এক্সক্লুসিভ

১৮ মাসের শিশুটিরও রেহাই মেলেনি

মিসবাহুল হক

১৬ ডিসেম্বর ২০১৮, রবিবার, ৮:৩১ পূর্বাহ্ন

হিবা নাসিরের বয়স মাত্র ১৮ মাস। ঠিকমতো কথা বলা শেখেনি এখনো। বিশ্বজগতের দ্বন্দ্ব-সংঘাত কোনো কিছুই বুঝার মতো পরিপক্বতাও আসেনি। কিন্তু কলহপূর্ণ এই পৃথিবীতে জন্ম নেয়াই যেন তার কাল হয়েছে। সভ্য সমাজের আর দশটি শিশুর মতো খেলনা নিয়ে সময় কাটানোর পরিবর্তে তাকে এখন চোখে অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। জগতের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় মায়ের কোলে থাকা অবস্থাতেই ঘাতক পেলেট আঘাত হেনেছে তার চোখে। পেলেট হলো বিশেষ ধরনের গুলি যাতে সাধারণত আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তির প্রাণহানি হয় না, কিন্তু আক্রান্ত জায়গা ছিদ্র হয়ে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়। ১৮ মাসের শিশু হিবার চোখে আঘাত হেনেছে এমনই একটি পেলেট। ভাগ্য সহায় না হলে হিবার পেলেট আক্রান্ত চোখ হয়তো চিরতরে দৃষ্টি ক্ষমতা হারাবে। এটি ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের সোপিয়ান জেলার কাপরান গ্রামের ঘটনা। এই অঞ্চলটিতে প্রায়ই বিদ্রোহী মুসলিমদের সঙ্গে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘাত বাধে। ২৩শে নভেম্বর এমনই এক সংঘাতের সময় হিবা বাড়ির ভেতরে মা মুরসালা জানের কোলে খেলা করছিল। কিন্তু কলহপূর্ণ বিশ্বজগৎ তার এই আনন্দপূর্ণ সময় কাটানো যেন মেনে নিতে পারেনি। অকস্মাৎ এক পেলেট তার চোখে আঘাত হেনে বিদ্বেষপূর্ণ পৃথিবীর প্রকৃতি বুঝিয়ে দিয়েছে। এখন চোখে তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে দিন কাটে তার। সঙ্গে রয়েছে পুরোপুরি দৃষ্টি হারানোর শঙ্কা। এ অবস্থাতেই কখনো কখনো বাড়ির আঙিনায় প্রিয় তিন চাকার সাইকেলে চড়তে উদ্যমী হয়ে ওঠে সে। কিন্তু বাইরের ধুলাবালি চোখে প্রবেশ করলে ইনফেকশনে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় হিবাকে বাইরে যেতে দেন না মা মুরসালা জান। তার আধো আধো কথা বলা আগের চেয়ে এখন অনেকটাই কমে গেছে। চোখে যন্ত্রণা বাড়লে মাঝে মাঝে হাত দিয়ে ব্যথার জায়গা দেখিয়ে দেয় সে। ডাক্তার বলেছে, সে ডান চোখের দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরিভাবে হারাতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কাশ্মীরে ৬ হাজারেরও বেশি মানুষ পেলেটের আঘাতে আংশিক বা পুরোপুরিভাবে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। রাজনৈতিকভাবে অস্থির এই অঞ্চলে বিক্ষোভ দমাতে নিরাপত্তা বাহিনী শটগান দিয়ে এই পেলেট নিক্ষেপ করে। আর এর সর্বশেষ ও সবচেয়ে কম বয়সী শিকার হয়েছে শিশু হিবা নাসির। নিষ্পাপ এই শিশুর চোখে পেলেট আঘাত হানার ঘটনা ব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছে। এমনকি বিক্ষোভ দমাতে নিরাপত্তা বাহিনীর পেলেট ব্যবহার নিয়েও বিতর্ক উঠেছে। হিবার মা মুরসালা জান আল জাজিরাকে বলেন, বাইরে প্রচুর টিয়ার গ্যাস মারা হচ্ছিল। এর তীব্রতায় বাড়ির মধ্যে থাকার পরেও আমাদের দম বন্ধ হয়ে আসছিল। শিশুরা শ্বাসকষ্টে ভুগছিল। অনেকে বমিও করতে শুরু করেছিল। আতঙ্কিত হয়ে শিশুরা বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু মুরসালা জান তার শিশুদের ঘরের ভেতরেই আটকে রাখেন। তিনি বলেন, বমি করতে করতে তাদের চোখ লাল হয়ে উঠেছিল।
এটা দেখে আমি ঘরের দরজা খুলে তাদেরকে বারান্দায় নিয়ে আসি। এমন অবস্থায় পেলেট ছোড়া দেখে আমি আমার ছেলেকে ঘরের ভেতরে পাঠিয়ে দিই। কিন্তু সে পড়ে যায়। আরেক হাত দিয়ে আমি হিবাকে রক্ষা করার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু এর মধ্যেই ঘাতক পেলেট তার নিষ্পাপ মুখকে রক্তাক্ত করে দেয়। বাইরে গিয়ে আমি চিৎকার করতে থাকি। বাইরে একদল যুবক রক্তাক্ত হিবাকে দেখে তাকে মোটরসাইকেলে করে পাশের জেলার হাসপাতালে নিয়ে যায়। খানিক বাদে আমি হাসপাতালে পৌঁছাই। হিবার চোখের জখম গুরুতর হওয়ায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে প্রধান শহর শ্রীনগরে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। এদিন কাপরান গ্রামে বিদ্রোহীদের সঙ্গে ভারতীয় বাহিনীর বন্দুকযুদ্ধে ছয় বিদ্রোহীসহ এক বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়। এই সংঘর্ষস্থলের ঠিক পাশেই হিবার বাড়ি। মুরসালা জান বলেন, হিবার জীবনের ওপর যে অন্ধকার নেমে এসেছে তার মেয়ের এখনো এটা বোঝার মতো বয়স হয়নি। এমনকি ঠিক কোথায় আঘাত লেগেছে তাও নির্দিষ্টভাবে বলতে পারছে না। শুধু আঙুল দিয়ে চোখের দিকে ইঙ্গিত করছে। একবারের জন্যও সে চোখ বন্ধ করেনি। সম্ভবত চোখ বন্ধ করলে সে অনেক বেশি ব্যথা অনুভব করছে। আহত হওয়ার পর থেকে সে এখনো ভালোমতো ঘুমাতে পারেনি। কয়েকদিনে
তার উচ্চারিত শব্দ হলো- বিস্কুট, মামা ও চোখ।  তিনি বলেন, তার চোখের পরিবর্তে আমাকে আঘাত করলেও এতটা কষ্ট লাগতো না। ছোট্ট এই মেয়ের দুর্ভোগ আমার সব সুখ ছিনিয়ে নিয়েছে। আমি জানি না তার ভবিষ্যৎ কেমন হবে। পুরোপুরি দৃষ্টিশক্তি ফিরে না পেলে এই অক্ষমতা নিয়ে সে কিভাবে জীবন কাটাবে? কেউই এই বিষয়ে ভাবে না। আরো হাজারো মানুষ পেলেটের আঘাতে চোখের আলো হারিয়েছে। এর মধ্যে আমার মেয়ে একটি সংখ্যা মাত্র। একজন মায়ের জন্য এর চেয়ে বেশি যন্ত্রণাদায়ক আর কি হতে পারে। আমি জানি সে তার অসহনীয় ব্যথা অনুভব করছে। কিন্তু সে এটা বোঝাতে পারছে না। হিবার আগে তার চাচাতো বোন ইশা মুশতাকও পেলেটে আক্রান্ত হয়েছিল। ২০১৬ সালের সংঘাতে সে পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যায়। হিবার মা আরো বলেন, তার মেয়েকে যখন প্রথমবারের মতো চোখের সার্জারি করতে নেয়া হচ্ছিল, সেখানে আরো কয়েক ডজন পেলেটে আঘাতপ্রাপ্ত রোগী ছিল। দ্রুতই হিবার চোখে দ্বিতীয়বারের মতো সার্জারি করা হবে। তখনই জানা যাবে, ওই চোখে আদৌ দৃষ্টিশক্তি ফিরবে কিনা। মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যশনাল বলছে, যেসব অস্ত্র এ ধরনের
জখম করে, তা বিপজ্জনক। এতে বল প্রয়োগের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড লঙ্ঘিত হয়। কর্তৃপক্ষের দাবি, শটগানের এসব পেলেট প্রাণঘাতী না। কিন্তু এর ব্যবহারের কারণে নিহত ও জখমের ধরন দেখেই বোঝা যায় যে, এটা কতটা বিপজ্জনক। ২০১০ সালে কাশ্মীরের সংঘাতপ্রবণ অঞ্চলে এই অস্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়। অ্যামনেস্টির হিসাব অনুসারে, ছয় বছরের পেলেটের আঘাতে অন্তত ১৪ জন নিহত হয়েছে। দৃষ্টি শক্তি হারিয়েছে শ’ শ’ মানুষ। শ্রী মহারাজা হরি সিং হাসপাতালের চিকিৎসক সালিম তাক বলেন, পেলেট যখন চোখে আঘাত হানে তখন সেখানে ছিদ্রের তৈরি হয়। হিবার সঙ্গেও এমনটি ঘটেছে। তার চোখের মধ্যে এখনো একটি পেলেট রয়ে গেছে। এতে তার দৃষ্টিশক্তি হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা চোখ হলো একটি স্পর্শকাতার ‘ওয়াটার বল’ এর মতো। সবসময়ই এটা ঝুঁকির মধ্যে থাকে। তার চোখে এক দফা সার্জারি করা হয়েছে। আরো কয়েকটি সার্জারি করতে হবে। সম্ভবত আমাদের চিকিৎসা নেয়া সবচেয়ে কম বয়সী পেলেট আক্রান্ত রোগী সে। পেলেট আক্রান্তদের একটি সংগঠনের প্রধান মুহাম্মদ আশরাফ ওয়ানিও নিশ্চিত করেছেন, এখন পর্যন্ত হিবাই সবচেয়ে কম বয়সী পেলেট আক্রান্ত মানুষ।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status