শেষের পাতা

নেত্রকোনায় বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দুই সপ্তাহে ২৭ মামলা

কাফি কামাল

২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, রবিবার, ১০:২১ পূর্বাহ্ন

চলতি সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দুই সপ্তাহেই নেত্রকোনায় বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ২৭টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় হাজারখানেক নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে কয়েক হাজার। অবশ্য নেত্রকোনাবাসীর জন্য ডজন ডজন মামলা ও হাজার হাজার আসামির  বিষয়টি নতুন নয়। নেত্রকোনা জেলা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর মামলার সিডর বয়ে যাচ্ছে কয়েক বছর ধরে। বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তরের তথ্য মতে, ২০০৭ সাল থেকে ২০১৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত নেত্রকোনায় ১৩২ মামলায় আসামি করা হয়েছে ২৭ হাজার ৮৯২ জন। পরবর্তীকালে পাল্লা দিয়ে মামলা ও আসামির এ সংখ্যা। জেলা বিএনপির তথ্য মতে, ২০১৪-২০১৮ সাল পর্যন্ত ৯৭ মামলায় আসামী করা হয়েছে ১০ হাজার ৮০০ জনকে।

জেলা বিএনপির নেতারা জানান, দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ৪ঠা সেপ্টেম্বর নেত্রকোনা জেলার ১০ থানায় বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ২২টি মামলা করে পুলিশ। বিশেষ ক্ষমতা আইনে দায়েরকৃত এসব মামলায় জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক এমপি আশরাফ উদ্দিন খান, সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. আনোয়ারুল হক, সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম মনিরুজ্জামান দুদু, জেলা ছাত্রদলের সভাপতি ফরিদ হোসেন বাবুসহ প্রায় ১৮শ’ নেতাকর্মীকে এসব মামলায় আসামি করা হয়। খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসার দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে জেলা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি ও খালিয়াজুরী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান তালুকদার, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তাজেজুল ইসলাম ফারাসসহ ১৬৮ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত প্রায় ৭০ জনের বিরুদ্ধে ৯ই সেপ্টেম্বর নেত্রকোনা মডেল থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা করে পুলিশ। জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক এমপি আশরাফ উদ্দিন খান, সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. আনোয়ারুল হক, সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম মনিরুজ্জামান দুদুসহ ১৫০ নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত প্রায় ৭০০ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে নেত্রকোনা মডেল থানায় পৃথক তিনটি এবং জেলার বাকি ৯ থানায় একই অভিযোগে ১৯টি মামলা করে পুলিশ। ওইসব মামলায় আসামির সংখ্যা নামোল্লেখকৃত আসামির সংখ্যা ৯৫০ জন। নেত্রকোনা সদর উপজেলা বিএনপির নেতারা জানান, সেপ্টেম্বর মাসের তিন দফায় ৭টি মামলা হয়েছে কেবল সদর উপজেলায়। প্রথম তিন মামলায় ১৮০, দ্বিতীয় দফার দুই মামলায় ১৬৮ জন ও তৃতীয় দফার দুই মামলায় ১৪৫ জনের নাম উল্লেখ করে এসব মামলায় অজ্ঞাত আসামি দেখানো হয়েছে ৭০০। নেত্রকোনা জেলা বিএনপির রাজনীতি করতেন এহতেশাম হায়াত খান রিংকু। কিন্তু কিডনি জটিলতার কারণে তিন বছর ধরে রাজনীতিতে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় তিনি। দীর্ঘদিন ভারতে চিকিৎসা নেয়ার পর তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হলেও সপ্তাহে একবার কিডনি ডায়ালেসিস করতে হয়। তার শারীরিক অবস্থা এতটাই নাজুক যে, অন্যের সাহায্য ছাড়া চলাফেরাই করতে পারেন না। অথচ সদর থানায় দায়েরকৃত তিনটি মামলায় আসামির তালিকায় রয়েছে রিংকুর নাম। ২০১৮ সালের ২৮শে আগস্ট থেকে ৪ঠা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিদেশে অবস্থান করছিলেন জেলা বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক মোখলেছুর রহমান। কিন্তু প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীকে কেন্দ্র করে গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগে ৩রা সেপ্টেম্বর দায়েরকৃত দুটি মামলায় তাকে আসামি করা হয়েছে। মোখলেছুর রহমান বলেন, রাজনীতি করি তাই মামলায় ভয় পাই না। কিন্তু যখন দেশেই ছিলাম না তখনকার ঘটনায়ও আমি মামলার আসামি। এছাড়া সদর থানার তিন মামলায় আসামির তালিকায় রয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের নাম। যাদের মধ্যে রয়েছেন- কাইলহাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক তাজুল ইসলাম, আব্বাসউদ্দিন খান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক জুলফিকার আলী ভুট্টো ও শাপলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আঞ্জু মাস্টার।  

বিএনপির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, ঘটনা ঘটুক আর না ঘটুক নেত্রকোনায় মামলা দায়ের হচ্ছে সমানে। এ সরকারের আমলে বিএনপির প্রতিটি কেন্দ্রীয় কর্মসূচিকে কেন্দ্র করেই নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নেত্রকোনার থানাগুলোয় একের পর এক মামলা করেছে পুলিশ। চলতি সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দুই সপ্তাহেই এ জেলায় মামলা হয়েছে ২৬টি। ঈদের আগের কয়েক দিন জেলার প্রতিটি থানায় দুটি করে মামলা করেছে পুলিশ। এসব মামলায় বিএনপি নেতাকর্মীদের নাম উল্লেখ করে শত শত অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। ফলে যে কাউকে আটক করেই সেসব মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে। তিনি বলেন, সেপ্টেম্বর মাসে যেসব অভিযোগে মামলা হয়েছে তার কোনো ঘটনাই নেত্রকোনায় ঘটেনি।

নেত্রকোনা জেলা বিএনপির দপ্তর জানায়, ২০১৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত সময়ে নেত্রকোনায় ৯৭ মামলায় ১০ হাজার ৮০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ সময়ে নেত্রকোনা সদরে ৩০ মামলায় ৫১০০ জন, মোহনগঞ্জে ১১ মামলায় ১০০০ জন, কেন্দুয়ায় ১৮ মামলায় ১৮০০ জন, পূর্বধলায় ১১ মামলায় ৭৫০জন, মদনে ১০ মামলায় ৯৮০ জন, বারহাট্টায় ৯ মামলায় ১১০০ জন, আটপাড়ায় ১০ মামলায় ৬৫০ জন, কলমাকান্দায় ৮ মামলায় ৮৫০ জন, দুর্গাপুরে ৮ মামলায় ৫০০ জন ও খালিয়াজুরিতে ৯ মামলায় ৯০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে চলতি মাসেই নেত্রকোনা সদরে ৭ মামলায় ১৫০০, মোহনগঞ্জে ২ মামলায় ২০০, কেন্দুয়ায় ২ মামলায় ১০০, পুর্বধলায় ৩ মামলায় ১৫০, মদনে ৩ মামলায় ১৮০, বারহাট্টায় ২ মামলায় ১০০, আটপাড়ায় ২ মামলায় ২২০, কলমাকান্দায় ২ মামলায় ১২০, দুর্গাপুরে ২ মামলায় ১০০ ও খালিয়াজুরিতে ২ মামলায় ১০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর সূত্র জানায়, ২০০৭ থেকে ২০১৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত নেত্রকোনায় ১৩২ মামলায় ২৭ হাজার ৮৯২ জনকে আসামি করেছে পুলিশ।

নেত্রকোনা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. আনোয়ারুল হক বলেন, ২০১৩ সাল থেকেই মামলার বন্যা শুরু হয়েছে নেত্রকোনায়। সামপ্রতিক বছরগুলোতে অন্তত ২৮ বার আমাদের জেলা বিএনপি কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুর করেছে সরকার দলীয় লোকজন। ২০১৫ সাল পর্যন্ত কিছু পাতানো ঘটনা ঘটিয়ে মামলা দেয়া হতো। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। কোনো ঘটনা ছাড়াই মামলা দিচ্ছে। বিশেষ করে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়কে কেন্দ্র করে নেত্রকোনা সদরসহ প্রতিটি থানায় দুটি করে মামলা হয়েছে। ডা. আনোয়ার বলেন, চলতি সেপ্টেম্বর মাসে নেত্রকোনায় ২৭টি মামলা দিয়েছে পুলিশ। মামলাগুলোতে জেলা, থানা থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত বিএনপি ও অঙ্গদলের বর্তমান ও সাবেক সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের আসামি করা হয়েছে। বয়স্ক ও অসুস্থ লোক, সরকারি-বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক, বিদেশে অবস্থানরত এমনকি আইনজীবীদের নামও আছে আসামির তালিকায়। ডা. আনোয়ার বলেন, আগামী নির্বাচনে যারা বিএনপির হয়ে ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করতে পারেন তাদের দেখে দেখেই মামলা দেয়া হচ্ছে। যাতে তারা নির্বাচনে ভূমিকা রাখতে না পারে। বিএনপিকে যাতে নির্বাচনের বাইরে রাখা যায়। তবে এমন গায়েবি মামলার কারণে তৃণমূল নেতাকর্মীরা বরং চাঙ্গা হচ্ছে।

নেত্রকোনা জেলা বিএনপি নেতারা জানান, ২০১৭ সালের ৪ঠা আগস্ট নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলা সদরে বিএনপির সদস্য সংগ্রহ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংঘর্ঘ হয়। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে ১৫০ জন বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করে। এ মামলায় উপজেলা বিএনপির সভাপতি জহিরুল আলম ভূঁইয়াকে প্রধান আসামি করা হয়। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়কে ঘিরে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নেত্রকোনার বিভিন্ন থানায় ২০টি মামলা হয়। বিস্ফোরক ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে দায়ের ওইসব মামলায় আসামি করা হয় প্রায় ৭০০। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়কে ঘিরে ২০১৮ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি জেলা বিএনপি সভাপতি ডা. আনোয়ারুল হককে প্রধান আসামী করে নেত্রকোনায় বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশ এ্যাসল্ট, বিস্ফোরক ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে ৫০০জনকে আসামি করে ৬টি মামলা দায়ের করে পুলিশ। কেন্দুয়া উপজেলায় পুলিশের কাজে বাধা ও পুলিশকে অ্যাসল্ট করায় উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য রফিকুল ইসলাম হিলালীকে প্রধান আসামি করে ১৪৮ জনের নামসহ ২৫০ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ৩৫তম মৃত্যুবার্ষিকীকে কেন্দ্র করে নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলায় পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে কেন্দুয়া উপজেলা সভাপতি রফিকুল ইসলাম হিলালীকে প্রধান আসামি করে ৩০শে মে দায়েরকৃত মামলায় ৩২৭জনকে আসামি করা হয়।  

নেত্রকোনা জেলা বিএনপির সভাপতি আশরাফউদ্দিন খান বলেন, বিএনপি ও অঙ্গদলের নেতাকর্মীদের ওপর দিয়ে বিগত কয়েক বছর ধরে বয়ে যাচ্ছে মামলার সিডর। সে ধারাবাহিকতায় চলতি সেপ্টেম্বরে দুই ডজনের বেশি মামলা হয়েছে এ জেলায়। কেবল সদর উপজেলায় সেপ্টেম্বরের প্রথম দুই সপ্তাহে দায়ের হয়েছে ৭টি মামলা। মামলা ও আসামীর সংখ্যাসহ সার্বিক তথ্য উপজেলা কমিটি থেকে সংগ্রহ করে কয়েকদফায় কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পাঠিয়েছি। কিন্তু এখন এত বেশি মামলা হচ্ছে যে, আমরা তথ্য সংগ্রহ করতেই মন চায় না। নেতাকর্মীদের কষ্টের সহ্য করা যায় না। ছাত্রদলের সাবেক সহ সভাপতি ও নেত্রকোনা-৫ (পূর্বধলা) আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী শহীদুল্লাহ ইমরান বলেন, ১৫ই আগস্টের কর্মসূচি নিয়ে আওয়ামী লীগের দুইগ্রুপের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটে আর সপ্তাহখানেক পরে এ ঘটনায় বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। আবার দলীয় কোন কর্মসূচি না থাকলেও বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর পর জ্বালাও-পোড়াওয়ের অভিযোগে দ্রুতবিচার আইনে দুইটি মামলা করা হয়।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status