দেশ বিদেশ

উইঘুর মুসলিম নির্মূল করতে তৎপর চীনা সরকার

মিসবাহুল হক

৬ ডিসেম্বর ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:০২ পূর্বাহ্ন

দরজায় কড়া নাড়ার শঙ্কা নিয়ে প্রতি রাতে ঘুমাতে যান আবদুল্লাহ। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে যা ঘটেছে, তা থেকে আবদুল্লাহর মনে এই শঙ্কা ঢুকেছে। এমনকি রাতের দুঃস্বপ্নেও তিনি দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পান। তার আশঙ্কা, যেকোনো মুহূর্তে তার দরজার কড়াও নড়ে উঠতে পারে। জাতিগতভাবে আবদুল্লাহ উইঘুর সম্প্রদায়ের মানুষ। তিনি চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের অধিবাসী। শত বছর ধরে তার পূর্বপুরুষরা এই ভূখণ্ডে বসবাস করেছেন। এখানেই তারা সংগ্রাম করে জীবন কাটিয়েছেন। দুই সন্তানের বাবা আবদুল্লাহ একজন একনিষ্ঠ মুসলিম। কিন্তু তাকে এখন কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে প্রতিদিন পাঁচ বেলা নামাজ আদায় করতে হয়। গত কয়েক মাসে তার কয়েকজন বন্ধু ও সহকর্মী রাতের অন্ধকারে তাদের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনেছেন এবং কোনো ধরনের সতর্কবার্তা ছাড়াই গুম হয়েছেন। আবদুল্লাহসহ জিনজিয়াংয়ের সবাই জানেন গুম হওয়া ব্যক্তিদের কোথায় নেয়া হয়েছে। কিন্তু কেউই এটা জানেন না যে, তাদের ঠিক কতদিন আটকে রাখা হবে বা আদৌ মুক্তি দেয়া হবে কিনা? এভাবে গুম হওয়ার পরেও যারা ফিরে এসেছেন, তাদের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা গেছে।
গত আগস্টে জাতিসংঘের মানবাধিকার প্যানেল এক রিপোর্টে বলেছে, জিনজিয়াংয়ে প্রায় ১১ লাখ উইঘুর মুসলিমকে বন্দিশিবিরে আটকে রাখা হয়েছে। এই অঞ্চলে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ উইঘুর মুসলিমের বসবাস। জাতিসংঘের জাতিগত বৈষম্য নিরোধ বিষয়ক কমিটির শীর্ষ কর্মকর্তা গে ম্যাকডোগাল দাবি করেন, সেখানকার বন্দিশিবিরে আটক উইঘুর মুসলিমের সংখ্যা ২০ লাখও হতে পারে। এ ছাড়া, সেখানে উইঘুর মুসলিমদের বন্দি করার ঘটনা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। উইঘুর ও মুসলিম হওয়া ছাড়া তাদের বন্দি হওয়ার পেছনে আর কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। জাতিসংঘ জিনজিয়াংয়ের বন্দিশিবিরের তথ্য প্রকাশ করার পরপরই মার্কিন ম্যাগাজিন দ্য আটলান্টিকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সেখানে বন্দিদের ইসলাম ত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে। পূর্বপূরুষের মুসলিম বিশ্বাসের নিন্দা করতে বন্দিদের ওপর জবরদস্তি করা হচ্ছে। একই সঙ্গে তাদের দিয়ে প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা করে কম্যুনিস্ট পার্টির প্রচারণামূলক সংগীত গাওয়ানো হচ্ছে। পুরুষ বন্দিদের দাড়ি কাটতে বাধ্য করা হচ্ছে। ইসলামে নিষেধ থাকার পরেও বন্দিশিবিরে উইঘুর মুসলিমদের জোর করে মদ ও শূকরের মাংস খাওয়ানো হচ্ছে। বন্দিশিবিরে উইঘুর মুসলিমদের মধ্যে পরিবর্তন এনে কম্যুনিস্ট মতাদর্শ অনুসারে সৃষ্টিকর্তায় অবিশ্বাসী অনুগত চীনা নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। আর এজন্য শারীরিক নির্যাতন, মানসিক ভীতিপ্রদর্শন ও হয়রানির মাধ্যমে উইঘুর মুসলিমদের ধর্মত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামকে মানসিক ব্যাধি বলে মনে করে চীন। পাশাপাশি দেশটি ইসলামী ভাবধারায় গড়ে ওঠা উইঘুর সংস্কৃতিকে প্রত্যাখ্যান করে।
যাই হোক, জিনজিয়াংয়ে শুধু প্রাপ্তবয়স্কদের মগজ ধোলাই করে কম্যুনিস্ট আদর্শের শিক্ষা দেয়া হচ্ছে বিষয়টি এমন না। বাবা-মা’র কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে উইঘুর শিশুদের এতিমখানায় রেখে রাষ্ট্রীয়ভাবে দেখভাল করছে সরকার। সেখানে তাদেরকে শিক্ষিত করে তোলা হয়। আর এ শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে উইঘুর শিশুদের সুপরিকল্পিতভাবে ইসলামী বিশ্বাস ও উইঘুর সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। স্কুলের মতো গড়ে ওঠা এসব এতিমখানায় চীন উইঘুর মুসলিম শিশুদের ভবিষ্যৎ পরিবর্তন করে দিচ্ছে। তাদেরকে কম্যুনিস্ট মতাদর্শ অনুসারে নাস্তিক্যবাদ ও হান সংস্কৃতিতে গড়ে ওঠা সরকারের বিশ্বস্ত নাগরিকে পরিণত করা হচ্ছে। পরিপূর্ণ মগজ ধোলাইয়ের পর তাদেরকে পরিবারে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। সেখানে তারা উইঘুর মুসলিমদের ধ্বংস করতে বেইজিংয়ের  কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। কেননা, এই উইঘুর জনগোষ্ঠীকে চীন জাতীয় স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করে। জাতিসংঘ উইঘুর মুসলিমদের ধ্বংস করার চীনা পরিকল্পনা ও বন্দিশিবিরের খবর দেয়ার পর তিন মাস অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু উইঘুর নির্মূলে চীনা তৎপরতার তীব্রতার তুলনায় বৈশ্বিক উদ্বেগ ও রাজনৈতিক চাপ খুবই কম। কিন্তু কেন এমনটি হচ্ছে? বর্তমান অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এর উত্তর পাওয়া যায়। উইঘুরদের ওপর চীনের নির্মূল অভিযানকে চ্যালেঞ্জ করলে বা চীনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে সংশ্লিষ্ট দেশের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কেননা, বর্তমানে চীন হলো বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম পরাশক্তি। বেশিরভাগ দেশ বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে চীনের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। অর্থনৈতিক বিভিন্ন কারণে আন্তর্জাতিক  মহলের উইঘুর সংকটে হস্তক্ষেপ না করার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত ‘ওয়ার অন টেররের’ সম্পর্ক রয়েছে। কেননা, যুক্তরাষ্ট্রের এই অভিযানে চীনসহ অন্যদেশগুলোও অনুপ্রাণিত হয়। তারা এতে যোগ দিয়ে মুসলিমদের ওপর দমন-পীড়ন বাড়িয়ে দেয়। ৯/১১-এর পর সন্ত্রাস দমনের নামে চীন উইঘুর মুসলিমদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দেয়। বর্তমানে মিয়ানমার ও ফ্রান্সের মতো দেশগুলোও বর্ণবাদী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ইসলাম-বিদ্বেষকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। চীন শুধু এই প্রক্রিয়ায় যুক্তই হয় নি, বরং অভিযান অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে আরো জোরদার করেছে। দেশটি ইসলামবিদ্বেষী বৈশ্বিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে নিজেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে। আর তা হলো রাষ্ট্রীয় মদতপুষ্ট হান জনগোষ্ঠীর আধিপত্যের বিরুদ্ধে সক্রিয় আত্মপ্রত্যয়ী একটি জাতিগোষ্ঠীকে পুরোপুরি মূলোৎপাটন করা। উইঘুর সম্প্রদায়ে ইসলাম সার্বিক ব্যবস্থার মূলভিত্তির ভূমিকা পালন করে। আর এদিকেই নজর দিয়েছে দেশটির কম্যুনিস্ট সরকার। বেইজিং মনে করে, সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে ইসলামের মূলোৎপাটন করতে পারলে তারা উইঘুরদের ধ্বংস করতে পারবে। আর এজন্যই সবার অজান্তে বছরের পর বছর ধরে তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি গত আগস্টে জাতিসংঘ গোটা বিশ্বের সামনে বিষয়টি তুলে ধরার পরেও বিরতিহীনভাবে এ কার্যক্রম চলছে।  আবদুল্লাহর দরজার কড়া এখনো নাড়া হয়নি। কিন্তু এটি আগামীকালই ঘটতে পারে, আবার কখনোই নাও ঘটতে পারে। এর পরেও অজানা আতঙ্ক ও কঠিন বাস্তবতা হলো যে, সন্তান, স্ত্রী ও বয়োবৃদ্ধ পিতা-মাতার সঙ্গে কাটানো প্রতিটা মুহূর্তই তার জীবনের সর্বশেষ মুহূর্ত হয়ে উঠতে পারে। এই আতঙ্ক তাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করে। কেননা, তার বলা প্রত্যেকটি শব্দ নজরদারি করা হচ্ছে, ধর্মীয় প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে পুলিশি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। বন্দিশিবিরের দেয়ালের বাইরেও গোটা জিনজিয়াং প্রদেশ আবদুল্লাহর মতো মানুষদের কাছে উন্মুক্ত কারাগার হয়ে উঠেছে। তিনি সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনার মধ্যেই শুধু শান্তি খুঁজে পান। এই প্রার্থনা করেন যে, রাষ্ট্র যেন তাকে ছিনিয়ে নিয়ে তার পরিবারকে ধ্বংস না করে দেয়।
আল জাজিরায় প্রকাশিত নিবন্ধ অবলম্বনে)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status