বাংলারজমিন

ভালো নেই খুলনার বৃক্ষমানব

স্টাফ রিপোর্টার, খুলনা থেকে

১৮ অক্টোবর ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৮:৫৭ পূর্বাহ্ন

আড়াই বছরে ২৫ বার অপারেশন হয়েছে আবুল বাজনদারের। চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায়ই ডাক্তারদের সহায়তায় ১০ শতক জমি কিনে টিনশেডের একটি বাড়ি করে থাকেন খুলনা জেলার পাইকগাছা পৌরসভার শিববাড়ি বিল এলাকায়। মাথা গোঁজার ঠাঁই হলেও ঘরে খাবার যোগাড় করার মতো উপায় নেই। খেয়ে না খেয়ে চলছে তার সংসার। চিকিৎসার ব্যাপারে সর্বশেষ আশা ছেড়ে দেয়ার কথাও জানিয়েছেন ডাক্তাররা। এজন্য হতাশায় দিন কাটছে বৃক্ষমানব আবুল হোসেন বাজনদারের। তার বৃদ্ধ মায়ের আর্তি ‘আমার ছেলের চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছিল সরকার, এখন আশা ছেড়ে দেয়ার কথা বলা হচ্ছে, আমি আমার ছেলের চিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’

পাইকগাছা পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের শিববাড়ি বিলের নতুন টিনশেডের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় আবুল হোসেন বাজনদারের সঙ্গে। স্ত্রী, চার বছরের একটি কন্যা সন্তান আর বৃদ্ধ পিতা-মাতা এই পাঁচজনের সংসার তার। ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ২৫ বার অপারেশন করে হাত ও পায়ে গজিয়ে ওঠা গাছের শেকড়ের মতো অংশগুলো অপসারণ করা হয়। চিকিৎসকদের ভাষায় রোগটির নাম ‘ট্রি ম্যান সিনড্রোম’। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলে। বর্তমানে আবুল হোসেন বাজনদার বাড়িতে অবস্থান করলেও মাঝে মধ্যে গিয়ে ঢামেক হাসপাতাল থেকে অপারেশন করিয়ে আসেন। সেখানকার বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের প্রধান সমন্বয় ডা. সামন্ত লাল সেনসহ পুরো একটি টিম এ চিকিৎসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে, আড়াই বছর ধরে চিকিৎসা গ্রহণ, দেশীয় আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রচার, সরকারের চিকিৎসার দায়িত্ব নেয়া সবকিছু হলেও আবুল হোসেন বাজনদারের চিকিৎসা সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্রই তাকে দেয়া হয়নি। এমনকি তাকে দেয়া হয়নি কোনো ছাড়পত্রও। শুধুমাত্র ডা. সামন্ত লাল সেনের মোবাইল নম্বরটিই বড় প্রমাণ আবুল বাজনদারের কাছে। প্রয়োজন হলে ডা. সামন্ত লাল সেনের কাছে ফোন দেন আবুল বাজনদার। তিনি যখন যেতে বলেন, তখন ঢামেক হাসপাতালে গিয়েই চিকিৎসা নিয়ে আসেন। সর্বশেষ আবারো তাকে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন ডা. সামন্ত লাল সেন। এমনকি তিনি মোবাইলে এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন আবুল বাজনদারের আবারো অপারেশন প্রয়োজন। এজন্য তাকে ঢাকায় যেতে বলা হয়েছে। ঢাকায় গেলেই আবারো আবুল বাজনদারের হাত-পায়ে অস্ত্রোপচার করা হবে বলেও তিনি জানান।

তবে আবুল হোসেন বাজনদার ও তার মা আমেনা বিবি বলেন, তাদেরকে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন যে, এ রোগ থেকে আর ভালো হওয়ার সুযোগ নেই। এখন যতদিন বেঁচে থাকবে ততোদিন এভাবেই চলতে হবে। এতে তার মধ্যে হতাশা প্রকট হচ্ছে। হাতে-পায়ে গাছের শেকড়ের মতো গজিয়ে ওঠায় কোনো কাজও করতে পারছেন না আবুল বাজনদার। তার একটি মেয়েও বড় হচ্ছে। স্কুলে দিতে হবে। পড়াশোনা করানোর খরচ যোগাড় করতে হবে। রয়েছে নিজেদের সংসার চালানোর খরচও। সবকিছু চিন্তা করলে কেমন যেন অন্ধকার দেখা যাচ্ছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় সেখানকার চিকিৎসক ডা. এম ইউ কবির চৌধুরীসহ কয়েকজন ডাক্তার ছয় লাখ টাকা দেন আবুল বাজনদারকে। তাছাড়া সেখানে তাকে দেখতে গিয়ে বিভিন্ন লোক আরও কিছু সহযোগিতা করেন। সব মিলিয়ে প্রায় ১০ লাখ টাকা দিয়ে আবুল বাজনদার ১০ শতক জমি কিনে বাড়ি করেন পাইকগাছায়। ঢামেক হাসপাতালে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম গিয়ে চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছিলেন।

বলেছিলেন, তার যে কোন উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন হোক না কেন করা হবে। আবুল বাজনদার মনে করেছিলেন চিকিৎসা শেষে আবারো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবেন। কাজ করে সংসার চালাতে পারবেন। একমাত্র মেয়ের লেখাপড়ার অর্থ যোগাড় করতেও তার কষ্ট হবে না। কিন্তু আড়াই বছর পর চিকিৎসকরা আশা ছেড়ে দেয়ায় অনেকটা হতাশাগ্রস্তই হয়ে পড়েছেন তিনি। কিভাবে সংসার চলবে, কিভাবে বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে দেখবেন, কিভাবে মেয়ের লেখাপড়া করাবেন এসব নিয়ে সার্বক্ষণিক ভাবনায় থাকতে হয় আবুল বাজনদারকে। এরপরও তার শারীরিক অবস্থা মাঝে-মধ্যে খারাপ হয়। তার জন্য ঢামেক হাসপাতাল থেকে কোনো ওষুধও দেয়া হয়নি। তার একমাত্র চিকিৎসাই হচ্ছে অপারেশন। অর্থাৎ মাঝে-মধ্যে সেখানে গিয়ে অপারেশন করে শেকড়ের মতো অংশগুলো কেটে ফেলা হয়। বাড়িতে বসে যখন ব্যথা অনুভব হয় তখন দোকান থেকে নিজেই ব্যথার ওষুধ কিনে খান। এর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে সেটি জেনেও শুধুমাত্র ব্যথা দূর করতে তার এ চেষ্টা উল্লেখ করে আবুল বাজনদার বলেন, যেহেতু ডাক্তাররা তাকে কোনো প্রেসক্রিপশন দেননি সেহেতু তার ব্যথা দূর করতে এর বিকল্প নেই।

আবুল বাজনদারের স্ত্রী হালিমা আক্তার বলেন, যেভাবে পত্র-পত্রিকা ও টেলিভিশনে তার স্বামীর চিকিৎসার বিষয়টি প্রচার হয়েছে তাতে তাদের অন্তত আশা ছিল যে, দেশে-বিদেশে যেখানেই হোক উন্নত চিকিৎসা হবে। কিন্তু দীর্ঘ আড়াই বছর পর আশা ছেড়ে দেয়ার ঘটনায় তারাও হতাশ। তার স্বামীর চিকিৎসার বিষয়টি নিয়ে ডাক্তারদের গবেষণার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু চিকিৎসার ফলাফল শূন্য। গবেষণা করেও তার স্বামী যদি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেন সেটিই তার একমাত্র চাওয়া বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

আবুল বাজনদারের পিতার নাম মানিক বাজনদার এবং মাতা আমেনা বিবি। চিকিৎসার পাশাপাশি ডাক্তারদের সহযোগিতায় বাড়ি করে মাথা গোঁজার ঠাঁই পেলেও দিন চলছে চরম অর্থকষ্টে। বৃদ্ধ পিতা মানিক বাজনদারের আয়ের ওপর চলছে তাদের পাঁচজনের সংসার। তার পিতা কখনো দিনমজুরি, কখনো কৃষি কাজে সম্পৃক্ত থেকে উপার্জন করেন। চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে ৬ষ্ঠ আবুল বাজনদার। অন্য সব ভাই-বোন বিবাহিত।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status