এক্সক্লুসিভ

নির্বাচনকে সামনে রেখে পাহাড়ে চলছে সশস্ত্র তৎপরতা

কাজী সোহাগ, পার্বত্য অঞ্চল থেকে

২৩ অক্টোবর ২০১৮, মঙ্গলবার, ৮:২৯ পূর্বাহ্ন

ফাইল ছবি

জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে শুরু হয়েছে সশস্ত্র তৎপরতা। বিভক্ত উপজাতি সংগঠনগুলোর সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা এর সঙ্গে জড়িত। এতে গত কয়েক মাসে পার্বত্য এলাকাগুলোতে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটেছে। শেষ ১০ মাসে এসব এলাকায় খুন হয়েছেন ৪০ জনেরও বেশি মানুষ। নির্বাচনী এলাকা ও নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ছে আঞ্চলিক সংগঠনগুলো। সরজমিন পার্বত্য এলাকার বিভিন্ন শ্রেণির মানুষদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা যায়। স্থানীয়রা জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামের ৪টি আঞ্চলিক সংগঠন তথা জেএসএস (সন্তু গ্রুপ), ইউপিডিএফ (প্রসীত গ্রুপ), জেএসএস (এমএন লারমা গ্রুপ) এবং ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক গ্রুপ) তৎপর রয়েছে। এসব সংগঠন আধিপত্য বিস্তার করতে একের পর এক খুন, গুম, অপহরণসহ নানা ধরনের সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। তবে তাদের টার্গেট শুধু প্রতিপক্ষ আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠনগুলোই নয়, জাতীয় রাজনৈতিক মূলধারার দল।

বিশেষ করে আওয়ামী লীগের উপজাতি নেতৃবৃন্দও এই হামলার শিকার হচ্ছেন অহরহ। সংশ্লিষ্টরা জানান, নির্বাচনে জয় লাভের আশায় উপজাতি সংগঠনগুলোর এই সশস্ত্র কার্যক্রম কিন্তু হঠাৎ করে শুরু হয়নি। একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করেই তারা তাদের নীলনকশা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছে। এ কাজে তারা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকেও প্রতিপক্ষকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছে। সামপ্রতিক ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো- গত ৩রা মে রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শক্তিমান চাকমাকে প্রতিপক্ষ ইউপিডিএফ (প্রসীত গ্রুপ) কর্তৃক গুলি করে হত্যা। শক্তিমান চাকমা ছিলেন জেএসএস এমএন লারমা দলের সমর্থক। এলাকায় তার জনপ্রিয়তা ছিল অনেক বেশি। যদিও একসময় নানিয়ারচর উপজেলা ছিল ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটি। কিন্তু গত উপজেলা নির্বাচন থেকে তাদের সেই নিয়ন্ত্রণ খর্ব হতে থাকে। আধিপত্য থাকা সত্ত্বেও স্থানীয়দের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় শক্তিমান চাকমার কাছে হেরে যায় ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপের প্রার্থী সুশীল জীবন চাকমা। এর পরই নানিয়ারচরের অধিকাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় জেএসএস (এমএন লারমা) দলটির কাছে।

সেই সঙ্গে জেএসএস (এমএন লারমা) দলের সঙ্গে হাত মেলায় নব গঠিত ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক দলও। ফলে নানিয়ারচরে তাদের নিয়ন্ত্রণ হারানোর বিষয়টি মেনে নিতে পারছিল না ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপ। যার কারণে ‘টার্গেট কিলিং’-এ ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে শক্তিমান চাকমা ও ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের প্রধান নেতা তপন জ্যোতিকে নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করে তারা। ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপের ধারণা ছিল, শক্তিমান ও তপন জ্যোতির মৃত্যুর পর নানিয়ারচরে তাদের ফের নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। শক্তিমান চাকমা এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হলে তার জয় সুনিশ্চিত ছিল বলে অনেকের ধারণা। সেই ধারণা থেকেই শক্তিমান ও তপন জ্যোতিকে হত্যা করে ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপ। তবে শক্তিমান ও তপন জ্যোতিকে হত্যা করেই ক্ষান্ত নয় ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীরা। তারা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে প্রকাশ্যে প্রতিপক্ষ দলের অন্য নেতাদেরও হত্যার হুমকি দিয়ে আসছে। স্থানীয়রা জানান, অতীতের মতো সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতিকে কেন্দ্র করে পার্বত্য এলাকায় হানহানি বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে চাঁদাবাজির ঘটনাও।

তারা জানান, নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে পরিস্থিতি ততই ঘোলাটে হচ্ছে। উপজাতি সংগঠনগুলোর সশস্ত্র তৎপরতায় আতঙ্কের মধ্যে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। পার্বত্য এলাকায় কাজ করছেন এমন গোয়েন্দারা জানান, নির্বাচনকে টার্গেট করে সশস্ত্র গ্রুপগুলো ব্যাপক তৎপর হয়ে উঠেছে। নিজেদের শক্তিমত্তা বোঝাতে বিভিন্ন ধরনের মারণাস্ত্র ব্যবহার করছে তারা। রাজনীতিবিদদের ওপর সশস্ত্র গ্রুপগুলো কি ধরনের ভূমিকা পালন করেছে তা কয়েকটি ঘটনা থেকে বোঝা যায় বলে জানান স্থানীয়রা। তারা জানান, আওয়ামী লীগ করার অপরাধে খাগড়াছড়ি জেলার লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার বর্মাছড়ি ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সভাপতি নীলবর্ণ চাকমাকে ২০১৬ সালের ২৯শে নভেম্বর অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে নিয়ে যায় ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপের ১০-১২ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসী। সেদিন খাগড়াছড়িতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের জনসভায় যোগ দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন নীলবর্ণ। ভাগ্য ভালো নীলবর্ণ চাকমার। অপহরণকারীদের কাছ থেকে তিনি ফিরে আসতে পেরেছিলেন।

কিন্তু পার্বত্য তিন জেলায় এরকম অনেকেই আছেন যারা আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা মূলধারার রাজনীতি করার অপরাধে অপহৃত হয়ে লাশ হয়ে ফিরেছেন। আবার কেউবা মুক্তিপণ দিয়ে ফিরেছেন। অনেকেই আছেন যারা অপহরণের পর তাদের পরিবার এখনও জানে না তিনি বেঁচে আছেন, নাকি মারা গেছেন। যেমনটি হয়েছে বান্দরবানের আওয়ামী লীগ নেতা মংপ্রু মারমার ক্ষেত্রে। ২০১৬ সালের ১৩ই জুন জেএসএস (সন্তু লারমার গ্রুপ) কর্তৃক অপহৃত হন তিনি। এরপর থেকে অদ্যাবধি খোঁজ নেই তার। স্বামীর অপেক্ষায় আজো পথপানে চেয়ে চোখের পানি ফেলছেন মংপ্রু মারমার স্ত্রী সামা প্রু মারমা।

২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রাঙ্গামাটির জুরাছড়ি উপজেলায় প্রায় সাড়ে ৪শ’ উপজাতি সমপ্রদায়ের লোক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। এরপর অনেকেই জেএসএস সন্তু গ্রুপের হুমকির কারণে আর আওয়ামী লীগে সক্রিয় থাকতে পারেননি। বিশেষ করে ২০১৭ সালের শেষের দিকে জেএসএস সন্তু গ্রুপের হুমকির মুখে আওয়ামী লীগ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে রাঙ্গামাটির জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি ও বাঘাইছড়ির শত শত উপজাতি। একইভাবে আওয়ামী লীগ করার অপরাধে গত বছরের ৫ই ডিসেম্বর বিলাইছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি রাম চরণ মারমা ওরফে রাসেল মারমাকে পিটিয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় ফেলে রেখে যায় জেএসএস সন্তু গ্রুপের ১০-১২ জনের একটি দল। ওই দিনই রাত ৮টার দিকে জুরাছড়ি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও উপজেলা আওয়ামী যুবলীগের সহসভাপতি অরবিন্দু চাকমাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ৬ই ডিসেম্বর মধ্য রাতে নিজ ঘরে ঢুকে মহিলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ঝর্ণা খীসা ও তার পরিবারের আরো দুই সদস্যকে কুপিয়ে জখম করা হয়। এরও আগে গত বছরের ২০শে নভেম্বর বিলাইছড়িতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি স্বপন কুমার চাকমা, যুবলীগ নেতা রিগান চাকমা, ইউপি সদস্য অমৃত কান্তি তঞ্চংগ্যা, কেংড়াছড়ি মৌজার হেডম্যান সমতোষ চাকমাকে মারধরের ঘটনা ঘটে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status