বিশ্বজমিন

বাংলাদেশের ‘আনসাং হিরো’ উন্নয়ন ত্বরান্বিত করছে এনজিও খাত

জেনি গুসটাফসন

১০ নভেম্বর ২০১৮, শনিবার, ৯:৫২ পূর্বাহ্ন

বাংলাদেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলের মৌলভীবাজারের প্রত্যন্ত এক অঞ্চলে সরু ও অগভীর জল পাড়ি দেয় নৌকা। বর্ষার সময়ও থেমে থাকে না। নৌকা ওই পাড়ে গিয়ে যাত্রী নামিয়ে দেয়। কিছু কার্ডবোর্ড বক্সও নামে নৌকা থেকে।
ঢাকার এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী মার্জিয়া প্রভা একটি বক্স নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। বললেন, ‘এসব হলো ওষুধ। মোট ৩৫ বক্স। আশা করছি এতেই হবে। এবার এসব কিনতে অর্থ সংগ্রহ করতে মাত্র ২ দিন পেয়েছি। এই টাকা দিয়ে এসবই কিনতে পারলাম।’
তার মতো অন্য সবাই একটা করে বক্স বহন করতে লাগলেন। ঢাকা থেকে রাতের বাসে করে ভোরে এসে এখানে পৌঁছালেন এই তরুণ শিক্ষার্থীদের দল। তারা এখানে অস্থায়ী স্বাস্থ্য শিবির গড়বেন।
প্রভা আগেও অনেকবার এমন স্বাস্থ্য শিবিরে জড়িত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা এখানে এসেছি কারণ গত সপ্তাহে এখানে বন্যা হয়েছে। আমরা শুনেছি অনেক পরিবারের সহায়তা প্রয়োজন।’
খুব শিগগিরই ছোট এক গ্রামে প্রবেশ করেন তারা। একজন লোক একটি ঘরের তালা খুলে দেন। ভেতরে টেবিল ঠিক করা হলো। বসলেন ডাক্তার ও মেডিক্যাল শিক্ষার্থীরা।
ঘরের বাইরের উঠান মানুষে পরিপূর্ণ। বাবার হাতে শিশু। বৃদ্ধ নারী-পুরুষ। গ্রামের দুই তরুণ এসে সবার নাম লিখতে শুরু করলেন।
ঢাকা থেকে আসা দলের একজন, জান্নাতুন ফেরদৌস বলেন, ‘তরুণ প্রজন্মের মধ্যে উৎসাহের অভাব নেই। এ কারণেই আমরা এসব করি।’
বাংলাদেশের মতো ছোট ও ঘনবসতির দেশে এমন স্বেচ্ছাসেবা বিরল কিছু নয়। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান থেকে ভেঙ্গে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয় বাংলাদেশ। যুদ্ধের আগের বছরই দেশজুড়ে আঘাত হানে ভয়ঙ্করতম সাইক্লোন। যুদ্ধের কিছুকাল পরই দেখা দেয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ।
বদ্বীপ হওয়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিতে থাকে বাংলাদেশ। ১৬ কোটি মানুষের জন্য এটি যেমন এক ধরণের চ্যালেঞ্জ, তেমনি একে অপরকে সাহায্য করার উপলক্ষও।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের প্রফেসর ডেভিড লুইস বলেন, ‘বাস্তুসংস্থান, পরিবেশ ও ইতিহাস নিশ্চয়ই কিছুটা ভূমিকা পালন করেছে। এ কারণেই হয়তো এ ধরণের গণউদ্যোগ।’
বাংলাদেশের নেতৃত্বস্থানীয় বুদ্ধিজীবী রওনক জাহান মনে করেন, বাংলাদেশের বেশিরভাগ এনজিওর নেতৃত্বে রয়েছেন এমন মানুষজন যারা মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘মানুষের ওপর এক ধরণের প্রভাব ফেলেছিল এই যুদ্ধ। পুরোনো দিনের সামাজিক রীতিনীতি দুর্বল করে দিয়েছিল। মানুষকে শিখিয়েছিল কীভাবে নিজের কাজ নিজে করতে হয়। এই যুদ্ধ এক ধরণের উদ্যোক্তায়নের অনুভূতি ছড়িয়ে দেয়।’
ক্ষুদ্রঋণ অগ্রদূত নোবেল জয়ী মোহাম্মদ ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক হলো বাংলাদেশের মানবিক উদ্যোক্তামূলক সংগঠনগুলোর একটি। জামানত ছাড়াই দরিদ্র মানুষকে ছোট ঋণ দেয় এসব প্রতিষ্ঠান।
উন্নয়ন খাতের ‘হেভিওয়েট’ ব্র্যাকও আছে। স্যার ফজলে হাসান আবেদের হাতে ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্র্যাক বাংলাদেশ ও বিশ্বের বৃহত্তম এনজিওতে পরিণত হয়েছে। শেল কোম্পানির প্রাক্তন এই নির্বাহী তখন লন্ডনের চাকরি ছেড়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের নারীদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাজ শুরু করেন নিজের এলাকা সিলেটে।
কিন্তু বাংলাদেশের এনজিওসমূহ পশ্চিমা এনজিওসমূহের তুলনায় কম পরিচিত।
প্রফেসর লুইস বলেন, ‘আমি মনে করি এসব এনজিও আরও অনুসরণীয় হওয়া উচিৎ। কিন্তু এসব বস্তুত নয়। কারণ, মানুষ বাংলাদেশ সম্পর্কে জানে না। বৈশ্বিক মঞ্চে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে বেগ হতে হয় বাংলাদেশকে।’ তিনি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানবিক কাজকেও এখানে উদাহরণ হিসেবে টেনে আনেন।
একটি শ্রেণিকক্ষ থেকে স্কুল ফাউন্ডেশন
মার্জিয়া প্রভার মতো যারা স্বেচ্ছাসেবার সঙ্গে জড়িত তাদের কাজের সুযোগ বেশ সীমিত। কিন্তু তারা সমাজে ছাপ ফেলে যাচ্ছেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষদের সহায়তা দেওয়া ছাড়াও, প্রভা দেশের বিভিন্ন স্কুলে ‘জরুরী প্যাড কর্নার’ নামে একটি প্রকল্প পরিচালনা করেন। এই প্রকল্পের আওতায় স্কুলশিক্ষার্থীদের জন্য অল্প খরচে স্যানিটারি প্যাড সরবরাহ করা হয়।
বিভিন্ন শহরে বসবাসরত শিক্ষার্থী ও বন্ধুদের সহায়তায় তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার ৮টি স্কুলে এই উদ্যোগ পরিচালনা করেন। ‘কিন্তু আমার পরিকল্পনা এই উদ্যোগ ৬৪টি জেলাতেই ছড়িয়ে দেওয়া। মাসিক সংক্রান্ত স্বাস্থ্যবিধি এই দেশে এখনও ট্যাবুর মতো,’ বলছিলেন প্রভা।
ঢাকার নি¤œআয়ের মানুষদের বসবাসস্থল রায়ের বাজার বস্তির রিকশা চালক, দিনমজুর ও গৃহকর্মীদের সন্তানদের পড়ানো শুরু করেন করভি রাখসান্দ। তিনি ছিলেন তখন ছাত্র। তিনি যাদের পড়াতেন তাদের পড়াশোনার কোনো সুবিধাই ছিল না। মাত্র একটি শ্রেণিকক্ষে তিনি পাঠদান শুরু করেছিলেন।
এই শ্রেণিকক্ষই পরে হয়ে উঠে স্কুল। এরপর ফাউন্ডেশন, যার নাম জাগো। এখন দেশজুড়ে ১২টি স্কুল পরিচালিত হয় এই ফাউন্ডেশনের অধীনে।
করভি রাখসান্দ বলেন, ‘আমার এখনও মনে আছে, আমি যখন আমাদের প্রথম শিক্ষার্থীদেরকে জিজ্ঞেস করি তাদের স্বপ্ন সম্পর্কে, তাদের একজন বলে উঠে, ‘আমি বাবার মত রিকশাচালক হতে চাই’। আর সেই ছেলেটিই আমাদের স্কুলের প্রথম গ্রাজুয়েটদের একজন ছিল। সে এখন কলেজে পড়াশুনা আরম্ভ করেছে।’ ওই ছেলেটির নাম লেনিন আহমেদ। তার সঙ্গে আরও দুইজন একসাথে পড়াশুনা করেছিল। একজন সিয়াম হোসেন, আরেকজন সুফিয়ান সাব্বির।
সিয়ামের পিতাই ওই কক্ষ ভাড়া দিয়েছিলেন রাখসান্দের কাছে। এখনও ঘরের নিচের কক্ষে তিনি থাকেন।
সিয়াম জানায়, ‘আমার মা-ও এর অংশ ছিল। তিনিই স্থানীয়দেরকে বলে শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে বোঝাতেন। তিনি বলতেন, আমার তিন সন্তান। সুতরাং, স্কুলে ইতিমধ্যে তিন শিক্ষার্থী হয়ে গেছে।’
স্কুলের করিডোরের পেছনে খোলা মাঠ। ছাত্রদের লাগানো গাছ আছে পাশে। দেওয়ালে আঁকা ম্যুরাল। পাশেই হচ্ছে নতুন ভবন। সাব্বির বলেন, ‘আমরা এখন দেখছি যে আমাদের সঙ্গের যারা পড়ার সুযোগ পায়নি ও আমরা যারা পড়েছি তাদের মধ্যে পার্থক্য কী। তারা এখন গাড়ি চালায় বা রিকসা চালায়। কিংবা রাস্তার হকার।’
জীবন-রক্ষাকারী সহায়তা
দেশের মোট জনসংখ্যার ২০-৩৫ শতাংশই কোনো না কোনো এনজিও থেকে সাহায্য পায় বলে ধারণা করা হয়। মূলত বড় এনজিওই এখানে এগিয়ে আছে। এ খাতে বেশ কয়েক বছর ধরে কাজ করা সাংবাদিক ও ইতিহাসবিদ আফসান চৌধুরী বলেন, ‘সরকার জানে যে, আমাদেরকে তাদের প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, যক্ষ্মারোগের ওষুধ ব্র্যাক ছাড়া সর্বত্র পৌঁছানো কখনই সম্ভব হতো না। শিক্ষা সুনিশ্চিত হতো না। সরকার তা জানে।’
কিন্তু রাজনৈতিক নাড়াচাড়া এতটা সহ্য করা হয় না। উদাহরণস্বরূপ, গত গ্রীষ্মে দ্রুতগামী বাসের আঘাতে দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার জেরে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে আন্দোলন হয়। কিন্তু পুলিশ ও সরকারপন্থী গোষ্ঠীসমূহ প্রতিবাদকারীদের সহিংস কায়দায় মোকাবিলা করে। এক সাক্ষাৎকারে এই ঘটনা নিয়ে মন্তব্য করার কারণে প্রখ্যাত আলোকচিত্রী শহীদুল আলম আটক হন।
মৌলভীবাজারের ওই গ্রামে, বিকেল ততক্ষণে ঘনিয়ে এসেছে। তাপও কমে এসেছে। বাইরের ভিড় প্রায় শেষ। কয়েকজন এখনও অপেক্ষা করছে সারিতে। সকাল থেকে শিবিরের শিক্ষার্থী ও ডাক্তাররা এক ইঞ্চি নড়তে পেরেছেন কিনা সন্দেহ। ‘কোনো সমস্যা নেই। আমরা মেডিক্যাল শিক্ষার্থী। তাই এটা কেবলই সুখকর অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য,’ বলছিলেন মেরিল আফরোজ জেবিন। তার পাশেই বসলেন সরু হাতের এক মহিলা। তার কাশি যেন থামছিলই না। ওই নারী বলছিলেন, বন্যার পর থেকে তার কাশি যাচ্ছেই না। জেবিন প্রেসক্রিপশনে কফ সিরাপ আর পুষ্টিবর্ধক ওষুধ লিখলেন। এরপর সেটা দিলেন প্রভাকে। প্রভা বসে ছিলেন খালি ওষুধের বক্সের পাশে।
তিনি বলেন, ‘আপাতত শুধু বাচ্চাদের ভিটামিনই অবশিষ্ট আছে। তাই এখন আমরা শিশুদের ওষুধই দিচ্ছি প্রাপ্তবয়স্কদেরকে। শুধু বলছি ডোজ দ্বিগুণ করতে। পরবর্তীতে আসার সময় আরও আনতে হবে, এটা বুঝতে পারছি।’
(আল জাজিরা থেকে অনূদিত)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status