প্রথম পাতা

মেগাজোট: আসন নিয়ে দরকষাকষি

উৎপল রায়

১৭ নভেম্বর ২০১৮, শনিবার, ১০:২০ পূর্বাহ্ন

নির্বাচন সামনে রেখে বড় জোটেই চোখ আওয়ামী লীগের। এ নিয়ে তৎপরতাও চলছে জোরেশোরে। তবে, মেগা জোট গঠন করা হলে শরিকদের কতটি আসনে ছাড় দেয়া হবে এ নিয়ে সমমনা দলগুলোর সঙ্গে চূড়ান্ত কোনো আলোচনা হয়নি। তবে ভেতরে ভেতরে চলছে দরকষাকষি। দলগুলোর দাবি যেমন আছে, তেমনি আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের নেতারাও এগুচ্ছেন কৌশলে। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনী কৌশল হিসেবে ১৪ দলকে সঙ্গে নিয়ে মহাজোট সম্প্র্রসারণের লক্ষ্যে জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। সূত্রমতে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ছোট-বড় মিলিয়ে সমমনা ১শ’র বেশি দলকে নিয়ে মেগা জোট হতে পারে। রাজনৈতিক অঙ্গনেও এ নিয়ে জোর আলোচনা রয়েছে।

সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টিতো আছেই, আর জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে  ৫৯টি দলের সমন্বয়ে সম্মিলিত জাতীয় জোট (ইউএনএ), ডা. বদরুদ্দোদ্দজা চৌধুরীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট, মিছবাহুর রহমান চৌধুরী ও এমএ আউয়ালের নেতৃত্বে ১৫টি দলের সমন্বয়ে গঠিত ইসলামিক ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স, নাজমুল হুদার বিএনএ, আবুল কালাম আজাদের বিএনএফসহ আরো কিছু ছোট দল ও জোটের তৎপরতা শুরু হয়েছে ওই মেগা জোটে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার। এ ছাড়া বাম দলের একটি অংশকেও পাশে রাখতে চায় আওয়ামী লীগ। পাশাপাশি জাকের পার্টিসহ আরো কিছু ছোট দলও মহাজোটে থাকার তৎপরতা চালাচ্ছে। এদিকে নির্বাচনী কৌশল হিসেবে বড় জোট গঠন করা হলেও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের বক্তব্য অনুযায়ী জোটের শরিকদের সর্বোচ্চ ৭০টি আসনে ছাড় দিতে পারে দলটি। ইতিমধ্যে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও গণমাধ্যমকে এমনটিই জানিয়েছেন।

আর কোনো দল কতটি আসনে নির্বাচনের সুযোগ পাবে, কোন আসনে ছাড় পাবে সে বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি বলে সরকারি দলের শীর্ষ নেতারা জানান। নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই এ বিষয়টির সুরাহা হবে। যদিও শরিক দলগুলোর দাবি যেমন আছে, তেমনি বাস্তবতার নিরিখে দলগুলোর দাবি প্রত্যাশা অনুযায়ী পূরণ করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক মানবজমিনকে বলেন, ‘নির্বাচন উপলক্ষে আমাদের বৃহৎ জোট গঠিত হবে সেটি ঠিক আছে। তবে, আসন বণ্টন বা ছাড়ের বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আলাপ-আলোচনা চলছে। কয়েকদিনের মধ্যেই বিষয়টি সুরাহা হবে।

আর জয়ী হওয়ার মতো প্রার্থীকেই মনোনয়ন ও সুযোগ দেয়া হবে।’ আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা মনে করেন নির্বাচনী কৌশল হিসেবে বড় জোট গঠন করা হলেও দলগুলোকে নির্বাচনে প্রার্থিতা দেয়ার ব্যাপারে খুব বেশি ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই। শুধু খুশি রাখার জন্য প্রার্থিতা দিতে চায় না আওয়ামী লীগ। এক্ষেত্রে ঝুঁকি নিতে চান না দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জয়ী হওয়ার মতো প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়ার বিষয়ে জোর দেবেন তারা। দলটির একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য মানবজমিনকে বলেন, ‘বড় জোট হলেও শরিক দলগুলোকে খুব বেশি আসন ছেড়ে দেয়া আমাদের জন্য খুবই কঠিন। কারণ কিছু আসন রয়েছে যেখানে অন্য কোনো প্রার্থীকে সুযোগ দিলে আমাদের দলের নেতাকর্মীরা মানবে না। আর এমন কিছু আসন আছে যেগুলো ছেড়ে দেয়া মানে বিএনপিকে সুযোগ করে দেয়া। যে জন্য শরিকদের খুব বেশি আসন ছাড়তে আমরা রাজি নই।’

জাতীয় পার্টির (এরশাদ) প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায় মানবজমিনকে বলেন, ‘আমাদের শরিক দল ৫টি। এর মধ্যে ইসলামী মহাজোটের ৩৪টি ও বাংলাদেশ জাতীয় জোটের (বিএনএ) ২২টি দল রয়েছে। সব মিলিয়ে ৫৯টি দল রয়েছে জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে সম্মিলিত জাতীয় জোটে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বৃহৎ জোটের আলোচনা হচ্ছে। দেখা যাক কী হয়।’ তিনি বলেন, ‘আসন বণ্টন নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনা চলছে। আর আশা-নিরাশার কিছু নেই। কতটি আসনে আমাদের প্রার্থী দেয়া যাবে সেটি আলোচনার টেবিলেই নির্ধারণ হবে।’       
           
এদিকে ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাস্তবতা বুঝে তারাও খুব বেশি আসনে প্রার্থিতার বিষয়ে আশাবাদী হতে পারছেন না। জোটের শরিক দলগুলোর পক্ষ থেকে কিছুদিন আগেও ৪০ থেকে ৫০ আসনে প্রার্থিতার দাবি থাকলেও এখন তারা ওই অবস্থান থেকে ধীরে সরে আসছেন। নেতারা জানান, আওয়ামী লীগ যদি বৃহত্তর জোটের দিকে অগ্রসর হয় তাহলে দরকষাকষি করে যত বেশি আসন আদায় করা যায় সেটিকেই এখন যথেষ্ট বলে মনে করবেন তারা। তবে, ১৪ দলীয় জোটের একাধিক দলের শীর্ষ নেতারা মনে করেন বিগত সময়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), ওয়ার্কার্স পার্টি ৬ থেকে ৭টি আসনে নির্বাচন করেছে। এবার তারা বেশি আসনের লক্ষ্য নিয়ে নির্বাচনী মাঠে নেমেছে। দাবির বিষয়ে ১৪ দলীয় জোটের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ (ইনু)সহ বেশ কয়েকটি দল জোরালো যুক্তি তুলে ধরবে বলে জানান নেতারা। একই সঙ্গে অতীতের যেসব দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকে বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে আন্দোলনে থেকেছে এবং অতীতের নির্বাচনে যারা বঞ্চিত ছিলো তাদের মূল্যায়নের দাবি জানান তারা।

ওয়ার্কার্স পার্টি সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা মানবজমিনকে বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের সাতজন সাংসদ রয়েছেন। এবার আমাদের দাবি আরো জোরালো। পরিস্থিতি অনুযায়ী এবার আমাদের দাবি অন্তত ১০টি আসনে ছাড় দেয়া হোক। যা ছিল তার থেকে কমিয়ে আনার তো কোনো সুযোগ নেই। আর আমাদের দলের সাংগঠনিক যে অবস্থা তাতে ওই ১০ জনের বেশি জয়ী হওয়ার মতো প্রার্থী আমাদের আছে। আমাদের এই দাবি যৌক্তিক।’ তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ বলছে, শরিকদের তারা ৭০টি আসনে ছাড় দেবে। সেক্ষেত্রে জাতীয় পার্টিকে যদি ৩০টি আসনেও ছাড় দেয়া হয় বলে ধরে নিই তারপরে তো ৪০টি আসনে আমরাসহ অন্যদের ছাড় দিলেও কোন সমস্যা দেখি না।’ ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, ‘বিএনপি বা ড. কামাল হোসেনের ঐক্যফ্রন্টের বিরুদ্ধে যারা আসবে তারা মহাজোটের অংশীদার হবে এতে আমাদের ১৪ দলের অসুবিধার কোনো কারণ নেই।

কিন্তু ১৪ দল হলো আদর্শের জোট। এখন আদর্শের জোটকে বঞ্চিত করার কোনো অবকাশ নেই।’ ১৪ দলের শরিক দলের শীর্ষ নেতারা আলাপকালে বলেন, এরশাদের জাতীয় পার্টি এখন আর আগের অবস্থায় নেই। দলীয় প্রতীক লাঙ্গলে নির্বাচন করলে বৃহত্তর রংপুরের কিছু আসন ছাড়া আর অন্য আসনগুলোতে জাতীয় পার্টি খুব বেশি সুবিধা পাবে বলে মনে করেন না জোট নেতারা। সেক্ষেত্রে জাতীয় পার্টিকে ছাড় দেয়ার ব্যাপারে আপত্তি রয়েছে তাদের। যদিও আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে বিষয়টি এখনো তোলেননি নেতারা। জোটের শরিকদলের একজন শীর্ষ নেতা মানবজমিনকে বলেন, ‘জাতীয়  পার্টিকে ২০টির বেশি আসনে ছাড় দেয়া সমীচীন হবে না।’ যুক্তি হিসেবে এই নেতা বলেন, ‘২০১৪ সালের নির্বাচন হয়েছিল একটু ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। ওই সময় জাতীয় পার্টিকে যথেষ্ট ছাড় দেয়া হয়েছিল। অনেক আসনে তারা বিজয়ীও হয়েছিল। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। এবার নির্বাচনী মাঠে বিএনপি’র সঙ্গে লড়াই করতে হবে। আর জাতীয় পার্টিও আগের অবস্থায় নেই। যেসব জায়গায় বিএনপি’র প্রার্থী থাকবে সেসব জায়গায় জাতীয় পার্টির প্রার্থীর পক্ষে বিজয়ী হয়ে আসা কঠিন হবে। সেজন্যই তাদের ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। তেমনি বি. চৌধুরীর যুক্তফ্রন্টও খুব বেশি আসনে ছাড় পাবে বলে মনে হয় না।’   

জাতীয় পার্টির (জেপি) মহাসচিব শেখ শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আসন বণ্টন নিয়ে চূড়ান্ত কোনো আলোচনা এখনো হয়নি। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আমাদের বলা হয়েছে তাদের আসনগুলোর সুরাহা হলেই আমাদের সঙ্গে বসবে। আমরাও সেই অপেক্ষায় আছি।’ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ/মোজাফ্‌ফর) ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘দু-একদিনের মধ্যেই আসন বণ্টনের বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়ে যাবে বলে আশা করছি। তিনি বলেন, অতীতে জোটের যারা বেশি সুবিধা পেয়েছে তাদেরকে কম আসন দিয়ে যারা অতীতের নির্বাচনে প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও সুযোগ পায়নি তাদের এবার সুযোগ দেয়ার অনুরোধ জানাবো আমরা।’ ইসমাইল হোসেন আরো বলেন, ‘আওয়ামী লীগ বৃহত্তর জোটের দিকে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে জোটের সমমনা শরিক দলের আসন কমে আসাটাই স্বাভাবিক। আর বাস্তবতার নিরিখে আমরাও খুব বেশি আশা করছি না। যদি বিগত নির্বাচনের মতো আসন দেয়া হয় তাতেও আমাদের অসন্তুষ্টির কোনো কারণ নেই। তবে, জোট সম্প্রসারণ হলেও এরশাদের জাতীয় পার্টি ও বি. চৌধুরীর যুক্ত ফ্রন্টও খুব বেশি আসন পাবে বলে আমরা মনে করি না। কেন না আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন যে, জোটের শরিকেরা ৭০ টির বেশি আসন পাবেন না। সেক্ষেত্রে বেশির ভাগ দলেরই আসন কমে আসাটা স্বাভাবিক।’
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status