বিশ্বজমিন

যে রাঁধে সে স্যাটেলাইটও উড়াতে জানে!

গীতা পাণ্ডে

১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, বুধবার, ৯:৫২ পূর্বাহ্ন

মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথে মহাকাশযান পাঠানোর কাজ তদারকির পাশাপাশি সকাল-বিকাল ৮ জন মানুষের জন্য খাবার রান্না করতে পারবেন? পারবেন, যদি আপনি প্রতিদিন ভোর ৫টায় ঘুম থেকে উঠেন, আর আপনি যদি হন বিপি দক্ষায়নী। ভারতের মহাকাশ সংস্থার ‘ফ্লাইট ডিনামিকস ও স্পেস নেভিগেশনে’র প্রাক্তন প্রধান দক্ষায়নী মহাকাশযান পাঠানো, আর ঘরের কাজ কিভাবে সামলেছেন তা নিয়ে কথা বলেছেন বিবিসির সঙ্গে।

চার বছর আগে ভারতের একটি মহাকাশযান যখন সাফল্যের সঙ্গে মঙ্গলের কক্ষপথে প্রবেশ করে, তখন শাড়িপরিহিত একদল নারী বিজ্ঞানীর আনন্দ উল্লাসের ছবি বিশ্বজুড়ে বেশ আলোড়ন তুলেছিল। ভারতের মহাকাশ প্রকল্পে নারীদের ভূমিকা যে কতখানি ছিল, তা যেন ওই ছবিতেই মূর্ত হয়ে উঠেছিল। এই নারী দলকে অনেকে নাম দিলেন: ‘মঙ্গলের নারীরা।’ এদেরই একজন ছিলেন দক্ষায়নী।
যেই কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে মঙ্গলের কক্ষপথে প্রবেশ করে ওই মহাকাশযান সেটির ওপর নজর রাখার দায়িত্ব ছিল তার নেতৃত্বাধীন দলের। তারাই ওই স্যাটেলাইটকে নির্দেশ পাঠাচ্ছিলেন কোথায় যেতে হবে, কোনদিকে যেতে হবে। তারা নিশ্চিত করছিলেন যে, স্যাটেলাইট যাতে কক্ষচ্যুত না হয়।

এই কাজ যে কত কঠিন ছিল তা বোঝাতে তার এক নারী সহকর্মী একটি মজার তুলনা টানলেন। তিনি বলেন, এটা যেন অনেকটা এমন যে আপনি ভারতে বসে একটি গলফ বলে আঘাত করলেন। আপনার লক্ষ্য হলো বলটি লস অ্যাঞ্জেলসের কোনো একটি ছোট গর্তে (হোল) গিয়ে পড়বে! এই গর্ত আবার স্থির নয়, প্রতিনিয়ত নড়ছে!
নিঃসন্দেহে এটি ছিল গুরুদায়িত্ব। কিন্তু দক্ষায়নী শুধু তো মহাকাশ বিজ্ঞানী নন। তিনি একজন ভারতীয় রমণীও। ফলে ঘরোয়া দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কাজটা আরও কঠিন হয়ে গেল। কিন্তু তার ইচ্ছাশক্তি কতটা অদম্য সেটার প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল বহু বছর আগেই। যখন তিনি চিরায়ত রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে হয়েও বিজ্ঞান নিয়ে ক্যারিয়ার গড়তে লক্ষ্যস্থির করেছিলেন।

ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় অঙ্গরাজ্য কর্নাটকের ভদ্রবতি শহরে ষাটের দশকে দক্ষায়নীর বড় হয়ে উঠা। বিজ্ঞান নিয়ে তার আগ্রহে অবশ্য উৎসাহ দিয়েছিলেন তার বাবা। পুরো শহরে তখন মাত্র একজন নারী ছিলেন যিনি প্রকৌশল নিয়ে পড়াশুনা করেছিলেন। যখনই ওই নারী বাসার কাছ দিয়ে হেটে যেতেন, দক্ষায়নী তাকে এক পলক দেখতে দৌড়ে যেতেন।
তখনকার দিনে মেয়েদের পড়াশোনা করাটা অগ্রাধিকার তো ছিলই না। বরং কোনো মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে, এমনটা বেশ অস্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তার পিতা চেয়েছিলেন মেয়ে পড়–ক। তিনি নিজে পেশায় ছিলেন হিসাবরক্ষক। তবে গণিতে ছিল তার তুখোড় দক্ষতা। তার ইচ্ছাতেই দক্ষায়নী ভর্তি হন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে।

যখন পাশ করলেন, তিনি হয়েছিলেন নিজের ব্যাচে প্রথম।
কিন্তু এরপরই দেখা গেল মতদ্বৈততা। দক্ষায়নী চাইছিলেন মাস্টার্স ডিগ্রী নিতে। কিন্তু তার পিতা ভাবলেন, বিএসসি ডিগ্রিই যথেষ্ট। কিন্তু শেষ অবদি দক্ষায়নীর জেদই জয়ী হলো। ফের তিনি প্রথম হয়ে মাস্টার্স শেষ করলেন।
পড়াশুনা শেষ করে একটি কলেজে চাকরি নিলেন। গণিত পড়াতেন। ওই সময়টায় মহাকাশ ও স্যাটেলাইট নিয়ে তার আগ্রহ ক্রমেই গভীর হচ্ছিল। একদিন তিনি ভারতের মহাকাশ সংস্থা ইসরোয় চাকরির বিজ্ঞপ্তি দেখলেন। আবেদন করলেন। চাকরি পেয়েও গেলেন।
সেটা ১৯৮৪ সালের কথা। দক্ষায়নীকে অরবিটাল ডিনামিকস নিয়ে কাজ করতে বলা হলো। আর আজ তিনি এই বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ। কিন্তু শুরুর দিকে তাকে মৌলিক বিষয়সমূহ রপ্ত করতে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছিল।

পাশাপাশি, তাকে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং করতে দেওয়া হলো। কিন্তু ছোট একটা সমস্যাও ছিল - তিনি এর আগে কখনও কম্পিউটারই দেখেননি। তখনকার দিনে এমনটা অবশ্য খুব অস্বাভাবিক ছিল না। খুব বেশি মানুষের কম্পিউটার ছিল না। স্মার্টফোন বা ট্যাবলেটের তো প্রশ্নই আসে না।
কিন্তু তার কাছে ছিল বই! প্রতিদিন কাজ শেষে বাসায় ফিরে দক্ষায়নী কম্পিউটার প্রোগ্রামিং নিয়ে বই পড়তেন। বেশিদিন না যেতেই দক্ষায়নীর ঘাড়ে এলো আরও নানান কিছিমের ঘরোয়া কাজের দায়িত্ব। কারণ, ইসরোতে চাকরির বয়স এক বছর হতেই তার পিতামাতা তাকে পারিবারিকভাবে বিয়ে দিলেন অর্থোপেডিক সার্জন ডা. মঞ্জুনাথ বাসাভালিঙ্গাপ্পার সঙ্গে। তার মানে দাঁড়ালো হুট করে সংসারের দায়িত্ব এসে পড়লো তার ওপর।

অফিসে তিনি জটিল হিসাবনিকাশ করতেন। স্যাটেলাইটকে গাইড করতে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং করতেন। আর বাসায় তিনি বিশাল এক পরিবার দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন। কারণ, পরিবারে স্বামীর পাশাপাশি শ্বশুর-শাশুড়ি ও তার স্বামীর পাঁচ ভাইবোনও ছিল। কয়েক বছর বাদে ঘরে আসলো তাদের দুই সন্তান।
তিনি বলেন, ‘আমি ভোর ৫টায় উঠে যেতাম। কারণ আমাকে সাত-আট জনের জন্য রাঁধতে হতো। এটা সহজ ছিল না। আর আমাদের খাদ্যাভ্যাস এমন ছিল যে আমাদের রুটিও বানাতে হতো। যেটার জন্য সময় লাগতো। অর্থাৎ, আমি পুরো পরিবারের জন্য রেঁধে তারপর অফিসে আসতাম।’

অফিসে এসেই ঘরের কথা চিন্তা করার ফুরসতই থাকতো না। শুধু বিকেলে একবার বাসায় ফোন দিয়ে দুই সন্তানের খবর নিতে পারতেন। সন্ধ্যায় বাসায় গিয়ে ফের রান্না শুরু করতে হতো। তিনি নিজেও স্বীকার করলেন, খুব কঠিন ছিল বিষয়টা!
দক্ষায়নীর আÍীয়স্বজনদের কেউ কেউ ভেবেছিলেন এক পর্যায়ে চাকরিটা ছেড়েই দেবেন তিনি। কিন্তু তারই ভাষায়, ‘সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র আমি নই।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার বাবাও বলতেন যে শেষ অবদি আমাদের চেষ্টা করা উচিৎ। প্রযুক্তিগত বিষয়েও আমি যদি কিছু না বুঝি, তাহলে আমি বুঝে উঠার আগ পর্যন্ত পড়ি।’ মাঝেমাঝে দক্ষায়নী ঘুমোতে যেতেন রাত ১-২টার দিকে। ফের ভোর ৪-৫টার দিকে উঠতেন রান্নার জন্য।

কিন্তু কোনো কিছু নিয়েই অনুযোগ নেই তার। বরং উল্টোটা বলা চলে। নিজের ঘর ও কর্মক্ষেত্রে কিভাবে সামলেছেন তার বর্ণনা দিতে গিয়ে তার চোখেমুখের উচ্ছলতা ছিল লক্ষণীয়। তিনি বলছিলেন নিজের কাজ তিনি কতটা উপভোগ করতেন। গাণিতিক বা প্রযুক্তিগত সমস্যা সমাধানেই তিনি সুখ খুঁজে পেতেন।
শুধু তা-ই নয়। তিনি রান্না করাও বেশ উপভোগ করেন। এ কারণে হয়তো কাজটা নিশ্চয়ই কিছুটা সহজ হয়ে গিয়েছিল। তার ভাষ্য, ‘আমি ছোট ছোট পরিবর্তন আনতে আনতে নতুন কিছু তৈরির চেষ্টা করি। আমি বলবো রান্না করা যেন অনেকটা কোডিং-এর মতো। কোড-এ সামান্য একটা পরিবর্তন আনলেই যেমন ভিন্ন ফলাফল চলে আসে, তেমনি মশলায় সামান্য পরিবর্তন আনলেই রান্নার স্বাদ পালটে যায়।’

এক সন্ধ্যায় দক্ষায়নী বেঙ্গালোরে তার শান্ত বাড়িটাতে আমাকে নিমন্ত্রণ জানালেন তার স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। তার হাতের চা আর মজাদার ¯œ্যাকস খেতে খেতে এই দম্পত্তি আমাকে বলছিলেন কীভাবে তারা একসাথে এতগুলো বছর কাটিয়ে দিলেন, কীভাবে তারা কঠিন সময়ে একে অপরের সঙ্গে ছিলেন, আর কীভাবে বছরের পর বছর তাদের সম্পর্ক ও একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা ক্রমেই বেড়েছে।
প্রথম কয়েক বছর দক্ষায়নীর স্বামী ঠিক বুঝতেনই না তিনি আদৌ করেন কী! তার ভাষ্য, ‘মাঝেমাঝে আমি শনিবারে কাজে যেতাম। তিনি (স্বামী) ভাবতেন যে বোধ হয় আমি আমার কাজ ঠিকমতো করছি না।’ পরে তিনি ধীরে ধীরে বুঝতে পারলেন যে মহাকাশে থাকা স্যাটেলাইটের গতিবিধির ওপরই দক্ষায়নীর কাজের সময়সীমা নির্ভর করে। ডা. বাসাভালিঙ্গাপ্পা এখন অবশ্য বলেন যে, স্ত্রীকে নিয়ে, তার কঠোর পরিশ্রমে অর্জিত সাফল্য নিয়ে তিনি ভীষণ গর্বিত। বললেন দক্ষায়নীর মঙ্গল মিশন এবং মহাকাশ পুনরুদ্ধার প্রকল্প নিয়ে যেখানে তিনি হিসাব কষে বের করেছিলেন যে মহাকাশ ক্যাপস্যুল পৃথিবীতে কীভাবে পৌঁছলে এটি বিস্ফোরিত হবে না এবং সমুদ্র থেকে নিরাপদে উদ্ধার করা যাবে।

যখন তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম একে অপরকে তারা কত নম্বর দেবেন, ডা. বাসাভালিঙ্গাপ্পা বললেন তিনি তার স্ত্রীকে দশে দশ দেবেন। তবে দক্ষায়নী হেসে উঠলেন। বললেন তিনি স্বামীকে ৯.৫ দেবেন। কারণটাও ব্যাখ্যা করলেন: ‘কারণ তুমি ঘরের কাজে আমাকে সাহায্য করার সময় কখনই পাওনি।’
গড়পড়তা ভারতীয় পরিবারে নারীরাই সংস্কারের বেশিরভাগ দায়িত্ব নেবেন এমনটাই প্রত্যাশা করা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিনা বাক্য ব্যায়ে তা করে যায় নারীরা। দক্ষায়নীও এর ব্যতিক্রম নন।
ডা. বাসাভালিঙ্গাপ্পা অবশ্য ব্যাখ্যার সুরে বললেন, ডাক্তার হওয়া মাঝেমাঝে তাকে ১৮ ঘণ্টাও কাজ করতে হয়। কিন্তু তার স্ত্রী কাজ করতেন অফিসের সময়টা। দক্ষায়নী দৃশ্যত স্বামীর ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট। তবে আগের মতো এখন সংসার নিয়ে তাকে অত ব্যস্ত থাকতে হয় না। তাদের পুত্র-কন্যা দু’ জনই প্রকৌশলী। দু’ জনেই এখন আমেরিকায় থাকে।

তাকে জিজ্ঞেস করলাম অবসর পরবর্তী পরিকল্পনা কী তার। কিন্তু তিনি সম্ভবত পুরো অবসরে যাওয়াটা তার ইচ্ছে নয়। তিনি মঙ্গল নিয়ে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে চান। পৃথিবী ও লোহিত গ্রহ মঙ্গলের মধ্যে পার্থক্য ও অভূতপূর্ব সাদৃশ্যের তালিকা করছেন তিনি।
যেই গ্রহটি নিয়ে কাজ করার সুবাদে তিনি আজ অসংখ্যা ভারতীয় তরুণীর অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন, সেই মঙ্গলেই তার থাকার ইচ্ছা। এই স্বপ্ন যদি কখনও সত্যি হয়ে যায়, তাহলে তিনি আক্ষরিক অর্থেই ‘মঙ্গলের নারী’ হয়ে উঠবেন।
(এই লেখাটি বিবিসির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছিল। সেখান থেকে অনূদিত।)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status