্টার পথ হেঁটে তারা অ্যান্টেলোপ সীমান্তে পৌঁছায়। সীমান্তে পৌঁছানোর পর পরই অভিবাসীদের বড় একটি দলের সঙ্গে নেরি ও জ্যাকেলিনকে আটক করা হয়। তিনি আরো বলেন, নেরি আরো জানিয়েছে আটক অবস্থায় তার মেয়েকে পর্যাপ্ত খাবার ও পানি দেয়া হয়েছে। তাদের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে তা নিয়ে নেরির কোনো অভিযোগ নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের কাস্টমস এবং সীমান্তরক্ষী বাহিনী জানায়, মেয়েটিকে প্রাথমিকভাবে সুস্থই দেখাচ্ছিল। তার মধ্যে অসুস্থতার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না। তার বাবা ¯প্যানিশ ভাষা কথা বলেছিল এবং তার মেয়ে সুস্থ সে বিষয়ক একটি ফরমে স্বাক্ষর করেছিল। জ্যাকেলিনের অসুস্থ হবার মুহুর্তের ঘটনা জানান তার বাবা নেরি। তিনি বলেন, বাসে থাকাকালীন জ্যাকেলিন বমি করতে শুরু করে। একইসঙ্গে, তার শরীরের তাপ বাড়তে থাকে। তার অসুস্থতার কথা আমি চালককে জানাই। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মেয়েটির অসুস্থতার কথা জেনে এজেন্টরা জরুরি চিকিৎসাসেবা দানকারী দলের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ৯০ মিনিট পর তারা যখন পৌঁছায়, তখন মেয়েটি শ্বাস নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। চিকিৎসক দলটি তাকে ওই অবস্থা থেকে মেয়েটিকে পুনরুজ্জীবিত করে। তাকে বিমানে করে টেক্সাসের এল পাসো হাসপাতালে নেয়া হয়। উনিশ ঘন্টা পর ৮ই ডিসেম্বর স্থানীয় সময় সাড়ে ১২টার দিকে মেয়েটির মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে তার ব্রেণ ও লিভার অকার্যকর হয়ে পরেছিল। তার মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হতে ময়নাতদন্ত  করা হয়েছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পেতে এক সপ্তাহ লেগে যেতে পারে।

জ্যাকেলিনের মৃত্যুর ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের নিন্ম কক্ষের সদস্যরা প্রশ্ন তুলেছেন। এ ঘটনায় আরো কিছু করা যেতে পারত কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা। সেখানে ১৬৩ জন অভিবাসীর জন্য মাত্র চারজন এজেন্ট কর্মরত ছিলেন। একটি বাসে করেই তাদের সবাইকে ৯৪ মাইল দূরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। ইতিমধ্যে, জ্যাকেলিনের মৃত্যুর ঘটনায় দ্যা হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টের ইন্সপেক্টর জেনারেল একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status