এক্সক্লুসিভ

হানিফ পরিবহনের কাউন্টারে ছাত্রলীগের হামলা

চট্টগ্রামে অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘটে লাখো যাত্রীর দুর্ভোগ

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি

১৫ অক্টোবর ২০১৮, সোমবার, ৯:০২ পূর্বাহ্ন

কাউন্টারে হামলা ও ভাঙচুর চালিয়ে শনিবার দুপুরে হানিফ পরিবহনের বাস চলাচল বন্ধ করে দেয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এর প্রতিবাদে রোববার সকাল থেকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে দূরপাল্লাসহ সব ধরনের বাস চলাচল বন্ধ করে দেয় শ্রমিক-কর্মচারীরা। আর এতে চরম দুর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা।
রোববার সকাল থেকে কক্সবাজারগামী দূরপাল্লার কোনো বাস চট্টগ্রামের কর্ণফুলী সেতু কাউন্টার ছেড়ে যায়নি। কক্সবাজার থেকে দূরপাল্লার কোনো বাস চট্টগ্রামেও প্রবেশ করেনি। এমনকি এ সড়কে অভ্যন্তরীণ সকল প্রকার বাস চলাচলও বন্ধ রয়েছে। চলছে শুধু সিএনজি অটোরিকশা, টেম্পো, হিউমেন হলার ও মাইক্রোবাস। এসব গাড়িও সুযোগ বুঝে দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করছে যাত্রীদের কাছ থেকে।
চট্টগ্রাম মহানগর থেকে পটিয়ায় বেসরকারি ব্যাংকের একটি শাখায় চাকরি করেন মো. সাইয়েদ হোসেন। তিনি বলেন, প্রতি কর্মদিবসের মতো রোববার সকালে কর্ণফুলী সেতুর গোলচত্বরে এসে দেখতে পাই কোনো বাস চলাচল করছে না। টেম্পো, মাইক্রোবাস দ্বিগুণ ভাড়া দাবি করায় কিছু দূর পায়ে হেঁটে এবং কিছু দূর টেম্পোতে যেতে হয়েছে। একইভাবে আসতে গিয়েও খরচ অনেক বেশি হয়েছে। সময়ও লেগেছে অনেক।
সাতকানিয়া উপজেলার ব্যবসায়ী মো. গোলাম কিবরিয়া বলেন, অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘটের কারণে এই পারের প্রায় অর্ধলক্ষ লোক ভোগান্তিতে পড়েছে। ব্যবসায়িক পণ্য পরিবহনে অনেক ব্যবসায়ীকে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে।
আমাদের লোহাগাড়া প্রতিনিধি জসিম উদ্দিন জানান, সকাল থেকে কক্সবাজার মহাসড়কে দূরপাল্লা ও অভ্যন্তরীণ সব ধরনের বাস চলাচল প্রায় বন্ধ থাকায় লাখ লাখ মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়ে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয় ব্যবসায়ীরা।
আমাদের আনোয়ারা প্রতিনিধি মুহাম্মদ আজাদ জানান, দূরপাল্লা ও অভ্যন্তরীণ বাস  চলাচলের বিষয়ে আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলার প্রায় দুই লাখ মানুষ যাতায়াত ভোগান্তিতে পড়ে। কাঁচা শাক সবজিসহ ব্যবসায়িক পণ্য পরিবহনে দ্বিগুণ খরচ গুনতে হয়েছে ব্যবসায়ীদের। শহরে নিতে না পারায় অনেক ব্যবসায়ীর কাঁচা পণ্য নষ্ট হয়ে গেছে।
এই বিষয়ে দক্ষিণ জেলা বাস শ্রমিক ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক আনোয়ার হোসেন বলেন, কোনো ধর্মঘট নয়; ভয়ে বাস চালাচ্ছে না চালক-শ্রমিকরা। আমরা রাস্তায় থাকি বলে যখন তখন হামলা করবে। যা খুশি তাই করবে তা তো হতে পারে না।
শনিবার দুপুরে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মোহাম্মদ হানিফের মালিকানাধীন পরিবহন সংস্থা হানিফ পরিবহনের বাস চলাচল বন্ধ করে দেয় চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের কতিপয় নেতাকর্মী।
কেন্দ্রীয় ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত ছাত্রলীগ নেতা শাহাদাত হোসেন সায়েমের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা মোহাম্মদ হানিফকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে শনিবার দুপুরে চট্টগ্রামের চান্দগাঁও, কর্ণফুলী সেতু ও দামপাড়া গরিবুল্লাহ শাহ বাস কাউন্টারে ভাঙচুর চালিয়ে তালা ঝুলিয়ে দেয়।
এরপর চট্টগ্রাম-কক্সবাজার এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে হানিফ পরিবহনের সকল বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে গন্তব্যে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকা এই পরিবহনের বাসের টিকিট নেয়া যাত্রীগণ চরম দুর্ভোগে পড়েন। সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত হানিফ পরিবহনের চান্দগাঁও ও গরিবুল্লাহ শাহ বাস কাউন্টারের সামনে অনেক যাত্রীকে বসে থাকতে দেখা যায়।
হানিফ পরিবহনের চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের কর্ণফুলী সেতু বাস কাউন্টারের ব্যবস্থাপক নুরুল কবির জানান, শনিবার দুপুর ১২টার দিকে কেন্দ্রীয় ও দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের নেতা শাহাদাত হোসেন সায়েমের নেতৃত্বে কয়েকজন ছাত্রলীগ কর্মী এসে আমাদের বাস কাউন্টার বন্ধ করতে বলে।
কেন জানতে চাইলে তারা বলেন, ২১শে আগস্ট হত্যা মামলায় আপনাদের মালিকের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। আপনাদের ব্যবসা করার কোনো অধিকার নাই। আপনারা গাড়ি চালাতে পারবেন না। আমি বললাম, আমরা তো হানিফ পরিবহন। হানিফ এন্টারপ্রাইজের মালিকের সাজা হয়েছে। আমাদের সাথে এন্টারপ্রাইজের ব্যবসা আলাদা। আমাদের লাইসেন্সসহ সবকিছু আলাদা। এই নিয়ে কোর্টের আদেশ রয়েছে। কোর্ট দুইটার নাম আলাদা করে দিয়েছে।
তারপরও ছাত্রলীগ নেতা শাহাদাত হোসেন সায়েম বলেন-এত কথার দরকার নাই। এ কথা বলেই কাউন্টার ভাঙচুর শুরু করে। ল্যাপটপসহ মূল্যবান জিনিসপত্র লুটপাট করে। পরে তালা ঝুলিয়ে দেয়। এ সময় গন্তব্যে পৌঁছতে টিকিট নিয়ে অপেক্ষায় থাকা শত শত যাত্রীর দুর্ভোগের কথা বলেও তাকে ক্ষান্ত করা যায়নি।
এ ঘটনার পর হানিফ পরিবহন বাসের অপেক্ষমান যাত্রীরা চরম বিপাকে পড়েন। শেষে কিছু যাত্রীদের টিকেট ফেরত নিয়েছি। কিছু কিছু যাত্রীকে অন্য পরিবহনের সার্ভিসে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে ছাত্রলীগ নেতা শাহাদাত হোসেন সায়েমের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সমপাদক আবু তাহের বলেন, দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের নেতা জনি হত্যার ১ নম্বর আসামি শাহাদাত হোসেন সায়েম। ফলে দক্ষিণ জেলা ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত সে। কিন্তু ছাত্রলীগ পরিচয়ে হানিফ পরিবহনের বাস চলাচল বন্ধ ও কাউন্টারে তালা ঝুলিয়ে দেয়ার খবর পেয়েছি। তার এ ধরনের কর্মসূচির সঙ্গে দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের কোনো সম্পর্ক নেই।
তবে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সমপাদক জাকারিয়া দস্তগীর বলেন, হানিফ পরিবহনের মালিক একুশে গ্রেনেড হামলা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। ওই হামলায় আমাদের নেত্রীকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল। আইভি রহমানসহ অনেক লোক হতাহত হয়েছেন। এটা একটা বড় আবেগের জায়গা। আবেগ সংবরণ করতে না পেরে হানিফের কাউন্টার বন্ধ করে দিয়েছে ছাত্রলীগের কর্মীরা।
এদিকে বিভিন্ন পরিবহন সংস্থা জানায়, হানিফ এন্টারপ্রাইজের চেয়ারকোচ ঢাকা-চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে এবং হানিফ সুপার শুধুমাত্র চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে চলাচল করে। দুইটি পরিবহনের মালিকানাও ভিন্ন। হানিফ এন্টারপ্রাইজের মালিক ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মো. হানিফ। অন্যদিকে হানিফ সুপারের মালিক হচ্ছেন চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার বাসিন্দা মো. কামাল উদ্দিন।
কিন্তু ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হানিফ এন্টারপ্রাইজের পাশাপাশি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রুটে চলাচল করা হানিফ সুপারের কাউন্টার ভাঙচুর ও তালা লাগিয়ে দিয়েছে। মালিকানা ভিন্ন থাকার বিষয়টি পরিবহন নেতারা পুলিশকে জানানোর পরও কোনো সুরাহা না হওয়ায় দক্ষিণ চট্টগ্রামের সবগুলো রুটে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয় পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status