এক্সক্লুসিভ

আমার মায়ের গল্প

সাকিব রহমান

২২ অক্টোবর ২০১৮, সোমবার, ৭:৫৫ পূর্বাহ্ন

ছোটবেলায় রাজা-রানী’র গল্প শুনতে শুনতে কল্পনায় মা’কে রানী বানাতাম। আমার সেই কল্পনা সত্যি হয়েছে। আমার কাছে এখন মা রানী হয়েই আছেন। মা’কে নিয়ে গল্প বলার আগে একটা ভাবনার কথা বলি, আমার সব সময় মনে হয় সৃষ্টিকর্তা একদিন ভাবলেন, তার সৃষ্টি এই আমাকেও অন্য সবার মতো পৃথিবীতে পাঠাবেন, তিনি খুঁজলেন আধার এবং বেছে নিলেন আমার মা’কে। বলছি একজন মানুষ লবি রহমানকে নিয়ে। যিনি মা’ শব্দটার গভীরতা ছুঁয়েছেন মমতা দিয়ে।
ছোটবেলা থেকে স্বাধীনচেতা মা লেখাপড়া, খেলাধুলা, নাচগান সব কিছুই সমান তালে করেছেন। তখন বিটিভি ছিল একমাত্র চ্যানেল। সেখানেই কাজ শুরু, আজও করছেন। বড় সন্তান হওয়ার সুবাদে আদরের কমতি ছিল না। অথচ এই মানুষটিই অস্বাভাবিক কষ্ট করেছেন এবং এখনো করছেন।
বাবা-মা’র ভালোবাসার বিয়ে এবং বেশ অল্প বয়সেই। বাবা সেনাবাহিনীতে ছিলেন তাই কম বয়সে বিয়ের কারণে তাকে শাস্তি পেতে হয়েছে। দুজন সুখী মানুষের জীবনযাপনে এই শাস্তি কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। বন্ধুর মতো একসঙ্গে পথ চলেছেন তারা। তাদের একমাত্র স্বপ্ন ছিলাম আমি। বাবার পোস্টিং বেশিরভাগ সময় থাকতো ঢাকার বাইরে। কিন্তু আমার ভবিষ্যৎ চিন্তায় মা সব সময় ঢাকায় থেকেছেন। তাদের ইচ্ছে ছেলে স্কলাস্টিকায় পড়ুক কিন্তু বাবার সে সময়ের বেতনে তা কুলিয়ে ওঠা সম্ভব ছিল না। মা সংসারের প্রয়োজনে শুরু করলেন একটি ইংলিশ স্কুলে শিক্ষকতা। রান্নার দিকে ঝোঁক থাকায় মা সুযোগ পেলেই দেশে বা বিদেশে রান্নার কোর্স করতেন। এবার শিক্ষাটা কাজে লাগিয়ে শুরু করলেন ক্যাটারিং। খুব ভোরে উঠে নামাজ পরে শুরু করতেন দিনের কর্মব্যস্ততা, আমাকে গুছিয়ে দেয়া, স্কুলের টিফিন, দুপুরের খাবার, বিকালের নাস্তা সব তার নিজের বানানো। নিজের খাবারের কথা না ভেবে স্কুলের ক্যাটারিংয়ের খাবারের ভাবনাই বেশি ভাবতেন তিনি।
কাজ সেরে ফিরতেন দুপুরে, ব্যাগ তখন ততটা ভারী থাকতো না, বাস থেকে নেমে হেঁটে আসতেন মা। কেনো হেঁটে ফিরতেন এর কোনো উত্তর তিনি না দিলেও এখন বুঝি, কারণটা ছিল রিকশা ভাড়া বাঁচানো। কি রোদ কি বৃষ্টি বা শীত, মা আমার একই রকম এবং সব সময় হাসিমুখে। আমার খাবার ঠিক আছে কিনা, গরম ঠিক মতো হলো কিনা এই সব ভাবনার পাশাপাশি তার খাবারের সময় হলে ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে গরম না করেই খেয়ে নিতেন মা সময় বাঁচাতে। আমার ঘুমের সময় মা ছুটতেন নিজের বুটিক হাউসে।
সেখানে ড্রেস ডিজাইন থেকে শুরু করে কর্মচারীদের সব কাজ বুঝিয়ে দিয়ে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে মা আবারো ব্যস্ত হয়ে পড়তেন আমাকে নিয়ে। মাঝে মধ্যেই আমার ভাবনায় উঁকি দেয় এক অপরাধবোধ, বাবার সঙ্গে তার পোস্টিং এলাকায় গেলে কি হতো? কি হতো গ্রামের কোনো স্কুলে পড়লে? তাহলে তো মা-বাবা একসঙ্গে থাকতেন। ভালোবাসার যে বন্ধন ছিল তাদের তাতে দূরে থাকাটা কতটা কষ্টের সেটা এখন অনুভব করতে পারি। বুঝতে পারি, আমার মা এবং বাবা আমার জন্য কতটা ত্যাগ স্বীকার করেছেন?
আমি যখন জন্মেছি বাবা ছিলেন জুনিয়র অফিসার। সেনাবাহিনীর সুযোগ-সুবিধাও ছিল খুব কম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জীবন বদলায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগেই বাবা কর্নেল হয়ে ভিআইপি মর্যাদায় ঢাকায় বদলি হলেন। ততদিনে মা হয়ে উঠেছেন রন্ধনশিল্পী এবং ঐ সময়েই একটা বেসরকারি চ্যানেলে তিনি রন্ধনশিল্পীদের অনুষ্ঠান উপস্থাপনার দায়িত্ব পান। এরইমধ্যে বাবা চলে যান জাতিসংঘের মিশনে সুদান। আমি স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম, মিশন থেকে ফিরে বাবা ঢাকায় থাকবেন। আমরা এক সঙ্গে থাকবো। মা’কে আর কষ্ট করতে হবে না। আবারো সন্ধ্যায় বারান্দা থেকে ভেসে আসবে তাদের কণ্ঠ ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’।
স্বপ্ন পূরণ হলো না, আমার বাবা মেঘের দেশে চলে গেলেন। একা করে রেখে গেলেন আমাদের দুজনকে। পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের প্রথম দিনই বাবা শহীদ হলেন আরো ছাপান্ন জন নির্ভীক সহকর্মীর সঙ্গে। কি অদ্ভুত ভাবে আমরা তাকে ছাড়াই বেঁচে আছি, সত্যি কি তাকে ছাড়া? না বাবা আছেন আমাদের সঙ্গেই, ভাবনায়, স্বপ্নে এবং ভালোবাসায়।
মা’কে নিয়ে লিখছি কিন্তু তাকে কোনো দিনও বলা হয়নি আমার স্বপ্নের কথা। মনের অব্যক্ত কথা গুনগুন করে মনেই ভেসে বেড়ায়, বলা হয়ে ওঠে না “মা আমার জীবনে তুমি সেই মানুষ যাকে ছাড়া আজকের আমি, আমি হতাম না। অনেক ভালোবাসি তোমাকে, হয়তো কখনো বলিনি কিন্তু বিশ্বাস করি, না বলতেই তুমি সেটা বোঝো, আমার মনের খুব ভেতরে যে ছোট্ট পৃথিবী সেখানেই তোমাকে রেখেছি যত্ন করে, আমার ভালোবাসায়, শ্রদ্ধায়। তুমি বলো- ‘কিচ্ছু চাই না, শুধু চাই তুমি মানুষ হও’, আজকে তোমার জন্মদিনে কথা দিচ্ছি, আমি তোমার আর বাবার চাওয়ার মতো মানুষ হতে চাই। আবারো বলছি- মা ভালোবাসি তোমাকে...।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status