বাংলারজমিন

টাঙ্গাইলে চালকের আসনে খান পরিবার

কামাল হোসেন, ভূঞাপুর (টাঙ্গাইল) থেকে

২৭ নভেম্বর ২০১৮, মঙ্গলবার, ৮:৪৪ পূর্বাহ্ন

এক সময় টাঙ্গাইল আওয়ামী লীগের মেরুদণ্ড বলা হতো খান ও সিদ্দিকী পরিবারকে। সাধারণ মানুষ এ দুই পরিবারকে বাঘ ও সিংহের খেতাবও দিয়েছিলেন। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জৌলুস হারাতে থাকেন তারা। বর্তমানে এ দুই পরিবারই কোণঠাসা। আবির্ভাব ঘটেছে নতুন নেতৃত্বের। ১৯৬৪-৬৫ সালে টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী করটিয়া সা’দত কলেজ ছাত্র সংসদে ভিপি নির্বাচিত হন আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্রলীগের লড়াকু সৈনিকের ভূমিকায় থাকার সুবাদে সত্তরের নির্বাচনে টাঙ্গাইল থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। একাত্তরে দেশমাতৃকার টানে মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে আওয়ামী লীগের টিকিটে ১৯৭৩, ১৯৯৬, ২০০৮ ও ২০১৪ সালে এমপি হন লতিফ সিদ্দিকী। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীও টাঙ্গাইলে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জায়গা দখল করে নেন। এভাবে টাঙ্গাইলের রাজনীতিতে প্রতাপশালীতে পরিণত হন সিদ্দিকী পরিবারের এ দুই ভাই। ১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগ ছেড়ে কাদের সিদ্দিকী গড়ে তোলেন ‘কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগ’। দুই ভাই আজাদ ও মুরাদ সিদ্দিকীও কাদের সিদ্দিকীর অনুসারী হন। একমাত্র লতিফ সিদ্দিকী থেকে যান আওয়ামী লীগে। ২০০১ সালের নির্বাচনে ‘গামছা প্রতীকে’ টাঙ্গাইল-৮ আসনে এমপি নির্বাচিত হয়ে উত্তাপ ছড়ান জাতীয় সংসদে। ২০০৯ সালের পর ক্ষমতায় না থেকেও টাঙ্গাইলসহ জাতীয় রাজনীতিতে আলোচিত নাম ছিল সেই বাঘা কাদের সিদ্দিকীর। সিদ্দিকী পরিবারের কথায় চলত টাঙ্গাইলের রাজনীতি। কিন্তু বর্তমান চিত্রটা উল্টো। ২০১৪ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে হজ ও মহানবীকে নিয়ে কটূক্তি করে লতিফ সিদ্দিকী সংসদ সদস্য পদ, মন্ত্রিত্ব থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সদস্য পদও হারিয়েছেন। প্রায় ১০ বছর সংসদের বাইরে আছেন কাদের সিদ্দিকী। অনেকর ধারণা ছিল লতিফ সিদ্দিকীকে পুনরায় দলে নেয়া হবে এবং একাদশ সংসদ নির্বাচনে তিনি অংশ নেবেন। কিন্তু তা আর হলো না। এ ছাড়াও মুরাদ সিদ্দিকীর আওয়ামী লীগে যোগদান নিয়ে আলোচনা চলছিল অনেকদিন আগে থেকেই। শেষ পর্যন্ত তাও আর হয়ে উঠছে না। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমেই আওয়ামী রাজনীতি থেকে বিদায় নিতে হচ্ছে সিদ্দিক পরিবারকে।
অপরদিকে আওয়ামী লীগে খান পরিবারের আবির্ভাব ঘটে শামসুর রহমান খান শাহজাহানের মাধ্যমে। তিনি ১৯৫৪ থেকে ৫৬ সালে পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি, ১৯৬৫ থেকে ৬৬ সাল পর্যন্ত টাঙ্গাইল মহকুমা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭০, ১৯৭৩, ১৯৭৯ এবং ১৯৮৬ সালে টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৫ সালে শামসুর রহমান খান শাহজাহান টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর তার ভাতিজা রানা, বাপ্পি, মুক্তি, কাঁকনের রাজনীতিতে আবির্ভাব ঘটে। ২০০২ সালে শামসুর রহমান খান শাহজাহান কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক হলে টাঙ্গাইলে ভাতিজাদের রাজনৈতিক অবস্থান আরো সুদৃঢ় হয়। টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনে ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে শামসুর রহমান রহমান খান শাহজাহান বিএনপি প্রার্থী লুৎফর রহমান খান আজাদের কাছে হ্যাটটিক পরাজিত হলে এ আসনে শাহজাহান অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। ২০০৮ সালে মনোনয়ন দেয়া হয় ডা. মতিয়ার রহমানকে। ডা. মতিয়ারের মাধ্যমেই ২৪ বছর পর আসনটি পুনরুদ্ধার করে আওয়ামী লীগ। ২০০৪ সালের ৫ই জানুয়ারি আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক থেকে পুনরায় টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি করা হয় শামসুর রহমান খান শাহজাহানকে। ২০১১ সালের ২রা জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন তিনি। খান পরিবারের দায়িত্বে থাকেন রানা, মুক্তি, কাঁকন ও বাপ্পা। ২০১২ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ডা. মতিউর রহমান মারা গেলে উপনির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন চান খান পরিবারের উত্তরসূরি তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক আমানুর রহমান খান রানা। কিন্তু উপনির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পান শহীদুল ইসলাম লেবু। মনোনয়ন বঞ্চিত রানা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে দল থেকে বহিষ্কার হন। ওই উপনির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হন আমানুর রহমান খান রানা। পুনরায় দলে জায়গা করে নেন তিনি। ২০১৪ সালে দলীয় টিকিট পেয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। খান পরিবারের আধিপত্য আরো জোরালো হয়। আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক হত্যা মামলার মাধ্যমে এ আধিপত্যের পতন শুরু হয়। সেই মামলায় ২০১৪ সালের ১১ই আগস্ট গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয় আনিসুল ইসলাম রাজা। মোহাম্মদ আলী নামের আরেকজন গ্রেপ্তার হয় একই বছরের ২৪শে আগস্ট। তারা দু’জনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। ফারুক আহমদ হত্যাকাণ্ডে খান পরিবারের চার ভাই জড়িত বলে তারা আদালতকে জানান। পরে পুলিশ খান পরিবারের চার ভাইকে গ্রেপ্তার করতে অভিযানে নামে। কিন্তু এর আগেই তাঁরা আত্মগোপনে চলে যান। সংসদ সদস্য রানা ২০১৬ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করলে আদালত তাকে জেল হাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেন। সেই সময় থেকে তিনি কারাগারে আছেন। ২০১৭ সালের ১৬ই জানুয়ারি সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান রানা ও তার তিন ভাই টাঙ্গাইল পৌরসভার সাবেক মেয়র শহিদুর রহমান খান মুক্তি, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি সানিয়াত খান বাপ্পা ও ব্যবসায়ী নেতা জাহিদুর রহমান খান কাকনকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এর আগে ১১ বছর পর ২০১৫ সালের ১৮ই অক্টোবর সম্মেলনের মাধ্যমে ফজলুর রহমান খান ফারুককে সভাপতি ও এডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলামকে সাধারণ সম্পাদক করে জেলা আওয়ামী লীগের যে কমিটি গঠন করা হয় তাতে স্থান হয়নি সিদ্দিক পরিবারের। তবে আমানুর রহমান খান রানার বাবা আতাউর রহমান খানকে জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য করা হয়। একাদশ সংসদ নির্বাচনে টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনে রানার পরিবর্তে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে আতাউর রহমান খানকে। আর এ মনোনয়নের মাধ্যমে টাঙ্গাইল আওয়ামী লীগে খান পরিবার টিকে রইলো। বিদায় নিলো সিদ্দিক পরিবার। এ বিষয় নিয়ে টাঙ্গাইলের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলতে গেলে কেউই মুখ খুলতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে প্রথম সারির কয়েকজন নেতা বলেন, টাঙ্গাইলের আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে খান পরিবারের দরকার আছে। আর এ বিষয়টি চিন্তা করেই দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা আতাউর রহমান খানকে টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনে মনোনয়ন দিয়েছেন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status