শরীর ও মন

পরিবর্তনশীল বিশ্বে তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য

ডা. জিল্লুর রহমান খান রতন

১০ অক্টোবর ২০১৮, বুধবার, ৮:৫৬ পূর্বাহ্ন

প্রতিবছরের মতো এবছরও বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশে ১০ই অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস  পালিত হচ্ছে। এ বছরের বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য ‘পরিবর্তনশীল বিশ্বে তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য (Young people and mental health in a changing world)’। তরুণরাই সমাজের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ও সমাজের চালিকা শক্তি। কিন্তু জীবনের এ গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ভেতরে-বাইরে যেসব পরিবর্তন হয় তার ধাক্কা সামলাতে গিয়ে তরুণরা জীবন থেকে কক্ষচ্যুত হয়ে পড়ে। কখনও বা বিভিন্ন ধরনের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা ও মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়। এ বিষয়টি এ বছরের বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য হিসেবে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী ১৪ থেকে ২৫ বছর বয়সী  নারী-পুরুষ তরুণ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত এবং জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ তরুণ। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ সময়টি (১৪ থেকে ২৮ বছর) বিভিন্ন কারণে ঘটনাবহুল, চ্যালেঞ্জিং ও সমস্যাসংকুল।  শিক্ষা, চাকরি, ব্যক্তিগত সম্পর্ক, আত্মোন্নয়ন ও আধুনিক নগর জীবনের  চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে অনেকে এ বয়সে হতাশ, বিপথগামী ও কক্ষচ্যুত হয়ে পড়ে। এ কারণে তাদের ভেতর মানসিক চাপ বৃদ্ধি, উদ্বেগ, বিষণ্নতা, আচরণগত সমস্যা ও অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। কুসংস্কার ও সামাজিক লজ্জার কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে  তারা এবিষয়টি কারো সঙ্গে শেয়ার করতে চায় না। এর ফলে তারা নিজেদের  গুটিয়ে নেয় ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের প্রতি ৫ জনের একজন তরুণ (শতকরা ২০ ভাগ) যেকোনো ধরনের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত যাদের বেশিরভাগের বসবাস উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। আমাদের দেশের চিত্রও প্রায় একইরকম।

তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্যে বিষণ্নতা, উদ্বেগজনিত মানসিক সমস্যা, মনোদৈহিক সমস্যা, অবাধ্যতা, আচরণগত সমস্যা, মানসিক চাপজনিত স্বাস্থ্য সমস্যা ও মাদকাসক্তি অন্যতম। এ ছাড়াও জটিল  ধরনের মানসিক সমস্যা যেমন সিজোফ্রিয়ানা, ম্যানিয়া ও অন্যান্য সাইকোটিক ডিসঅর্ডারও তাদের ভেতর  দেখা যায়। কিন্তু অজ্ঞতা, কুসংস্কার, লোকলজ্জার ভয়, বিজ্ঞানসম্মত  চিকিৎসা প্রাপ্তির সম্পর্কে তথ্যের  অভাবে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত তরুণ সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ চিকিৎসা সহায়তা পাচ্ছে না। এর ফলে তাদের জীবনের গতিপথ বদলে যাচ্ছে। আমাদের দেশে মাদকাসক্তি যুব সম্প্রদায়ের ভেতর মহামারি আকারে বিস্তার লাভ করেছে। মাদকের সহজলভ্যতা, মাদক চোরাচালান, কৌতূহল, বন্ধুদের চাপ, আর্থসামাজিক অবস্থা সহ বিভিন্ন ধরনের মনোসামাজিক কারণে মাদকাসক্তি শহর-গ্রাম, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সর্বস্তরে বিস্তার লাভ করেছে। মাদকাসক্তি থেকে পরবর্তীতে চুরি, ছিনতাই, অপহরণসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে  তরুণ সম্প্রদায়। তরুণ বয়সে সম্পর্কের টানাপড়েন, সম্পর্ক ভেঙে  যাওয়া, মা-বাবার বিবাহ বিচ্ছেদ, নিকটজনের মৃত্যু, শারীরিক,  মানসিক নির্যাতন ও যৌন নির্যাতন (তথাকথিত ইভটিজিং) সহ বিভিন্ন নেতিবাচক ঘটনার কারণে দীর্ঘমেয়াদি মানসিক ক্ষতের সৃষ্টি হয়।

এ ছাড়াও তরুণদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ, যুদ্ধবিগ্রহ, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক মানসিক প্রভাব দেখা যায়। অনেক সময় তরুণদের মধ্যে অবাধ্যতা, তুচ্ছ কারণে বিরোধ, ভাঙচুর, সহিংস আচরণ ও দেশীয় সংস্কৃতির বিরুদ্ধ জীবন আচরণ  লক্ষ্য করা যায়। এদের মধ্যে ব্যক্তিত্বের  সমস্যা ও অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা যায়। এ ছাড়াও  বিভিন্ন কারণে মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে অনেক সময় আত্মহত্যার প্রচেষ্টা, নিজেকে আঘাত করার প্রবণতা দেখা যায়। আত্মহত্যা তরুণদের (১৫ থেকে ২৯ বছর) মৃত্যুর  অন্যতম কারণ। আত্মহত্যা প্রচেষ্টাকারীদের বেশিরভাগের বিষণ্নতাসহ বিভিন্ন ধরনের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা যায়। নগরায়ন, অভিভাবকত্ব, আর্থসামাজিক অবস্থা, অবাধ আকাশ সংস্কৃতি, মূল্যবোধের পরিবর্তন এসবের জন্য দায়ী। তরুণদের মধ্যে অনেক সময় ইন্টারনেট ও ফেসবুক সহ অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। যা অনেক সময় আসক্তির পর্যায়ে পড়ে।

স্কুল-কলেজে অনেক সময় তরুণেরা শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন, বাজে কমেন্ট, বুলিং ও র‌্যাগিংয়ের শিকার হয়। যার কারণে তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে ও বিষণ্নতা, উদ্বেগজনিত মানসিক সমস্যাসহ বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়। এ বছরের বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত তরুণদের চিকিৎসা প্রাপ্তি ও  সুযোগের সমতা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।

বর্তমানে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটসহ বিদ্যমান বেশিরভাগ সরকারি, বেসরকারি ও সামরিক মেডিকেল কলেজসমূহ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মানসিক রোগ বিভাগে নামমাত্র মূল্যে মানসিক রোগের আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা (ওষুধ, সাইকোথেরাপি ও অন্যান্য) বিদ্যমান। কারো কোনো ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দিলে  মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। আধুনিক চিকিৎসা গ্রহণের পথে সবচেয়ে বড় বাধা মানসিক রোগ চিকিৎসায় নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, কুসংস্কার ও অজ্ঞতা; চিকিৎসা প্রাপ্তির সুযোগের অভাব নয়। কারণ মাত্র ৬ হাজার জনগণের জন্য রয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক ও অন্যান্য সরকারি প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্র। তরুণদের মধ্যে মানসিক রোগ প্রতিরোধ, সুস্থ মানসিক ও মানবিক বিকাশ জরুরি। এ জন্য প্রয়োজন সুস্থ বিনোদন, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি। এক্ষেত্রে অভিভাবক ও পরিবারের ভূমিকা প্রধান। নৈতিক অবক্ষয় ও বিপণনসর্বস্ব বাজার অর্থনীতির  এ যুগে ব্যক্তি মানুষের মর্যাদা ও নৈতিক মূল্যবোধ পুনরুদ্ধার জরুরি হয়ে পড়েছে।

তরুণদের মানসিক  সুস্থতা ও সুস্থ বিকাশ ব্যতিত কোনো জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতি সম্ভব নয়। এজন্য তাদের মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞসহ সমাজের সর্বস্তরের জনগণের সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন। আর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জনসচেতনতা।

 লেখক: মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ, সহযোগী অধ্যাপক, সাইকিয়াট্রি এক্স জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status