প্রবাসীদের কথা

বাংলাদেশি চিকিৎসদের কথা এখনও মনে রেখেছেন ইরানিরা

কামরুজ্জামান নাবিল

১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮, সোমবার, ১১:২৩ পূর্বাহ্ন

ইরানের দূর্গম পাহাড়ি এলাকার মানুষদেরকে ফ্রি-চিকিৎসা সেবাদানের লক্ষ্যে তিনদিনের একটি ক্যাম্প ছিল। ইরানের বিখ্যাত ইস্পাহান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে ‘জিহাদে সালামাত’ নামক একটি সংস্থা এর আয়োজন করে। তিনদিনের এ ক্যাম্পে যাত্রা শুরু হয় ১২ই সেপ্টেম্বর, বুধবার। ক্যাম্পের সদস্য সংখ্যা ৩০ তরুণ চিকিৎসক। আমাদের গন্তব্যস্থল ইস্পাহান থেকে পশ্চিমে ২০০ কিলোমিটার দূরে ফেরেদুন শহরের পার্শ¦বর্তী এলাকা। পাহাড়ি জনপদের পিছিয়ে পড়া মানুষদের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছিয়ে দেয়াই লক্ষ্য।

ক্যাম্পের ৩০ সদস্যের মধ্যে ছিল মেডিসিন, কার্ডিওলজি, জেনিটিক্স, রেডিওলোজি ও ডেন্টাল বিশেষজ্ঞ একঝাঁক তরুণ মেডিকেল শিক্ষার্থী। ফেরেদুন যাত্রাপথেই কয়েকটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র পরিদর্শন, রোগিদেও সঙ্গে আলাপ এসব দিয়েই শুরু হয় আমাদের মেডিকেল টিমের কার্যক্রম।

মূল গন্তব্যে পৌঁছানোর পরদিন একজন বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে ৪জন করে মোট ৬টি টিমে বিভক্ত হয়ে দূর্গম পাহাড়ি মানুষদের কাছে আমরা পৌঁছে যাই। এরপর সেবা প্রদানের মূল কার্যক্রমের প্রথম দিনের শুরু। আমাদের টিম প্রধান ছিলেন ইস্পাহান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক্স বিভাগের প্রফেসর ডা. মেহেরদাদ জায়নালিয়নের। তার তত্ত্বাবধানে আমাদের চারজনের টিমের যাত্রা কয়েকটি প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামে।

পাহাড়ের ঢালে এবং চূড়ায় কয়েকটি পরিবার নিয়ে গড়ে উঠেছে একেকটি গ্রাম। পাহাড়ের আকাঁবাকাঁ রাস্তা পেরিয়ে সেসব পরিবারের কাছাকাছি আমরা চলে যাই। গ্রামের একটি বাড়ির উঠোনে বসে আমাদের সেবা প্রদান শুরু করি। বিভিন্ন বয়সী লোকদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে বয়স্কদের প্রেসার মেপে দেয়া, ডায়াবেটিস পরিমাপ করা, খাবা
রের আইটেম নিয়ে পরামর্শ ও প্রয়োজনীয় ওষুধ প্রদান ইত্যাদি।

পাহাড়ি এসব এলাকার মানুষের আয়ের প্রধান উৎস কৃষিপণ্য। এর সঙ্গে রয়েছে ভেড়া ও গরু পালন। পাহাড়ি এসব মানুষেরা জানান তাদের খাবারের মেন্যুতে মাংস রাখেন বেশি। সবজি থাকে একবারেই কম। মাংসের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশি থাকায় অধিকাংশ বয়স্ক ব্যক্তিরা উচ্চ রক্তচাপে ভুগেন। এছাড়াও কিছু ব্যক্তিকে দেখা য়ায় যারা ওষুধ থাকার পরেও সেগুলো খেতে অনীহা প্রকাশ করেন। যে কারণে রোগ বহন করেই জীবনযাপন করে চলছেন। এসব নিয়ে তাদের পরামর্শ দিচ্ছিলেন আমাদের টিম প্রধান ডা. মেহেরদাদ জায়নালিয়ন। কথা হচ্ছিল তারা কেমন স্বাস্থ্যসেবা আশা করেন, স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো তাদের পরিপূর্ণভাবে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করছেন কিনা ইত্যাদি বিষয়ে।


প্রেসার বা ডায়াবেটিস মেপে দেবার সময় ডা. জায়নালিয়ন আমাকে সকলের সঙ্গে বাংলাদেশি বলে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এসময় পাশে বসে থাকা একজন বৃদ্ধা স্মরণ করছিলেন ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামী বিপ্লব পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশি চিকিৎসকদের কথা। সেসময় ইরানের স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নে বাংলাদেশ থেকে আসা চিকিৎসকরা তাদের যেভাবে সেবা প্রদান করেছেন। স্বদেশের চিকিৎসকদের সুনাম শুনে আমি আবেগে-আপ্লুত হয়ে যাই। তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।

আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম এমন দুর্গম এলাকাগুলোতে সেই সময় বাংলাদেশী চিকিৎসকরা কিভাবে ইরানিদের মাঝে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। যে কারণে এত বছর পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশি চিকিৎসকদের কথা এখনও স্মরণ করছেন তারা। এটা আমাদের দেশের জন্য গর্বের ও ভালবাসার।


মাদের টিমের কার্যক্রমের মধ্যে চিকিৎসা সেবা প্রদানের বাইরে আরো কিছু বিষয় ছিল। শিশুদের মাঝে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন ও বিজয়ীদের পুরস্কার দেয়া ইত্যাদি। এছাড়াও ছিল ১৫ জন শিশুর বিনামূল্যে খাতনা প্রদান।  

আমাদের সঙ্গে অন্যান্য যে গ্রুপগুলো ছিল তাদের মধ্যে ইস্পাহান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেন্টাল ডিপার্টমেন্টের একজন ডেন্টিস্ট ও শিক্ষার্থী। যারা সে জনপদের মানুষদের দাঁতের চিকিৎসা দিয়েছেন।

অন্যদিকে, কার্ডিওলজি বিশেষজ্ঞ ডা. তেইমুরি ও তার টিম সেবা দিয়ে যাচ্ছিলেন ওই জনপদের হার্টের রোগিদের। এভাবেই ক্যাম্পের ৩০জনের ৩ দিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে সে জনপদের প্রায় দুই হাজার পরিবারের মাঝে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছিয়ে দেয়া হয়।
লেখক: শিক্ষার্থী, ডক্টর অব মেডিসিন, ইস্পাহান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ইরান
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status