প্রথম পাতা

সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর স্বীকারোক্তি

খাসোগি হত্যা মারাত্মক ভুল, সালমান জড়িত নয়

মানবজমিন ডেস্ক

২৩ অক্টোবর ২০১৮, মঙ্গলবার, ৯:৪০ পূর্বাহ্ন

সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যা ‘মারাত্মক ভুল’ বলে এর দায় স্বীকার করেছে সৌদি আরব। তারা সাফ জানিয়ে দিয়েছে, ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান ওই হত্যার নির্দেশ দেননি। সৌদি আরবের এমন ঘোষণায় দুনিয়াজুড়ে ক্ষোভ ও নিন্দার ঝড় উঠেছে। প্রথমবারের মতো শুক্রবার হত্যার কথা স্বীকার করে তারা। সৌদি কর্তৃপক্ষের এমন দাবির প্রেক্ষিতে দেখা দিয়েছে মারাত্মক সন্দেহ, সংশয়। অন্যদিকে হত্যায় ক্রাউন প্রিন্স জড়িত দাবি করে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন সিনেটর। সিনেটর রিচার্ড ডারবিন বলেছেন, ক্রাউন প্রিন্স এ হত্যায় জড়িত থাকলে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করা উচিত। জার্মান চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মার্কেল বর্তমান প্রেক্ষিতে সৌদি আরবের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ অনুমোদন করবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। ওদিকে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো সৌদি আরবের সাথে কয়েকশত কোটি ডলারের প্রতিরক্ষা চুক্তি বাতিল করার হুমকি দিয়েছেন।

সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আহমেদ আল-জুবেইর খাসোগি হত্যার পেছনে সৌদি ক্রাউন প্রিন্সের হাত রয়েছে এমন সকল দাবি নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি দাবি করেন, মোহাম্মদ বিন সালমান এ হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে কিছু জানতেন না। ফক্স নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আদেল আল-জুবেইর বলেন, এই হত্যাকাণ্ডটি কর্তৃপক্ষের নির্দেশের মাত্রাধিক প্রয়োগ। জামাল খাসোগিকে হত্যা করে হত্যাকারীরা ভুল করেছে। এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স, অনলাইন বিবিসি। কিন্তু এ চেষ্টা খাসোগি হত্যা থেকে মোহাম্মদ বিন সালমানকে দূরে সরিয়ে নিতে পারছে না। সৌদি আরবের দাবি, ২রা অক্টোবর খাসোগি ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে প্রবেশ করলে তাকে জেরা করা হয়। এক পর্যায়ে তিনি মারমুখী হয়ে উঠলে মারামারির এক ঘটনায় খাসোগি নিহত হন। প্রশ্ন উঠেছে তাকে হত্যা করা হলে মৃতদেহ কি করা হয়েছে? কিন্তু সৌদি কর্মকর্তারা বলতে পারছেন না জামাল খাসোগির মরদেহ কোথায় রয়েছে। এতে সৌদি আরবের সর্বশেষ ভাষ্যের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুবেইর ফক্স নিউজকে আরো বলেন, যারা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল তারা কেউই ক্রাউন প্রিন্সের ঘনিষ্ঠজন ছিল না। এমনকি সৌদি আরবের গোয়েন্দা সংস্থার উচ্চপদস্থ নেতারাও এ বিষয়ে অবগত ছিলেন না। এ সময় তিনি আরো জানান, খাসোগির মৃতদেহ কোথায় রয়েছে তা সৌদি আরব এখনো জানে না। তিনি দাবি করেন, তুরস্কের কাছে হত্যাকাণ্ডের অডিও প্রমাণ রয়েছে এরকম দাবি সমপর্কে তিনি কিছু শুনেননি। ফক্স নিউজ জুবেইরকে খাসোগির মারামারির বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, হত্যার প্রেক্ষাপট এখনো তদন্তাধীন রয়েছে। আমরা বের করার চেষ্টা করছি কনস্যুলেটের মধ্যে কি ঘটেছিল। এদিকে, রোববার সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম সৌদি প্রেস এজেন্সি জানিয়েছে, খাসোগির ছেলে সালাহর প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন বাদশাহ সালমান ও ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান। খবরে বলা হয়, বাদশাহ ও ক্রাউন প্রিন্সকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন খাসোগির ছেলে। সালাহ খাসোগি বসবাস করেন সৌদি আরবে। ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল বলছে, খাসোগি যুক্তরাষ্ট্র অবস্থানকালে তার সাথে সাক্ষাত করতে দেশ ছাড়ার ক্ষেত্রে সালাহর ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। একইদিনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুবেইরও খাসোগির পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। ফক্স নিউজকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, এটি একটি ভয়াবহ বিয়োগান্তক ঘটনা। আমরা তার পরিবারের দুঃখ উপলব্ধি করতে পারছি। এসময় তিনি খাসোগির পরিবারকে আশ্বস্ত করে বলেন, দুর্ঘটনাবশত একটি বড় ভুল হয়ে গেছে। যারা এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিল তাদেরকে যথাযথ শাস্তির মুখোমুখি করা হবে।

সৌদি আরব ১৮ দিন ধরে ইস্তাম্বুলে দেশটির কনস্যুলেটে সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যার কথা অস্বীকার করে এসেছে। শুক্রবার প্রথমবারের মতো খাসোগি হত্যার কথা স্বীকার করে নেয় দেশটি। এ হত্যার পেছনে তারা যে ব্যাখ্যা দিয়েছে তা বিশ্বনেতারা অগ্রহণযোগ্য বলে স্বচ্ছ তদন্ত নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছেন। এরমধ্যে সৌদি ভাষ্যও পরিবর্তিত হয়েছে কয়েকবার। প্রত্যেকটি ভাষ্যতেই দাবি করা হচ্ছে, দেশটির ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানকে নির্দোষ ও এ হত্যার পেছনে তার কোনো হাত নেই। এদিকে, সাংবাদিক জামাল খাসোগির হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে সব সত্য প্রকাশ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগান। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের রাখঢাক করা হবে না। রোববার দেশটির বার্তা সংস্থা আনাদোলু এ খবর দিয়েছে। সেখানে এরদোগানের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, মঙ্গলবার খাসোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে পূর্ণ তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করবেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট।

ইস্তাম্বুলে দেয়া এক ভাষণে এরদোগান বলেন, মঙ্গলবার দলীয় বৈঠকে তিনি এ বিষয়ে সকল সত্য প্রকাশ করবেন। কেন সৌদি আরব থেকে ১৫ সদস্যের বিশেষ টিম কনস্যুলেটে এসেছিল। সৌদির পক্ষ থেকে এসব বিষয়ে বিস্তারিত আমাদের বলতে হবে। সপষ্টতই এতে সৌদি আরবের এই বয়ান হুমকির মুখে পড়েছে। এরদোগান ঘোষণা করেছেন, খাসোগি হত্যা তিনি সবরকম দিক থেকে আলাদা আলাদা ভাবে ব্যাখ্যা করবেন। তিনি বলেন, আমরা ন্যায়বিচার চাই। এই তদন্ত সব নগ্ন মিথ্যাচারের খোলস খুলে দেবে। খাসোগি হত্যার প্রেক্ষাপট পুরোপুরি উন্মোচন করা হবে।

জামাল খাসোগিকে ইস্তাম্বুলের সৌদি কন্স্যুলেটে হত্যার কথা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে নেয়ার পর সৌদি আরবকে শাস্তি দিতে চাপ বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের ওপরে। রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটরা যুক্তরাষ্ট্রের এই আরব মিত্রের বিরুদ্ধে নানা শাস্তির প্রস্তাব দিয়ে চলেছেন। এরমধ্যে সর্বাত্মক নিষেধাজ্ঞা থেকে অস্ত্র চুক্তি বাতিলও রয়েছে। তবে এসবই নির্ভর করছে খাসোগি হত্যায় মোহাম্মদ বিন সালমানের সংশ্লিষ্টতার ওপরে। তার নির্দেশেই খাসোগিকে হত্যা করা হয়েছে প্রমাণিত হলে সৌদি আরবের সামনে ভয়াবহ সংকট অপেক্ষা করছে। সিএনএনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সিনেটর বব করকের বলেন, আমার ধারণা সালমান এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। তিনি এ হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করেছেন এবং খাসোগিকে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ীই হত্যা করা হয়েছে। করকের সৌদি আরবের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, ফ্রান্স ও জার্মানির সম্মিলিত চাপ প্রয়োগের আহ্বান জানান। এ ছাড়া এনবিসিতে দেয়া সাক্ষাৎকারে সিনেটর রিচার্ড ডারবিন বলেন, সৌদি ক্রাউন প্রিন্স এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকলে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করা উচিত।

খাসোগির হত্যা নিয়ে সৌদি বয়ানের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে ইউরোপীয় শক্তি বৃটেন, জার্মানি ও ফ্রান্স। এক যৌথ বিবৃতিতে বৃটেন, জার্মানি ও ফ্রান্স বলেছে, এই হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। সৌদি কন্স্যুলেটে কি হয়েছিল সেটা জানার জন্য আরো স্বচ্ছ তদন্ত দরকার। বিবৃতিতে তারা খাসোগি হত্যা নিয়ে সৌদি আরবের ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান করেছে। হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, রোববার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রামপ ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রনের সঙ্গে খাসোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে কথা বলেছেন। এতসব বিতর্কের মধ্যেই সৌদি আরব প্রিন্স সালমানকে নির্দোষ দাবি করে তাদের পূর্বের বয়ানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নতুন ভাষ্য প্রকাশ করলো।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status