প্রথম পাতা

আন্দোলনের মাধ্যমে নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি আদায় করবো

স্টাফ রিপোর্টার

১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮, শুক্রবার, ১০:৩৩ পূর্বাহ্ন

গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেছেন, দেশের এই ক্রান্তিকালে আমরা বৃহত্তর ঐক্য গড়ার উদ্যোগ নিয়েছি। সাড়া পেয়েছি। নীতির বিষয়ে, নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য দলমত নির্বিশেষে সবাই ঐক্যবদ্ধ হলে তা বৃহৎ শক্তিতে পরিণত হবে। প্রয়োজনে আন্দোলনের মাধ্যমে নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি আদায় করবো। নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলে থাকাকালে যে শর্ত বা দফাগুলো দিয়েছিলেন তা তো এখনো প্রযোজ্য হবে। কিন্তু স্বৈরাচার আমাদের দুর্বল করার জন্য বিভেদ সৃষ্টি করছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের শহীদ শফিউর রহমান মিলনায়তনে আইনজীবীদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীনের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উদ্দিন খোকনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সভায় দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আইনজীবী ও সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন এই প্রবীণ আইনজ্ঞ।

তিনি বলেন, অতীতে নির্বাচনকালীন সরকার কী পটভূমিতে এসেছিল? যাতে প্রশাসনিক পক্ষপাতিত্ব না হয়। নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়। সে জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেছিল। নির্বাচন চলাকালে সরকারকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীর হাতে নির্বাচন বা বিচারের ক্ষমতা থাকতে পারবে না। মতবিনিময় সভায় ড. কামাল বলেন, আপনারা জানেন আমাদের বিচার বিভাগকে কীভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। ৪৬ বছরেও সংবিধান বলবৎ আছে। সবার মত নিয়ে প্রয়োজনে তা সংশোধন করতে হবে। পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্র বলতে পারবে না যে, সংবিধান সংশোধন বা সংস্কারের প্রয়োজন নেই। তাকে রক্ষা করতে হবে। রাষ্ট্র, সার্বভৌমত্ব, মৌলিক অধিকার রক্ষা করতে হবে। যাতে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো দায়িত্ব পালন করতে পারে।

এরশাদ শাসনামলকে স্বৈরশাসন উল্লেখ করে একটি ঘটনার স্মৃতিচারণ করে বলেন, তখন তো এক সঙ্গে আইনজীবী সমিতির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ ১৩ জন বিশিষ্ট আইনজীবীকে আটক করে অন্তরীণ করা হয়েছিল। সে সময় স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোর্ট বন্ধ হয়ে যায়। তখন এরশাদ বুঝেছিল এটা (আদালত) ভয়ঙ্কর জায়গা। এই কোর্ট এমনিতে আসেনি।

এমনিতে বাঁচেনি। আন্দোলন করে বাঁচাতে হবে। স্বৈরাচারী মনোভাব যাদের তারা বলবে যে, এই জায়গা ভয়ঙ্কর। সাবেক বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা যে কাজ করেছেন তা চিরদিন অমর হয়ে থাকবেন। বলুন তো সরকারের বিপক্ষে রায় দিলে যদি চাকরি যাওয়ার ভয় থাকে তাহলে কী তার পক্ষে রায় দেয়া সম্ভব? আদালতের অবস্থা সে জায়গায় দাঁড়িয়েছে। একটা শিশুও তো তা বুঝবে। চিফ জাস্টিসকে (সরিয়ে) অপমান করা হয়েছে। সংবিধান লঙ্ঘন করা হয়েছে। একদিন না একদিন এর বিচার করেই ছাড়বো।

জনগণকে ক্ষমতার মালিক উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, সংবিধান হলো একটা ঢাল। রাষ্ট্র ক্ষমতার অপপ্রয়োগে মানুষ এই ঢালকে নিয়ে দাঁড়াতে পারে। তা দিয়ে বাঁচতে পারে। যখনই বড় সমস্যা আসে তখনই এই ঢালকে নিয়ে সমাধানের চেষ্টা হতে পারে। এজন্য প্রয়োজনে কোর্টে যাওয়া যেতে পারে।

কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্র আন্দোলনের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, ছাত্ররা শান্তিপূর্ণভাবে রাস্তায় নেমেছে। কোটা বাতিল নয়। সংস্কার চেয়েছে। কোথাও সংস্কারের প্রয়োজন নেই তা কেউ বলতে পারবে না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ বললেন বাতিল। ছাত্ররা যখন চেক করলো, তখন দেখলো অনেক গাড়ির লাইসেন্স নেই।

কারাগারে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিচারের জন্য আদালত বসানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জেলখানায় আদালত স্ববিরোধী। জেলখানায় জেলখানা থাকবে। আদালতে থাকবে আদালত। জেলখানায় কেন আদালত হলো? কেন অস্বাভাবিক এই আদালত করার প্রয়োজন পড়লো। আদালতে তো অনেক নাটকীয়তাও হয়েছে। এসব কেন তা তো বুঝতে হবে।  

দেশে সভা-সমাবেশসহ গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া প্রসঙ্গে এক আইনজীবীর প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কথা বলার অধিকার, সভা-সমাবেশের অধিকার নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। তবে যুক্তিসঙ্গতভাবে কিছু অধিকারে রেসটিকশন দেয়া যেতে পারে। কিন্তু যেনতেনভাবে তা যেন পাইকারি হতে পারে না। তা হতে থাকলে কোর্টে যেতে পারি। সংবিধান ও আইন অনুযায়ী আটক ও বিচার হবে। কিন্তু মানুষকে কথা বলার অধিকার দিতে হবে। আমি মনে করি এসব বিষয়ে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব। অস্বাভাবিক কোনো কিছু কেন করতে হবে। অপরাধ করলে ফরমাল বিচার ও শাস্তি হবে। বিনা বিচারে জেলের বিরুদ্ধে তো আমরা আগে থেকেই বলে আসছি।

এক প্রশ্নের উত্তরে নির্বাচনকালীন সরকার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সংবিধান সংশোধন করে বর্তমান সরকার এটা করেছে। আগে সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন হতো। দেশে এসব আলোচনা তো শুরু হয়েছে। কোনো দেশে সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন হয়। আবার কোনো দেশে সংসদ রেখে নির্বাচন হয়। কিন্তু আমাদের ঐতিহ্য ও প্রেক্ষাপটে তো সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করতে হবে। আর অসাংবিধানিক প্রশ্নগুলো আইনজীবীরা কোর্টে নিতে পারেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

দেশের সংকট উত্তরণে চলমান ঐক্যপ্রক্রিয়া সম্পর্কে ড. কামাল বলেন, গত ৪৬ বছর ধরে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে নানা অসম্ভবকে সম্ভব করেছি। ঐক্যবদ্ধভাবে করলে জিনিসটা জোর পায়। তবে দলীয় রাজনীতির নামে নৈতিকভাবে আমরা বিভেদ সৃষ্টি না করি। দলমতনির্বিশেষে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে পারি। সব বিষয়ে দলকে টেনে আনা আমি ভালো মনে করি না।

তিনি আরো বলেন, দেশে মানবাধিকার, গণতন্ত্র, আইনের শাসন রক্ষা করার জন্য দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় ঐক্য গড়তে হবে। সংবিধান সংশোধনের জন্য সরকার কাজ করতে পারে। সরকার না করলে সেই লক্ষ্যে আইনজীবী সমিতির বর্তমান ও সাবেক সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক ও আইনের শিক্ষকরা মিলে তাদের অভিজ্ঞতা, আইনি বিধান ইত্যাদি নিয়ে কাজ করতে পারেন। এজন্য একটি কমিটি বা কমিশনও তারা গঠন করতে পারেন। আদালত, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ইত্যাদি নিয়ে কাজ করতে হবে। আইনে বা বিচার বিভাগে এখনো অনেক ঘাটতি রয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।   

সুষ্ঠু নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অবাধ নির্বাচনের জন্য হয়রানিবিহীন সুষ্ঠু পরিবেশ দরকার। প্রয়োজন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড। সুষ্ঠু পরিবেশ সবার দাবি। আমি ঐক্যের একজন উদ্যোক্তা। আমরা যেন ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করি। যাতে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়। গত ৪৬ বছরে আমরা দেখেছি যে, স্বৈরাচার ১০ বছরের বেশি টিকতে পারেনি। তবে সরকারের বিরুদ্ধে নয়। সংবিধানের পক্ষে আমরা ঐক্যবদ্ধ হবো। তিনি বলেন, এখন এমন অবস্থা বিরাজ করছে কোর্টে এসে যাচাই বাছাই করা যায় না। পরবর্তীতে নির্বাচিত সরকার আসলে পার্লামেন্টে বা কোর্টের মাধ্যমে তা অবৈধ বলে ঘোষণা করা যেতে পারে।

সভাপতির সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নাল আবেদীন বলেন, রাজনীতির ঊর্ধ্বে থেকে আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করবো। তাই আমাদের চেষ্টা থাকবে।

আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, এখন আমাদের জাতীয় সমস্যা সংবিধানকে সমুন্নত রাখা। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। পুলিশ যাকে তাকে ধরে ডিবি অফিসে নিয়ে যায়। কয়েকদিন পর বলে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সরকার বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে। আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে এক প্রকার নিয়ন্ত্রণ করছে।

সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা সর্বসম্মত রায় দেয়ার পর কিছু আইনজীবী তাকে আলটিমেটাম দিলো আর বসতে দেবেন না। এরপর তাকে অসুস্থ বানিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া হলো। তাকে পদত্যাগের জন্যও দেশে আসতে দেয়া হয়নি। বিদেশে থেকে তাকে পদত্যাগ করতে হয়। এমনকি সর্বজনীন ভোটাধিকারও দেয়া হচ্ছে না। মতবিনিময় সভায় আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেনসহ সিনিয়র আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status