বিশ্বজমিন

গোয়েন্দাজাল-৭

সিরিয়া সরকারের ভিতরে মোসাদ এজেন্ট!

মোহাম্মদ আবুল হোসেন

৬ নভেম্বর ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:৩১ পূর্বাহ্ন

ইলি কোহেন। সিরিয়া সরকারের উচ্চতম স্থানে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। এছাড়া তিনি ছিলেন তখনকার সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সম্ভবত এ জন্যই সিরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য তাকে বিবেচনা করা হচ্ছিল। গোলান উপত্যকায় সিরিয়ার প্রতিরক্ষা, সিরিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর লড়াই এবং সিরিয়ার সামরিক অস্ত্রের বিষয়ে বিস্তারিত ও পূর্ণাঙ্গ একটি পরিকল্পনা দিয়েছিলেন তিনি। একবার সেনাবাহিনীকে ছায়া দেয়ার জন্য সিরিয়ার সুরক্ষিত স্থানগুলোতে বৃক্ষরোপণের নির্দেশ দেন তিনি। লাগানো হলো গাছ। তা বড়ো হলো। কিন্তু এতে সুবিধা হলো ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনীরই। এতে তারা ওই গাছগুলো দেখে সহজেই তাদের টার্গেট ঠিক করতে পারলো। আসলে ইলি কোহেন ছিলেন গোপনে ইসরাইলের গুপ্তচর। তিনি সিরিয়ার সেনাদের ছায়া দেয়ার জন্য গাছ রোপনের নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং তার নির্দেশমতোই কাজ হয়েছে। ফলে ইসরাইলের সেনারা খুব সহজেই সিরিয়ার সেনাদের অবস্থান চিহ্নিত করতে পেরেছে। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি সিরিয়া সরকারের একেবারে কাছে ঘেকে দেশের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি করেছেন। এ সময়ে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল রাজনৈতিক, সামরিক উচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে। তাকে বানানো হয়েছিল সিরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রধান উপদেষ্টা। সিরিয়ার গুপ্তচরবৃত্তি বিরোধী কর্তৃপক্ষ তার সেই গোপন অধ্যায় জেনে যায়। ফলে তাকে আটক করা হয়। সামরিক আইনে তাকে অভিযুক্ত করা হয়। তাকে শাস্তি হিসেবে দেয়া হলো মৃত্যুদন্ড। ১৯৬৫ সালে সেই মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। কিন্তু তাকে গ্রেপ্তারের আগে তিনি যেসব গোয়েন্দা তথ্য ইসরাইলের কাছে পাচার করেছেন তাতে ৬ দিনের যুদ্ধে ইসরাইল জয়ী হয়।
১৯৭৮ সালের ১লা এপ্রিল। দামেস্ক ও জর্ডানের মধ্যবর্তী প্রধান টেলিফোনের লাইনে স্পর্শকাতর এক ফাঁদ পেতে রাখলো ইসরাইল। তাতে সিরিয়ার সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কমপক্ষে ১২ জন নিহত হন।
নিহত হন জেনারেল আনাতোলি কুনতসেভিচ। সিরিয়াকে নার্ভ গ্যাস তৈরিতে তিনি সহায়তা করে আসছিলেন বলে সন্দেহ করা হয়। বলা হয়, ১৯৯০ এর দশক থেকেই তিনি এ কাজে যুক্ত। এর বিনিময়ে সিরিয়া সরকারের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পেয়েছেন তিনি। ২০০২ সালের ৩রা এপ্রিল তিনি বিমানে করে ভ্রমণ করার সময় রহস্যজনকভাবে মারা যান। অভিযোগ আছে, তাকে হত্যার জন্য দায়ী মোসাদ।
২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে দামেস্কে স্বয়ংক্রিয় এক ফাঁদে পড়ে হামাসের সামরিক শাখার সিনিয়র সদস্য ইজজ এল দিন শেইখ খলিল নিহত হন।
সিরিয়ার পারমাণবিক কর্মকা-ের প্রধান ছিলেন কমান্ডার মুহাম্মদ সুলাইমানের অধীনে কাজ করেন এমন সিরিয়ার কর্মকর্তাদের ওপর নজরদারি করে মোসাদ। এর ফল হিসেবে তারা দেখতে পায় সিরিয়ায় তৈরি করা হচ্ছে পারমাণবিক চুল্লি। কিন্তু সিরিয়াকে তো এভাবে বাড়তে দেয়া যায় না। তাই ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে ইসরাইলের বিমান বাহিনী ওই পারমাণবিক চুল্লি ধ্বংস করে দেয়। এর এক বছর পরে হত্যা করা হয় মুহাম্মদ সুলাইমানকে।  তিনি ছিলেন সিরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচির প্রধান। তাকে ২০০৮ সালে হত্যা করা হয়। তখন তিনি তারতাস সমুদ্র সৈকতে পায়চারী করছিলেন। একটি বোট থেকে উড়ন্ত গুলিতে তিনি সেখানে নিহত হন।
২০০৭ সালের ২৫ শে জুলাই আল সাফির রাসায়নিক অস্ত্রের মজুদাগার বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ইরানের ১০ জন প্রকৌশলী ও ১৫ জন সিরিয়ান কর্মকর্তা নিহত হন। এ জন্য সিরিয়ার গোয়েন্দারা তদন্ত করে দায় চাপায় মোসাদের ঘাড়ে।
দামেস্কে ১৯৮৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে বোমা হামলা হয়। এর জন্য দায়ী করা হয় হিজবুল্লাহর কিছু নেতাকে। তার মধ্যে অন্যতম ইমাদ মুগনিয়ে অন্যতম। কিন্তু তাকে ২০০৮ সালে দামেস্কে হত্যা করা হয়।
২০১০ সালের আগস্টের শুরুতে রাশিয়ার সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার উপ প্রধান ইউরি ইভানভের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয় তুরস্কের সমুদ্র সৈকতে। অভিযোগ করা হয়, তাকে হত্যায় মোসাদ জড়িত। সিরিয়ার লাতাকিয়ার কাছ থেকে তিনি গুম হয়ে গিয়েছিলেন।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইতে ২০১০ সালের জানুয়ারিতে হত্যা করা হয় হামাসের সামরিক সিনিয়র কমান্ডার মাহমুদ আল মাহবুবকে। এ হত্যায়ও মোসাদ জড়িত বলে সন্দেহ করা হয়। এ নিয়ে তদন্ত হয়। সিসিটিভি সহ অন্যন্য তথ্য প্রমাণ যাচাই করে দেখা যায়, এই হত্যা মিশনে ভুয়া পাসপোর্ট ব্যবহার করে কমপক্ষে ২৬ জন গোয়েন্দা এজেন্ট সেখানে প্রবেশ করেছিল। এসব এজেন্ট মাহবুবের হোটেল কক্ষে প্রবেশ করে তাকে বৈদ্যুতিক শক দেয়। জিজ্ঞাসাবাদ করে। তার দরজা ভিতর দিক থেকে বন্ধ করা ছিল। যদিও সংযুক্ত আরব আমিরাত পুলিশ ও হামাস ঘোষণা দিয়েছে যে, এই হত্যার জন্য দায়ী ইসরাইল, তবে এ হত্যাকা-ে মোসাদ সরাসরি জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নি। যেসব এজেন্ট ভুয়া পাসপোর্ট ব্যবহার করে প্রবেশ করেছিল তার মধ্যে ৬ জনেরই ছিল বৃটিশ পাসপোর্ট। ইসরাইলে অবস্থান করছিল তারা। তাদের জাতীয়তার পরিচয় ব্যবহার করে পাসপোর্ট ক্লোন করা হয়। পাওয়া যায় পাঁচটি আইরিশ পাসপোর্ট। আরো ছিল অস্ট্রেলিয়ার পাসপোর্ট, জার্মান পাসপোর্ট, ফরাসি পাসপোর্ট। সংযুক্ত আরব আমিরাতের পুলিশ বলেছে, হামলাকারীদের কয়েকজনের আঙ্গুলের ছাপ ও ডিএনএন প্রমাণ হিসেবে পেয়েছেন তারা। এরপর দুবাইয়ের তখনকার পুলিশ প্রধান বলেন, আমি নিশ্চিত এ কাজ করেছে মোসাদ। এই হত্যাকান্ডের জন্য আমি ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও মোসাদ প্রধানকে গ্রেপ্তারের অনুরোধ পাঠিয়েছি দুবাইয়ের প্রসিকিউটরদের কাছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status