প্রথম পাতা

ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ অনশনে অসুস্থ ঢাবি শিক্ষার্থী হাসপাতালে

বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার

১৯ অক্টোবর ২০১৮, শুক্রবার, ১০:১৪ পূর্বাহ্ন

চলতি শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল  বাতিল করে পুনরায় নেয়ার দাবি জোরালো হচ্ছে। গত তিনদিন ধরে অনশনরত আইন বিভাগের ছাত্র আখতার হোসেনের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে গতকাল ক্যাম্পাসে কয়েক দফায় মানববন্ধন ও বিক্ষোভ হয়েছে। গত বুধবার রাতে আখতারের সঙ্গে সংহতি জানিয়েছে ছাত্রলীগ। গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনটি পুনরায় ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার দাবি করেছে। এদিকে দুপুর আড়াইটার দিকে আখতারের সঙ্গে কথা বলতে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানী ও আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. রহমত উল্লাহ। এ সময় আখতার অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। বর্তমানে তিনি সেখানে চিকিৎসাধীন আছেন।

এর আগে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আখতারের চার দফা দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের সামনে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে আইন বিভাগের শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা অবিলম্বে ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করে পুনরায় নেয়ার জোর দাবি করেন। এ সময় তারা বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড বহন করেন। যেগুলোতে ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল বাতিল করে পুনরায় ভর্তি পরীক্ষা নেয়া, প্রশ্নপত্রের নিরাপত্তা, অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও বিচার এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সমালোচনা ফুটে ওঠে। শিক্ষার্থীরা বলেন, আখতার একটি ন্যায্য দাবিতে তিনদিন যাবৎ অনশন করছেন। তিনি চেয়েছেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাটি সুষ্ঠুভাবে হওয়ার। যাতে মেধাবীরা উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায়। কিন্তু ‘ঘ’ ইউনিটে প্রশ্ন ফাঁসের অকাট্য প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও প্রশাসন নাকে তেল দিয়ে ঘুমায়। তারা বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছে। আমরা চাই অবিলম্বে ‘ঘ’ ইউনিটের ফল বাতিল করে পুনরায় ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হোক। এ সময় আখতার হোসেনকে দেখতে আসেন আইন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। তিনি আখতারের শারীরিক অবস্থার খোঁজ খবর নেন। বুকে জড়িয়ে নিয়ে তার পাশে আছেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন অধ্যাপক আসিফ নজরুল। এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন অনশনকারী শিক্ষার্থী। এ সময় অধ্যাপক আসিফ নজরুল শিক্ষার্থীদের মানববন্ধনে সংহতি জানিয়ে বলেন, আমি তার সঙ্গে যখন কথা বলছি তখন মনে হলো আখতার কাঁদছে কেন? আসলে তার শিক্ষকরা অর্থাৎ আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সার্বিকভাবে কতটা অমানুষ হয়ে গিয়েছি কতটা অসংবেদনশীল হয়ে গেছি আমরা কতটা অনাচারী হয়ে গেছি এটা রিয়ালাইজ করে কাঁদছে আখতার। তিনি বলেন, একটা প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে এটার প্রতিবাদে একটা ছেলে বসে আছে কেউ তাকে দেখতে আসিনি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই দায়িত্ব অনুভব করছে না। এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক, দুঃখজনক আর কি হতে পারে। আখতার এই ইউনিভার্সিটির ছাত্র। এই ইউনিভার্সিটির প্রতিটি ছাত্রের দেখাশুনা করা নিরাপত্তা দেয়া ভালো-মন্দ দেখা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব। এটা প্রতিটি শিক্ষকের দায়িত্ব। আমরা এই দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছি। এ সময় তিনি বলেন, আমরা গর্ব করে বলতাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাটা সুচারুভাবে হয়। আজকে সেখানে আঘাত লেগেছে। সেখানে যদি আঘাত লাগে আমাদের সবার প্রতিবাদ করা উচিত ছিল। এবং অবশ্যই ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করা উচিত ছিল।

এদিকে দুপুর ১১টার দিকে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফরম বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ অনশনকারী শিক্ষার্থী আখতারের চার দফা দাবির সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে টিএসসিতে মানববন্ধন করেছে। মানববন্ধন শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে। এ সময় তাদের হাতে বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড দেখা যায়। যেগুলোতে প্রশ্ন ফাঁস হওয়ায় প্রশাসনের সমালোচনা করা হয়। এ সময় তারা চার দফা দাবি তুলে ধরেন। দাবিগুলো হলো- ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল বাতিল; পুনরায় পরীক্ষা নেয়; প্রশ্ন ফাঁসে জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা এবং বিগত বছরগুলোতে ‘জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা। ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, যদি আজকের মধ্যে এই পরীক্ষার ফলাফল বাতিল না করা হয় তাহলে আমরা কঠোর কর্মসূচি দেব। কেন, কেন, কেন প্রতিটি নায্য দাবি নিয়ে ছাত্র সমাজকে মাঠে নামতে হয়? ধিক্কার জানাই আপনাদের এই নির্লজ্জতাকে। আমরা চাই, আপনাদের মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত হোক।

এদিকে সকাল ১১টার দিকে ভিসির কার্যালয়ে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে এক সভা করে। সেখানে প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি আলোচনা হয়। সভা চলাকালে ভিসি কার্যালয়ের বাইরে বিক্ষোভ করে কিছু শিক্ষার্থী। তারা ভর্তি পরীক্ষার ফল বাতিল ও পুনরায় ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার দাবি করে। এ সময় তারা প্রশাসনকে দুপুর ১টার মধ্যে দাবি মেনে নেয়ার আল্টিমেটাম দেয়। আল্টিমেটামের মধ্যেই প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী, আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. রহমত উল্লাহ ও আইন বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক নাঈমা হক প্রশাসনের পক্ষ থেকে অনশনকারী শিক্ষার্থী আখতারের সঙ্গে কথা বলতে যান। এসময় সেখানে ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হুসাইনও ছিলেন। তিনিও প্রশাসনকে বিষয়টি যাচাই বাছাই করে পুনরায় ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার দাবি করেন। এ সময় প্রক্টরসহ অন্য শিক্ষকরা আখতারকে অনশন ভাঙানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু আখতার সুনির্দিষ্ট আশ্বাস ছাড়া অনশন ভাঙতে অস্বীকৃতি জানান। এ সময় তিনি প্রক্টরকে উদ্দেশ করে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে কিনা প্রশ্ন রাখেন। আকতারের দাবিকে ‘স্বাগত জানিয়ে’ প্রক্টর বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করার প্রতিশ্রুতি দেন। এরই মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েন অনশনকারী ছাত্র আখতার। একপর্যায়ে আকতার হাত পা ছোড়াছুড়ি আর চিৎকার শুরু করেন। তখন কয়েকজন মিলে ধরাধরি করে হাত থেকে স্যালাইনের ক্যানেলা খুলে তাকে রিকশায় তোলেন। রিকশায় তোলার পরও আকতার চিৎকার করতে থাকেন। এরপর তাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে ভর্তি করা হয়েছে। এ সময় শিক্ষকরাও তার সঙ্গে ছিলেন। হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, আখতার শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তার শরীরের গ্লুকুজ লেভেল মোটামুটি ঠিক থাকলেও তাকে কিছু সময় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।

পুনরায় ভর্তি পরীক্ষা নিতে সাদা দলের বিবৃতি
এদিকে ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রদানের আগেই ফলাফল প্রকাশের ঘটনায় ক্ষোভ ও নিন্দা জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দল। গতকাল দুপুুরে সাদা দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম স্বাক্ষরিত গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ নিন্দা জানানো হয়। এতে বলা হয়, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচটি ইউনিটের অধীনে প্রথম বর্ষ সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। চারটি ইউনিটের পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলেও গত তিন বছর ধরে ‘ঘ’ ইউনিটের প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। আমরা আশা করেছিলাম কর্তৃপক্ষ এবার অভিযোগের সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য তদন্ত সম্পন্ন করে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। কিন্তু এবারো আমরা কর্তৃপক্ষের দায় এড়ানোর প্রবণতা দেখলাম। সর্বমহলের সমালোচনার পরিপেক্ষিতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার আগেই ফলাফল প্রকাশ করা হলো। এ ফলাফল কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। প্রকাশিত ফলাফলে প্রশ্নপত্র ফাঁসের স্বপক্ষে প্রমাণাদি ইতিমধ্যে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। আমরা মনে করি ভর্তি পরীক্ষায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ও ঐতিহ্য রক্ষার জন্যই প্রয়োজন নয়, এর সঙ্গে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর স্বপ্ন ও ভবিষ্যৎ জড়িত। তাই অবিলম্বে বিতর্কিত ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল বাতিল করে নতুন করে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ এবং একই সঙ্গে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার জোর দাবি জানাচ্ছি।

প্রক্টরের বিরুদ্ধে অভিযোগ
এদিকে ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক প্রক্টরের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বললে প্রক্টর অনশনকারী ছাত্রের ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো না বলে মন্তব্য করেছেন বলে অভিযোগ করেন অনশনকারী ছাত্র আখতার হোসেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর কিভাবে একজন শিক্ষার্থীকে এভাবে ভাগ করতে পারেন। এ বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তচিন্তার জায়গা। এখানে ব্যকগ্রাউন্ড মাদরাসা, নন মাদরাসা বলতে কিছু নেই। আমরা সবাই এখানকার ছাত্র। আমি এতে কষ্ট পেয়েছি। তিনি বলেন, প্রক্টর স্যার যখন মাদরাসা ছাত্র বলে আমাকে আলাদা করতে চেয়েছিলেন তখন ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক রাব্বানী ভাই প্রক্টরের উদ্দেশে বলেছেন- ‘স্যার শাক দিয়ে মাছ ঢাকবেন না। তার দাবি যৌক্তিক। সেটা মেনে নেয়ার ব্যবস্থা করেন।’ এদিকে প্রক্টরের এমন বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে লেখেছেন প্রক্টর নিজে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক হয়ে কিভাবে মাদরাসা কিংবা কলেজ ব্যাকগ্রাউন্স ভাগ করতে পারেন। যদিও এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন প্রক্টর। গত বৃহস্পতিবার রাতে তিনি মানবজমিনকে বলেন, মাদরাসা, নন মাদরাসা ব্যাকগ্রাউন্ড বলতে কিছু নেই। সবাই আমাদের ছাত্র।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status