এক্সক্লুসিভ

৪ বছরে পোশাক শিল্পের ২ সহস্রাধিক কারখানা বন্ধ

এমএম মাসুদ

২৩ অক্টোবর ২০১৮, মঙ্গলবার, ৮:৩৪ পূর্বাহ্ন

উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, কারখানা সংস্কার চাপ, বিশ্ববাজারে পোশাকের দর ও চাহিদা কমায় গত ৪ বছরে পোশাক শিল্পের ২০০০টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। এর মধ্যে বিজিএমইএ থেকে বাদ পড়েছে ১,২০০টি কারখানা। আর বিকেএমইএ থেকে বাদ পড়েছে ৮০০টি। এর মধ্যে পোশাক খাতের সংস্কার বিষয়ক ইউরোপের ক্রেতাজোট অ্যাকর্ড থেকে বাদ পড়েছে ১৪৪টি। অপর ক্রেতাজোট উত্তর আমেরিকার অ্যালায়েন্স থেকে বাদ পড়েছে ১৫৭টি কারখানা। অর্থাৎ সংস্কারে অগ্রগতি দেখাতে ব্যর্থ হওয়ায় দুই জোট থেকে বাদ পড়েছে ৩১১টি কারখানা। পোশাক খাতের বাইরেও কারখানা বন্ধ হয়েছে ১০১৮টি। সবমিলিয়ে গত ৪ বছরে ৩ সহস্রাধিক কারখানা উৎপাদনে নেই। এ সংখ্যা আরো বাড়বে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। তবে এর বিপরীতে আলোচ্য সময়ে নতুন কারখানা গড়ে উঠেছে প্রায় ৪ শতাধিক।
এদিকে সম্প্রতি সংস্কার ব্যর্থতার দায়ে ২১৯টি কারখানার ইউডি সেবা বন্ধ করে দিতে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ’র প্রতি নির্দেশনা দিয়েছে প্রতিষ্ঠান কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের (ডিআইএফই)। এসব কারখানার মধ্যে ১৩৪টি বিজিএমইএ’র সদস্য। বাকি ৭৪ কারখানা বিকেএমইএ’র সদস্য। অর্থাৎ ২১৯টি বন্ধ হলে কারখানা বন্ধ হওয়ার তালিকা ৩৫১১টিতে গিয়ে দাঁড়াবে।

বিপুল সংখ্যক কারখানা উৎপাদনে না থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি কমেনি। আবার রপ্তানিতে বড় ধরনের অগ্রগতিও হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলেন, সব চালু থাকলে দেশের রপ্তানি আয় বহুগুণ বেড়ে যেত। কিন্তু আমাদের রপ্তানি আয় কমেনি। কারণ ছোট-মাঝারি কারখানা বন্ধ হলেও বড় মানের অনেক কারখানার সমপ্রসারণ হচ্ছে। সে কারণে রপ্তানি কমেনি। এ ছাড়া নতুন কিছু কারখানা বিজিএমইএ সদস্য তালিকায় যুক্ত হয়েছে।

সূত্র জানায়, আয়-ব্যয়ের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারায় কারখানাগুলো বন্ধ হওয়ার প্রধান কারণ। একদিকে বাড়ছে উৎপাদন খরচ, অন্যদিকে কমছে পোশাকের দর। একই সঙ্গে বিশ্ববাজারে কমছে পোশাকের চাহিদা। এর মধ্যে সংস্কারের জন্য গড়ে ৫ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। ছোট-মাঝারি মানের কারখানাগুলোর (এসএমই) সংস্কারে ব্যয় গড়ে ২ কোটি টাকার মতো। এসব কারখানার মালিকদের কাছে এ অঙ্কই অনেক বড়। আবার এ কারখানাগুলোতে রপ্তানি আদেশও আগের তুলনায় কম। এ কারণে ছোট-মাঝারি মানের কারখানাই বেশি বন্ধ হয়েছে।

বন্ধ হওয়া এক কারখানা মালিক জানান, কারখানা সংস্কারের জন্য অর্থ জোগাড় করতে পারেননি। নতুন করে অর্থ দিতে রাজি হয়নি কোনো ব্যাংক। ফলে এক বছর অচল থাকার পর একপর্যায়ে কারখানাটি বন্ধ করতে বাধ্য হই।
বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, গত ৪ বছরে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১৮ শতাংশ। এ সময় প্রধান দুই বাজার ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে দর কমেছে গড়ে প্রায় ৭ শতাংশ। আর বিশ্ববাজারে পোশাকের চাহিদা কমেছে ৮ শতাংশ। এই তিন প্রতিকূলতায় বাণিজ্যিকভাবে মুনাফা কমছে পোশাক খাতে। এর প্রভাবে পোশাকের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ১৫ বছরে সর্বনিম্নে নেমে আসে গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে। গত অর্থবছরে বেড়ে হয়েছে ৮.৭৬ শতাংশ। অথচ ২০১৩ সালের ২৪শে এপ্রিল রানা প্লাজা ধসের বছরেও রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি এতটা কম ছিল না। ওই বছরের এপ্রিলের পর জুন পর্যন্ত তিন মাসের খারাপ সময় সত্ত্বেও ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ শতাংশ।

বিজিএমইএ’র সহসভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, গত কয়েক বছরে কারখানা বন্ধ হলেও বড় মানের অনেক কারখানা সমপ্রসারণ হয়েছে। এ ছাড়া বেশ কিছু নতুন কারখানা গড়ে উঠেছে। এর পরিমাণ প্রায় ৪ শতাধিক। সে কারণে রপ্তানি কমেনি। জানা গেছে, সংস্কারে অর্থ সহায়তা হিসেবে আইএফসি, জাইকাসহ কয়েকটি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ০.৫ শতাংশ সুদে ঋণদানে পৃথক তহবিল করেছে। উদ্যোক্তাদের হাতে আসতে সুদ বেড়ে ৯ থেকে ১০ শতাংশে দাঁড়ায়। এ কারণে উদ্যোক্তারা ঋণ নিচ্ছেন না। সংস্কারে আর্থিক সহায়তা দেয়ার কথা ছিল অ্যাকর্ড অ্যালায়েন্সের পক্ষ থেকেও। তবে মেয়াদের শেষ মুহূর্তে এসে গত মে মাসে মাত্র ৫ কারখানাকে ৪ কোটি টাকার অর্থ সহায়তা দিয়েছে অ্যাকর্ড। বন্ধ কারখানার শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধে কয়েকটি কারখানাকে আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়েছে অ্যালায়েন্সের পক্ষ থেকে। এর বাইরে সরাসরি আর কোনো অর্থ সহায়তা দেয়নি ক্রেতারা।

জানা গেছে, শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের (ডিআইএফই) অধীনে ১ হাজার ৮২৭টি কারখানার সংস্কার চলছে। এর মধ্যে প্রাথমিক পরিদর্শনে বাদ পড়া এবং সংস্কারের ব্যয় জোগানে ব্যর্থতাসহ ১০১৮টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। সূত্রে জানা গেছে, ডিআইএফই’র অধীনে কারখানা এখন মাত্র ৮০৯টি। এদিকে সংস্কার চালিয়ে যেতে ব্যর্থতার দায়ে ২১৯টি কারখানার ইউডি সেবা বন্ধ করে দিতে সমপ্রতি বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ’র প্রতি নির্দেশনা দিয়েছে ডিআইএফই। এসব কারখানার মধ্যে ১৩৪টি বিজিএমইএ’র সদস্য। বাকি ৭৪ কারখানা বিকেএমইএ’র সদস্য। শিগগিরই এসব কারখানাও বন্ধের তালিকায় যুক্ত হতে যাচ্ছে।  বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ব্যাংক ঋণ দিতে চায় না। অর্থের সংস্থান থাকলে বন্ধ হতো না কারখানাগুলো। তবে নতুন করে যাতে আর কোনো কারখানা ঝরে না পড়ে সেজন্য কাজ করছে বিজিএমইএ। সে উদ্দেশ্যে মিরসরাই পোশাক পল্লীতে ছোট-মাঝারি কারখানাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে বিজিএমইএ। আর বন্ধ করতে হলে আলোচনার মাধ্যমে বন্ধ করতে হবে। কারণ, এখানে অনেক শ্রমিকের স্বার্থ জড়িত। কারখানা বন্ধ হলে শ্রমিকরা যাবে কোথায় বলে প্রশ্ন রাখেন তিনি।

এদিকে কারখানা বন্ধে সবচেয়ে সংকটে পড়েছে মালিকপক্ষ। অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ঋণে জর্জরিত হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন বলে মনে করে বিকেএমইএ।

জাতীয় গার্মেন্ট শ্রমিক-কর্মচারী লীগ সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, কারখানা বন্ধ হওয়ায় অনেক শ্রমিক বেকার হয়েছে। অনেকে ভিন্ন পেশায় যোগ দিয়েছে। ক্ষুদ্র ব্যবসা করছে কেউ কেউ। অনেক মালিক বলছেন, টাকা নেই; তাই কারখানা চালাতে পারছেন না। কাজ না করিয়ে শ্রমিকদের অর্থ দেবেন কীভাবে?

উল্লেখ্য, বিজিএমইএ’র নিবন্ধিত তৈরি পোশাক কারখানার সংখ্যা প্রায় ৬ হাজার। এর মধ্যে বিভিন্ন সময় নানা কারণে ২ হাজারের বেশি কারখানা বন্ধ করা হয়েছে। এসব কারখানা বাদ দিলে নিবন্ধিত কারখানার সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ হাজার। আর সরাসরি রপ্তানি করে এমন কারখানার সংখ্যা রয়েছে ২ হাজারের অধিক। এরা বিজিএমইএ থেকে ইউডি (ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন) সুবিধা নেয় না। মূলত এসব কারখানা সাব-কন্ট্রাকটিংয়ে কাজ করে। দেশের ইপিজেডগুলোতে প্রায় ৭০টি (রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা) শতভাগ বিদেশি মালিকানার তৈরি পোশাক কারখানা রয়েছে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে আরো শতাধিক কারখানা রয়েছে বিদেশিদের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে। মূলত শতভাগ বিদেশি মালিকানা বা যৌথ মালিকানাধীন কারখানাগুলো গড়ে উঠেছে ইপিজেডে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status