বিশ্বজমিন

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের আহ্বান

অবিলম্বে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন স্থগিত করুন

মানবজমিন ডেস্ক

১৩ নভেম্বর ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:২৪ পূর্বাহ্ন

অবিলম্বে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন পরিকল্পনা স্থগিত করতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে নিরপেক্ষ বেসরকারি আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (সংক্ষেপে ক্রাইসিস গ্রুপ)।  যতক্ষণ পর্যন্ত রাখাইনে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হয় এবং তারা স্বেচ্ছায় ফিরতে না চান ততক্ষণ পর্যন্ত প্রত্যাবর্তন পরিকল্পনা স্থগিত করতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে আহ্বান জানানো হয়েছে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও অন্য দেশগুলোর প্রতি। এতে হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে, চীনের চাপে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ১৫ই নভেম্বর প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া শুরু করতে সম্মত হলেও অনেক রোহিঙ্গা স্বেচ্ছায় ফিরতে রাজি নন। ক্রাইসিস গ্রুপ বেশ কিছু রোহিঙ্গার সাক্ষাৎকার নিয়েছে। তাতে এমন চিত্র ফুটে উঠেছে। দেখা গেছে, ফেরত পাঠানোর তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তাদের অনেকে এরই মধ্যে পালিয়েছেন। কমপক্ষে তাদের একজন আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। ক্রাইসিস গ্রুপ আরও বলেছে, ইচ্ছার বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো হলে তাতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে উভয় দেশেই নতুন করে অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে। এক্ষেত্রে জরুরি ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করতে ৫ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশগুলো হলোÑ ১. যতক্ষণ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ হিসেবে নিশ্চিত করা না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে অবিলম্বে স্থগিত করা উচিত। মিয়ানমারকে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। ২. এ সময়ের মধ্যে জাতিসংঘ ও তার আন্তর্জাতিক বেসরকারি এনজিও বিষয়ক অংশীদার, মিডিয়াকে বাধাহীনভাবে রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে প্রবেশের সুযোগ দিতে হবে, যাতে তারা অত্যাবশ্যকীয় মানবিক সহায়তা করতে পারে। এ ছাড়া তারা যাতে নিরপেক্ষভাবে মাঠ পর্যায়ের অবস্থা জানতে পারে। ৩. রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে রাজনৈতিক যোগাযোগ আরো গভীর করা উচিত বাংলাদেশ সরকার ও তার আন্তর্জাতিক অংশীদারদের। ভবিষ্যৎ কি হতে পারে তা নিয়ে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত। এখন পর্যন্ত এমন কোনো শলাপরামর্শ করা হয় নি অথবা তা করার জন্য কোনো প্রক্রিয়াও নেয়া হয়নি। ৪. চীনের উচিত তাড়াতাড়ি করে প্রত্যাবর্তন শুরু করানোর জন্য চাপ দেয়া বন্ধ করা। তাদের ও অন্য সরকার, সংগঠনগুলোর উচিত রাখাইনে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা যাতে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছা প্রত্যাবর্তনের উপযুক্ততা তৈরি হয় এবং তাদের ফেরত যাওয়া টেকসই হয়। ৫. প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া স্থগিত করতে দুই দেশের ওপর আনুষ্ঠানিকভাবে এবং বেসরকারি উপায়ে প্রভাব ব্যবহার করে প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়ার জোরালো বিরোধিতা অব্যাহত রাখা উচিত জাতিসংঘ ও এর শরণার্থী বিষয়ক এজেন্সির। বিশেষ করে মিয়ানমারে নিযুক্ত জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দূত ক্রিস্টিন শ্রানার বারগেনারের উচিত প্রকাশ্যে একটি অবস্থান নেয়া এবং ঢাকা ও ন্যাপিডকে চাপ দেয়া, যাতে বর্তমান পরিকল্পনা স্থগিত রাখা হয়। ব্রাসেলসে ১২ই নভেম্বর পরিস্থিতি নিয়ে ব্রিফিং করা হয়। তারপর ৮ পৃষ্ঠার একটি বিবৃতি দিয়েছে ক্রাইসিস গ্রুপ। তাতে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠালে কি কি বিপদ বা ঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে তাও তুলে ধরা হয়েছে তাতে। বলা হয়েছে, আগামী ১৫ই নভেম্বর রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো শুরু হওয়ার কথা। প্রথম পর্যায়ে কয়েক হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ। তবে মিয়ানমারের রাখাইনে তাদের ফেরত যাওয়ার মতো উপযুক্ত পরিস্থিতি নেই। এতে ফেরত যাওয়া প্রক্রিয়াটি স্বেচ্ছাভিত্তিক নয়। এতে শরণার্থীদের নিরাপত্তা বিপন্ন হবে। এমন উদ্যোগে বাংলাদেশের ভিতরেই নতুন করে সহিংস অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ক্রাইসিস গ্রুপ তার বিবৃতিতি চারটি উপভাগে ভাগ করেছে। প্রথম ভাগের নাম দেয়া হয়েছে ওভারভিউ। এতে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি বলা হয়েছে। প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া অবিলম্বে স্থগিত করতে আহ্বান জানানো হয়েছে। দ্বিতীয় ভাগের শিরোনাম ‘প্রত্যাবর্তনের জন্য নতুন চাপ’। এতে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের নভেম্বরে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো নিয়ে একটি একমত হয় বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। এর ওপর ভিত্তি করে ২৩শে জানুয়ারি রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু সরকারি চ্যানেলের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত কোনো রোহিঙ্গা শরণার্থী ফেরত যাননি। প্রকৃতপক্ষে আরো বেশি সংখ্যক রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে এসেছেন। ২০১৮ সালে এসেছেন প্রায় ১৬ হাজার রোহিঙ্গা। তাদের মোট সংখ্যা কমপক্ষে ৭ লাখ ৫০ হাজার। তারা এখন নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নিশ্চিত হওয়া, অধিকার সুরক্ষিত হওয়া, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, তাদের গ্রাম, বাড়িঘর, সহায় সম্পত্তি ধ্বংস করে দেয়ার ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত হতে চান। যতক্ষণ এগুলো নিশ্চিত না হবে ততক্ষণ তারা দেশে ফিরতে নারাজ। তারপরও ঢাকায় প্রত্যাবর্তন চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের একটি জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে চুক্তিতে একমত হয় উভয় পক্ষ। ওই চুক্তির অধীনে ১৫ই নভেম্বর ৪৮৫টি রোহিঙ্গা পরিবারকে ফেরত পাঠানোর কথা। তবে এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে কোনো শলাপরামর্শ করা হয়নি। কিভাবে তাদেরকে বাছাই করা হয়েছে তাও স্পষ্ট নয়। মিয়ানমারে ফেরত যাওয়া নিয়ে আতঙ্কিত এসব রোহিঙ্গা। তবে বাংলাদেশ সরকার বলেছে, রোহিঙ্গাদেরকে ফেরত পাঠাতে জোর প্রয়োগ করা হবে না। বিবৃতির তৃতীয় ভাগে বলা জোর করে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর ঝুঁকির বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার হয়তো বলতে পারে, তাদের পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষায় হয় কিছু শরণার্থীকে ফেরত পাঠালে। তবে এতে রোহিঙ্গাদেরই ক্ষতি হতে পারে। কারণ, তারা যে পরিস্থিতিতে পড়ে পালিয়ে এসেছিলেন, তাদের সেরকম এক পরিস্থিতিইে যেতে হবে। ১৯৫১ সালের রিফিউজি কনভেশন অথবা এর ১৯৬৭ প্রটোকলে স্বাক্ষরকারী দেশ বাংলাদেশ নয়। বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে রোহিঙ্গাদেরকে শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক আইন নিশ্চিত করার একটি বাধ্যবাধকতা আছে। আর তা হলো, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত যাওয়া হতে হবে স্বেচ্ছায় ও নিরাপদ। আগেভাগে জাতিসংঘ বা তার শরণার্থী বিষয়ক এজেন্সির সঙ্গে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার কোনো পরামর্শ করেনি। তাদের এমন উদ্যোগকে অপরিকপক্ব বলে আখ্যায়িত করেছে জাতিসংঘ। এছাড়া রাখাইনে এখনও রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি বলে বলছে জাতিসংঘের স্পেশাল র‌্যাপোর্টিউর। তাই মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। যদি জোরপূর্বক ফেরত পাঠানো হয় রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও সীমান্তের উভয় পাশে স্থিতিশীলতা নিয়ে মারাত্মক ঝুঁকি দেখা দিতে পারে। ফেরত পাঠানো প্রক্রিয়ার কঠোর বিরোধিতা করেছে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা। তারা এ প্রক্রিয়াকে বাধা দিতে যা করার তাই করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। এতে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাবে। রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশের নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের মধ্যে তাতে সংঘর্ষ সৃষ্টি হতে পারে। এতে মানবিক কর্মকাণ্ডে জটিল এক পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে। আর তাতে শান্তি  ও কয়েক বছরের উন্নয়ন প্রচেষ্টা চলে যেতে পারে পশ্চাৎমুখে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status