দেশ বিদেশ

ছেলে হারানোর কথা কেমনে বলি মাকে

ইমরান শুভ্র, ইবি থেকে

২১ অক্টোবর ২০১৮, রবিবার, ৯:১৬ পূর্বাহ্ন

দুঃসংবাদের ফেরিওয়ালা হয়ে গেছি। প্রতিদিন নিজের হাতে লিখছি কত ঘটনা। পত্রিকাতে দেশবাসীকে জানাই নানা অঘটন। কিন্তু একজন মাকে কীভাবে ছেলে হারানোর খবর দিতে হয়? আমার জানা নেই। ছেলে হারানোর কথা কেমনে বলি মাকে? সাংবাদিকতা আর বড় ভাই হওয়ায় দায়িত্বটা নিতে হলো আমাকেই। কিন্তু কথা বলতে গিয়েই বাঁধলো বিপত্তি। গলাটা বসে যাচ্ছিল। ওপাশে খালাম্মা শান্ত। কি হয়েছে বাবা? আমার ছেলে কোথায়? খালুকে চাইলাম। জবাব দিলেন, তিনি বাজারে। ততক্ষণে বড় ভাই দেলওয়ার ফোন দিচ্ছিলেন ছোট ভাইয়ের ফোনে। রিসিভ করলাম না। ওখান থেকে নাম্বার নিয়ে নিজে কল করলাম। জানালাম তার ভাই খুব অসুস্থ। অনেক রোগ বাসা বেঁধেছে তার দেহে। আমার ভাইয়ের কি হয়েছে? আমি চুপসে আছি। মনে হচ্ছিল ফাঁস নেয়া সেই দড়িটা আমার গলায় এঁটে ধরেছে কেউ। বারবার বলতে গিয়ে আটকে যাচ্ছিলাম। শুধু একটা কথাই বললাম। নাজমুলকে আমরা বাঁচাতে পারলাম না। ওপারে স্তব্ধতা। আর কোনো আওয়াজ পাইনি।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাজমুল হোসাইন। আইন বিভাগের ৩য় বর্ষের ছাত্র। সাতক্ষীরা জেলার তালা থানার বারাত গ্রামের আবদুল মালেক গাজীর ছোট ছেলে। স্বপ্ন ছিল এসপি হওয়া। জুডিশিয়ারির পড়া বাদ দিয়ে বিসিএস-এর প্রস্তুতি শুরু করে ক’দিন আগে। দুই বর্ষ মিলে একাডেমিক রেজাল্ট ছিল ৩.১৮। কিন্তু গত এক বছর ধরে তার শরীরে বাসা বেঁধেছিল বেশ কয়েকটি রোগ। দীর্ঘদিন ধরে তার প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট ছিল। নিয়মিত ইনহেলার নিতে হতো। খাওয়া লাগতো কয়েক রকমের ওষুধ। চোখে ছিল ব্যথা। ঝাঁপসা দেখতো প্রায়ই। গত বুধবার কুষ্টিয়ার দারুস শেফা হাসপাতালে চোখ দেখিয়ে এসেছে। একই সঙ্গে ছিল প্রচণ্ড মাইগ্রেনের ব্যথা। এতকিছুর ওপর নাজমুল হাইপ্রেসারে ভুগতো। এসব রোগ থেকে সে কোনোভাবেই মুক্তি পাচ্ছিল না। সেই থেকে তার হতাশা শুরু। প্রায়ই বন্ধুদের বলতো আমি মরে যাবো। আত্মহত্যা করবো। বন্ধুরা তাকে চোখে চোখে রাখতো। এক সঙ্গে আড্ডা দিতো। সর্বশেষ শুক্রবার বিকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেটে চার বন্ধু মিলে আড্ডা দেয়। সন্ধ্যার দিকে হলে ফিরে যায়। একটু পর বন্ধু নাদিমকে রুমে আসতে বলে। নাদিম এসে দরজা বন্ধ পায়। জানালায় উঁকি দেয়। ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। নাজমুল ঝুলে আছে একটি মোটা হলুদ রশিতে।
শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। সাদ্দাম হলের ২২৯ নম্বর রুম। নাদিমের চিৎকারে ছুটে আসে পাশের রুমের ছাত্ররা। দরজা ভেঙে বের করা হয় নাজমুলকে। নেয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেলে। আমিও ছুটছিলাম ভ্যানের পেছনে। দৌড়ে পৌঁছালাম সেখানে। কর্তব্যরত ডাক্তার বদিউজ্জামান অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেন। হাত, মুখ, চোখ, শ্বাস, নাড়ি স্পন্দন মাপলেন। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। পরপারে পাড়ি দিয়েছে নাজমুল। পাশে বন্ধুদের শত আকুতি। আরেকবার দেখুন না ডাক্তার সাহেব। সংবাদ শুনে চিৎকার শুরু হলো পুরো মেডিকেলে। মিজানুর রহমান নামে এক কর্মচারী জানালেন, গত কয়েকদিন ধরে সে ডাক্তার দেখাতে আসে। শুধু বলে আমি খুব অশান্তিতে আছি। কোনো কিছুতে শান্তি নেই আমার। ডাক্তাররা জানতে চেয়েছেন প্রেম করে কিনা? সে অকপটে না বলতো। কিন্তু কোনো কারণ বলতো না।’ শুক্রবার সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছে। তাদের বলেছে, আজ খুব টেনশন হচ্ছে। আজ দুইটা সিগারেট খাবো। বিকাল ৫টায় ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়। ‘একটা রিকশা চাই, শৈশব ও কৈশোরে ফিরে যাবার জন্য।’
কয়েকজন সাংবাদিককে হাসপাতালে রেখে আমি ছুটলাম তার রুমে। রুমটা নীরব। একেবারে শুনশান। বাইরে দাঁড়িয়ে হলের ছাত্ররা। রুমে ঢুকলাম। বিছানায় তার ফোন পড়ে আছে। বার বার তার মায়ের কল আসছে। নাজমুলের সে ফোন রিসিভ করলাম না। সেখান থেকে তার মায়ের ফোন নাম্বারটা নিলাম। কল করলাম। খালাম্মা একেবারেই শান্ত মেজাজে। খোঁজখবর নিলাম। খালুকে চাইলাম। কিন্তু তিনি অনড়। আমাকে বলো- কি কথা বলবে। আমি ততক্ষণে নিশ্চুপ হয়ে গেছি। কোনো কথা বের হচ্ছে না। শুধু বললাম, খালু আসলে আমাকে দ্রুত ফোন দিতে বলেন। পরক্ষণেই নাজমুলের ফোনে তার বড় ভাই দেলওয়ারের কল। আবারো সে নাম্বার নিয়ে তাকে কল দিলাম। ভাবছিলাম ভাইকে সহজেই হয়তো বলতে পারবো। কিন্তু বিধি বাম। এবারো আমার গলা বন্ধ। ডান হাতে ফোন কানে ধরে আছি। বাম হাতে মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলার মতো করে টানছি। ঘেমে যাচ্ছিলো পুরো শরীর। বড় ভাই জানতে চাইলেন কি হয়েছে নাজমুলের। ততক্ষণে আমার চোখে পানি এসে গেছে। ভাবছিলাম নিজের পরিবারের কথা। আমি যদি কখনো মরে যাই এভাবেই হয়তো কেউ ফোন করবে। ভাইকে বললাম, আমরা নাজমুলকে বাঁচাতে পারিনি। ও গলায় দড়ি নিয়েছে। ওপাশে আর কোনো কথা নেই। আমার পাশে প্রায় বিশজন ছাত্র ঘিরে দাঁড়িয়ে। সবাই স্তব্ধ। পরক্ষণেই আবার ফোন এলো। দেলওয়ার ভাইয়ের শাশুড়ি। বললেন ‘ওকে কি বলেছো? ও তো বিছানায় পড়ে গিয়েছে। আমাকে বলো। কি হয়েছে বাবা?’ অনেকক্ষণ নিশ্চুপ থেকে তাকেও একই কথা জানালাম। ততক্ষণে পাশে কান্নার রোল পড়ে গেছে। আমি পারিনি মাকে তার ছেলে বিয়োগের কথা জানাতে। আমিও যে তার ছেলের মতোই আরেক সন্তান।
কেন নাজমুলরা পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়? এই প্রশ্নের জবাব কে দেবে? গত এক বছরে নিজ হাতে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ জনের আত্মহত্যার সংবাদ লিখেছি। এদের মধ্যে ৩ জন প্রেমঘটিত, একজন অভাবে আর নাজমুল হতাশায় আত্মহত্যা করেছে। প্রশাসনকে বারবার তাগিদ দিয়েছি। আপনারা অন্তত প্রেরণাদায়ক কোনো অনুষ্ঠান করুন। স্থায়ী মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিন। ক্যাম্পাসের বাকি শিক্ষার্র্থীদেরও দাবি এটা। কিন্তু কি হলো? দুই মাসের ব্যবধানে আবারো আত্মহত্যার সংবাদ লিখতে হলো। বাকি ৪ জনের সংবাদ পত্রিকার মাধ্যমে দিয়েছিলাম। কিন্তু এবার সরাসরি নিজেকেই সে খবর দিতে হলো। একজন মাকে তার ছেলে বিয়োগের খবর দিতে গিয়ে থমকে যাচ্ছিলাম। বারবারই মনে পড়ছিল নিজের মায়ের কথা। কীভাবে মা তার ছেলে হারানোর সংবাদ মেনে নেবে? এর চেয়ে কষ্টের যে কিছু নেই।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status