প্রথম পাতা

২০ দল ছাড়লো ন্যাপ-এনডিপি গন্তব্য কোথায়?

কাফি কামাল

১৭ অক্টোবর ২০১৮, বুধবার, ১০:১৬ পূর্বাহ্ন

বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে দুইটি শরিক দল বাংলাদেশ ন্যাপ ও এনডিপি। আগামী একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। চলছে নানা জোট গঠনের তোড়জোড়। এমন সময়ে ২০ দলীয় জোটের দুই শরিকের জোট বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঘটনা কৌতূহল সৃষ্টি করেছে রাজনৈতিক মহলে। দল দুইটির গন্তব্য কোথায়? তারা কি ক্ষমতাসীন জোটে যাচ্ছেন, নাকি মধ্যপন্থি কোনো জোটে? বাতাসে ভাসছে নানা গুঞ্জন। তবে দুই দলেরই শীর্ষ নেতা জানিয়েছেন, এখনই তারা কোনো জোটে যাচ্ছেন না। ব্যক্তিগত সম্পর্ক থেকে কেউ চায়ের দাওয়াত দিলে সে কথা ভিন্ন। কিন্তু একাদশ জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগপর্যন্ত তারা চলবেন নিজের পথে। তফসিল ঘোষণার পর কাদের সঙ্গে যৌথ পথচলায় পা মেলাবেন সেটার সিদ্ধান্ত হবে তখন।    

১৯৯৯ সালের ৬ই জানুয়ারি আওয়ামী লীগকে সরকার থেকে হটাতে জাতীয় পার্টি, জামায়াত, ইসলামী ঐক্যজোটকে সঙ্গে নিয়ে ‘চারদলীয় জোট’ গঠন করেছিল বিএনপি। পরে এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি বেরিয়ে গেলে যুক্ত হয় নাজিউর রহমান মঞ্জুর বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)। দীর্ঘ ১৩ বছর এ চারদলীয় জোট একসঙ্গে রাজনীতি করে। ওয়ান ইলেভেন এবং ২০০৮ সালের নবম জাতীয় নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বড় ধরনের রাজনৈতিক বিপর্যয়ে পড়ে বিএনপি। এমন পরিস্থিতিতে, জোটের পরিধি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল চারদলীয় জোট। যার প্রেক্ষিতে, ২০১২ সালের ১৮ই এপ্রিল নতুন ১২টি দলে সংযুক্তির মাধ্যমে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে থাকা চারদলীয় জোট কলেবরে বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ দলীয় জোটে। সে ১২টি দলের মধ্যে ছিল এনডিপি ও বাংলাদেশ ন্যাপ। যদিও শেষ পর্যন্ত জোটের পরিধি দাঁড়ায় ২০ দলে। কিন্তু বছর দুয়েক আগে ইসলামী ঐক্যজোট একাংশ ও এনপিপি জোট ছেড়ে গেলেও তাদের একাংশ বিএনপির সঙ্গে থাকায় কমেনি ২০ দলের কলেবর। কিন্তু বাংলাদেশ ন্যাপ ও এনডিপি জোট ছেড়ে যাওয়ায় সংখ্যাগতভাবে কমলো বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের পরিধি। ২০ দলীয় জোটের মধ্যে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন ছিল ৮টি দলের। দীর্ঘদিন ধরেই স্থগিত রয়েছে জামায়াত ও এনডিপির নিবন্ধন। সে হিসেবে ২০ দলীয় জোট হারিয়েছে একটি নিবন্ধিত দল। বাংলাদেশ ন্যাপের নিবন্ধন থাকলেও বাস্তবে দলটির সাংগঠনিক পরিসর খুবই সীমিত। বাংলাদেশ ন্যাপ ও এনডিপির শীর্ষ দুই নেতার আসনেও তাদের অবস্থান সুদৃঢ় নয়। যার কারণে তারা নিজেদের আসনে নির্বাচনের সুযোগ পান না। আগামী জাতীয় নির্বাচনেও তারা জোটের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী লড়াইয়ের সুযোগ পাবেন কিনা তা নিশ্চিত ছিল না। এই নিয়ে দল দুইটির শীর্ষ নেতাদের মধ্যে কিছুটা অসন্তোষও ছিল। আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে গতকাল ২০ দলীয় জোট ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছে ২০ দলের দুই শরিক- বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি- বাংলাদেশ ন্যাপ ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এনডিপি। দুই দলের যৌথ সংবাদ সম্মেলনে জোট ছাড়ার ঘোষণাটি দেন ন্যাপের চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গাণি। তিনি বলেন, ওয়ান ইলেভেনের কুশীলব, মাইনাস টু ফর্মুলা বাস্তবায়নকারী যখন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নামে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে, তখন আমরা মনে করি বিএনপি তার সকল নৈতিক অবস্থান থেকে বিচ্যুত হয়েছে। সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে ২০ দলীয় জোটের শরিক দল ন্যাপ ও এনডিপি সাংবিধানিক, নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির স্বার্থে আজকে এই মুহূর্ত থেকে জোটের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করছে।  

ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি- এনডিপি’র চেয়ারম্যান খন্দকার গোলাম মর্তুজা বলেন, রাজনীতিকদের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকে এবং সে সম্পর্কের জেরে কেউ চায়ের দাওয়াত দিলে ভিন্ন কথা। তবে আমি এখন কোথাও যাবো না, কোনো জোটে যুক্ত হব না। আপাতত একা একাই আছি, দেখি সামনে কি হয়। তিনি বলেন, বিএনপির আহ্বানে ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলাম। কিন্তু সেবার আমাকে একটি আসনও ছাড় দেয়নি বিএনপি। তারপরও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে জোটের রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলাম। তিনি আমাদের আগলেও রেখেছিলেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অনেক পাল্টে গেছে। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর ২০ দলীয় জোটের কার্যক্রম সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে। তিনি গ্রেপ্তার হওয়ার পর বারবার তাগিদ দেয়ার পরও ২০ দলের প্রোগ্রাম হয়নি। বিএনপি এক ঘণ্টার একটি অনশন কর্মসূচি করেছে যা রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত হাস্যকর। মর্তুজা বলেন, খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর বিএনপি নেতারা ঐক্যপ্রক্রিয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু এটা কোন ঐক্যপ্রক্রিয়া? যেখানে মঞ্চে এসে বসছেন, বক্তব্য দিচ্ছেন ওয়ান ইলেভেনের কুশীলব। এই ঐক্যপ্রক্রিয়ায় আমাদের গৌণ করা হলেও ঐক্যের ব্যাপারে সবাই সম্মত ছিলাম। কিন্তু বিএনপি বিকল্পধারাকে পর্যন্ত আনতে পারলো না। খন্দকার গোলাম মতুর্জা বলেন, দলের নিবন্ধন আটকে আছে। যাদের সঙ্গে এতদিন জোটের রাজনীতি করলাম তারাও আমাদের কথা ভাবছে না। নির্বাচন করলে আমাদের আসন নিয়ে কোনো কথা বলছে না। তাহলে কেন, কিসের জন্য আমরা জোটের রাজনীতি করবো? আমাদের দুর্ভাগ্য যে, খালেদা জিয়া কারাগারে গেছেন। তিনি যখন কারাগারে গেছেন তখন আমাদের নির্বাচনের সুযোগও কমে গেছে। আমাদের নির্বাচনের ভাগ্য থাকলে খালেদা জিয়া জেলে যেতেন না। মর্তুজা বলেন, বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে থাকার কারণে আমাদের দলের নিবন্ধন আটকে রেখেছে নির্বাচন কমিশন।

বাংলাদেশ ন্যাপ-এর চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি বলেন, আমাদের সঙ্গে বিকল্প ধারার প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর একটি পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে। আমার দাদার সঙ্গে তিনি একসঙ্গে রাজনীতি করেছেন। তিনি দেড় মাস ধরে আমাকে কয়েকবার চায়ের দাওয়াত দিয়েছেন। আমি এখন জোটভুক্ত নই। এখন আমি তার চায়ের দাওয়াতে যাবো। রাজনীতি নিয়ে আলাপ করতে পারলে সম্মানিত বোধ করবো। তবে এ মুহূর্তে আমি কোনো জোটে যাচ্ছি না। সামনে নির্বাচন আসছে, আগামী দিনের পরিস্থিতি দেখেই সিদ্ধান্ত নেবো। যদি আওয়ামী লীগ একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দেয় তাহলে তাদের সঙ্গেও যেতে পারি। আবার বিএনপি’র নেতৃত্বে একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের সুযোগ তৈরি হলে এবং বিএনপি চাইলে তাদের সঙ্গেও থাকতে পারি। জেবেল রহমান গানি বলেন, আমার দল নিবন্ধিত, তবু আমি বিগত দিনে কোনো বিতর্কে যাইনি। জোটের হয়ে জাতীয় রাজনীতি করি। কিন্তু আমার তো এলাকা রয়েছে। সেখানে আমাদের নেতাকর্মীরা রয়েছে। এখন আমার এলাকায় তো বিএনপি আমাকে রাজনীতি করার সুযোগটুকু দিচ্ছে না। ২০০১ সালে আমার বাবাকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। তারপরও খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের দাওয়াতে আমি ম্যাডাম খালেদা জিয়ার কাছে গিয়েছি, ঐক্য করেছি। তিনি আমাকে বলেছেন, তোমার বাবার সঙ্গে ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে কিন্তু আমার সঙ্গে থাকো। আমি এতদিন ছিলাম। কিন্তু আমার আসনে খালেদা জিয়ার ভাগনে শাহরিন ইসলাম তুহিন রয়েছেন। এলাকায় বিএনপি’র মঞ্চ থেকে আওয়ামী লীগের চেয়ে আমাকেই বেশি আক্রমণ করা হয়। প্রতিটি সিটি নির্বাচনে জোটের সমন্বয় কমিটি হলেও কেবল আমাকে কোণঠাসা করার জন্য রংপুর সিটি নির্বাচনে কোনো সমন্বয় কমিটি করা হয়নি। বিএনপি তো আমাকে কেবল দূরেই ঠেলে দিয়েছে। আমাকে বারবার অপমান করা হয়েছে। তিনি বলেন, এতদিন জোটের রাজনীতি করেছি, কিন্তু আমার তো একটি দল আছে। আমাদের তো অস্তিত্বের লড়াই আছে। নিবন্ধিত হিসেবে নির্বাচনে যেতে হবে। এখন খালেদা জিয়া কারাগারে তার অবর্তমানে বিএনপি নির্বাচনে গেলে এবং সে নির্বাচনে আমাকে শেষ মুহূর্তে আমার বাবার মতো ‘স্যরি’ বললে তখন আমি কোথায় যাবো? তিনি বলেন, জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়ায় আমাকে বাংলাদেশ ন্যাপ হিসেবে দাওয়াত দেয়া হয়েছিল। কিন্তু খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ২০ দলে থেকে আবার আরেকটি স্বতন্ত্র জোটে স্বতন্ত্র দল হিসেবে অংশগ্রহণ আমার কাছে সন্দেহজনক মনে হওয়ায় আমি যাইনি। জনসম্পৃক্ত কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে না পারলে বিএনপিকে শেষ পর্যন্ত তাদের অধীনেই নির্বাচনে যেতে হবে।  ফলে বিএনপি বা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যে স্ট্রাটেজিতে সামনে যাচ্ছে তাতে সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। বাংলাদেশ ন্যাপ-এর মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া বলেন, আমরা ২০দলীয় জোটের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছি। তার মানে এই নয় যে, আমরা কোনো জোটের পেছনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি। আগামী জাতীয় নির্বাচনের ইশতেহার ঘোষণার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ ন্যাপ এককভাবে চলবে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ওই সময়ের প্রেক্ষাপট অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তিনি বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আমরা ২০দলীয় জোটের শরিক হয়েছিলাম। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের প্রতি সর্বোচ্চ আস্থা থেকেই আমরা টোপ এবং চাপ সহ্য করেও এড়িয়ে গেছি ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন। কিন্তু বিএনপি’র দিক থেকে আমরা হয়েছি অবহেলার পাত্র। আগামী নির্বাচনে যদি বিএনপি অংশ নেয়, সেক্ষেত্রে আমাদের চেয়ারম্যানের আসনটি নিয়েও তারা কোনো কথা বলেনি। তাহলে বিএনপি নির্বাচনে গেলে আমরা নির্বাচনী প্রস্তুতি কোথায় নেবো? এদিকে বিকল্প ধারা বাংলাদেশের একজন নেতা জানান, বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন ২০ দলের অনেকেই প্রফেসর ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর দলকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে প্রত্যাশা করেছিল। কিন্তু কিছু নেতার কারণে সেটা হয়নি। ফলে তাদের অনেকেই এখন আমাদের সঙ্গে থাকতে পারে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status