প্রথম পাতা

ভোটের আগে ডলারের বাজারে অস্থিরতা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

২৪ অক্টোবর ২০১৮, বুধবার, ১০:০০ পূর্বাহ্ন

নির্বাচনের আগে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। বৈদেশিক লেনদেনের অন্যতম মুদ্রা ডলারের সরবরাহে সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে অস্থিরতা বিরাজ করছে মুদ্রাটির দরে। দেশের ব্যাংকগুলোতে এখন নগদ ডলারের মূল্য সর্বোচ্চ ৮৬ টাকা ৫০ পয়সায় উঠেছে। আমদানি পর্যায়ের ডলারের দর উঠেছে ৮৩ টাকা ৮৫ পয়সা। এদিকে গত তিন মাস স্থির রাখার পর ডলারের বিপরীতে টাকার মান ধরে রাখতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি মাসে আন্তঃব্যাংক ডলারের দাম বেড়েছে ৮ পয়সা। পণ্য আমদানিতে প্রতি ডলারের জন্য চলতি মাসে ব্যবসায়ীরা পরিশোধ করেছেন ৮৩ টাকার উপরে। ফলে ব্যবসায়ীরা পড়েছেন বিপাকে। আর বড় আমদানি দায় শোধ করতে হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংকগুলো। এছাড়া যারা ভ্রমণ করতে বিদেশে যাওয়ার কথা ভাবছে, তাদের এক ডলার কিনতে হচ্ছে প্রায় ৮৭ টাকা দরে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশ কয়েকটি কারণে ডলারের দাম বাড়ছে। এর মধ্য সামপ্রতিক সময়ে মাত্রাতিরিক্তি আমদানি ব্যয়, পাচার, রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স-প্রবাহের নিম্নগতিকে ডলার সংকটের জন্য দায়ী করা হচ্ছে।

অর্থনীতিবিদরা জানান, দুইবছর ধরে দেশে ডলারের দাম বাড়ছে। অর্থাৎ টাকার মূল্যমান কমছে। তাছাড়া সামনে নির্বাচন। ব্যবসায়ীদের মাঝে এক ধরনের সংশয় কাজ করছে। ভোটের আগে কোনো অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হলে এর দায়টা দেশের অর্থনীতির উপর পড়বে। অপরদিকে দেশে আমদানি বেড়ে গেছে। রপ্তানি সেই হারে বাড়েনি। এর মানে হলো নামে-বেনামে দেশের বাইরে অর্থ পাচার হচ্ছে। যার কারণে ডলারের চাহিদা বেড়েছে।

ব্যাংক সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, আমদানি ব্যাপক হারে বাড়ছে। অনেক বড় বড় প্রকল্পের কাজ চলছে। তাতে সামনের দিনগুলোতে ডলারের উপর চাপ আরো বাড়তে পারে বলে মনে করছেন তারা। জানা গেছে, গত দুইবছর আগে এইদিনে ব্যাংকভেদে নগদ ডলারের দাম ছিল ৮১ থেকে সর্বোচ্চ ৮২ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ৪ থেকে ৫ টাকা বেড়েছে। এদিকে তিনমাস আটকে রাখার পর ডলারের বিপরীতে টাকার মান ধরে রাখতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি মাসে আন্তঃব্যাংক ডলারের দাম বেড়েছে ৮ পয়সা। ফলে প্রতি ডলারের বিনিময়মূল্য ৮৩ টাকা ৭৭ পয়সা থেকে ৮৩ টাকার ৮৫ পয়সা হয়েছে। মূলত আমদানির দায় শোধ করতে এ হার বেঁধে দেয়া হয়েছে। তবে খোলা বাজারে ডলারের দাম ৮৬ টাকা ৫০ পয়সা।

অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশ ভারতে গত তিনমাসে ডলারের দাম ভারতীয় মুদ্রায় ৫ থেকে ৬ রুপি বেড়েছে। ভারতে গত জুনে প্রতি ডলারের দাম বিনিময়মূল্য ছিল ৬৮.৮০ রুপি, গত শুক্রবার তা বেড়ে ৭৪ রুপি ছাড়িয়ে যায়। বলা হচ্ছে, দেশটির মুদ্রানীতিতে নীতি-নির্ধারণী সুদ হারের কোনো পরিবর্তন না আসার পরই ব্যাপক হারে রুপির দরপতন হয়। যেটা ভারতের ইতিহাসে রেকর্ড। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ভারতে যেভাবে রুপির মান হারাচ্ছে, তাতে বাংলাদেশ ডলারের আয় হারাতে পারে। এজন্য রপ্তানি ও প্রবাসী আয় ধরে রাখতেই টাকার মান কিছুটা ছাড় দেয়া হচ্ছে। আরো কয়েকদিন এমন প্রবণতা চলবে।
সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা এর সঠিক কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না। বিষয়টি নিয়ে রীতিমতো উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ ব্যাংক। তাদের মতে, অর্থনীতির সূচকগুলোতে কোথাও বড় ধরনের সমন্বয়হীনতা দেখা দিয়েছেন। যে কারণে ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিময় হারে এর প্রভাব পড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাজারে ডলারের সরবরাহ কম। চাহিদা বেশি। আবার আমদানি বাড়ছে, সেই হারে রপ্তানি বাড়ছে না। এতে বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েই চলেছে। আর এটি পূরণ করতে গিয়ে বাড়তি চাপে ডলারের দাম বেড়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ডলারের দাম বাড়লে রপ্তানিকারকরা লাভবান হয়। তবে সমস্যায় পড়ে আমদানিকারকরা। কারণ আমদানি ব্যয় বাড়লে স্থানীয় বাজারের পণ্যের দাম বেড়ে যায়। চাপ পড়ে মূল্যস্ফীতির উপর। এতে করে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যায়। ফলে সবচেয়ে কষ্ট হয় সাধারণ মানুষের। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে ডলার বিক্রি করে চাপ সামাল দেয়ার চেষ্টা করা দরকার। বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে রপ্তানি বাড়াতে হবে। কিভাবে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানো যায় তার উদ্যোগ নিতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের করা হালনাগাদ প্রতিবেদনে তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম দুইমাসে ইপিজেডসহ রপ্তানি খাতে বাংলাদেশ আয় করেছে ৬৭১ কোটি ৮০ লাখ ডলার। এর বিপরীতে আমদানি বাবদ ব্যয় করেছে ৮৮২ কোটি ৫০ লাখ ডলার। সেই হিসাবে আগস্ট শেষে দেশে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় ২১০ কোটি ৭০ লাখ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় (বিনিময় হার ৮৪ টাকা দরে) ১৭ হাজার ৬৯৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা ছাড়িয়েছে। যা গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের একই সময় ছিল ১৭৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের চলতি হিসাব ঋণাত্মক রয়েছে। তবে গত বছরের তুলনায় এ ঋণাত্মক কমেছে। অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে চলতি হিসাবে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৩৬ কোটি ৯০ লাখ ডলার। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাই শেষে ঘাটতি ছিল ২৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার।

দেশে বেসরকারি বিনিয়োগে ভাটা পড়েছে। বেপরোয়া গতিতে বাড়ছে আমদানি ব্যয়। এটিই রহস্যজনক। বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত এই আমদানির নাম করে দেশ থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমদানির নামে বিদেশে পাচার হচ্ছে টাকা। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্টেও এমন তথ্য উঠে এসেছে। এ ছাড়া নির্বাচনী বছরে এ রকম নানা ভয়ে অনেকে টাকা বিদেশে পাচার করছেন। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সামপ্রতিক সময়ে দেশের আমদানি ব্যয় যেভাবে বাড়ছে, তা স্বাভাবিক নয়। এখানে টাকা পাচারের যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে। তার মতে, নির্বাচনী বছরে টাকা পাচার বাড়ে। কারণ, যাদের কাছে উদ্বৃত্ত টাকা আছে, তারা দেশে রাখাকে নিরাপদ মনে করেন না। সম্পদশালীরা মনে করেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থির হলে তাদের জন্য সমস্যা হতে পারে। এ কারণে আমদানিসহ অন্যান্য মাধ্যমে পুঁজি পাচার করা হয়। তিনি বলেন, এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর পাচার রোধে তৎপরতা বাড়াতে হবে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status