রকমারি

যেখানে টাকা দিয়ে বউ কেনা যায়

৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮, মঙ্গলবার, ১২:১৩ অপরাহ্ন

অল্প বয়সী মেয়েদের টাকার বিনিময়ে বিক্রি করার মতো ভয়াবহ ঘটনা নাইজেরিয়ার একটি সম্প্রদায়ের জন্য নিত্যদিনের ব্যাপার।

নাইজেরিয়ার সর্বদক্ষিণের ক্রস রিভার রাজ্যের বেশেরে সম্প্রদায়ে মানি ম্যারেজ বা অর্থের বিনিময়ে অল্প বয়সী মেয়েদের বিয়ের নামে বিক্রি করে দেয়া একটি প্রচলিত প্রথা।

মূলত দারিদ্র্যপীড়িত পরিবারের শিশুদের বিয়ের নামে মোটা অংকের বিনিময়ে কিনে নেয় প্রভাবশালীরা।

দেশটির আরও কয়েকটি সম্প্রদায়ের মধ্যে এখনও এ ধরণের বিতর্কিত প্রথার চল রয়েছে।

যেখানে বিক্রি হওয়া মেয়েটির না থাকে কোন স্বাধীনতা বা শিক্ষা/চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ।

স্থানীয় ধর্মীয় নেতারা এই প্রথার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালালেও কোন লাভ হচ্ছেনা।

সেই সম্প্রদায়ের তরুণী ডরফি। তার বয়স এখন প্রায় বিশের কোটায় হলেও তাকে যখন বিয়ে দেয়া হয়েছিল তার বয়স ছিল মাত্র ১০ কি ১১ বছর।

ওই বয়সে তাকে এমন এক ব্যক্তির হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল যার বয়স কিনা তার নানা দাদার চাইতেও বেশি।

ডরফির আপন মা ও চাচা টাকার জন্য তাকে ওই বৃদ্ধের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল। বাধ্য করেছিল মানি ম্যারেজ করতে।এখনও সেই দিনগুলোর কথা মনে করে ভয়ে শিউরে ওঠেন ডরফি। তিনি জানান,

"আমার লোকটি আমার সঙ্গে শুতে চাইলে আমি বলতাম, না, আমি এমনটা হতে দেব না, কারণ আপনি আমার বয়সের না। আপনার ছেলেমেয়েরাও আমার অনেক বড়। যখন আমি মানা করতাম, তখন সে আরও দুইজন লোক ডেকে আমার ওপর জবরদস্তি করতো।"

এভাবেই অমানুষিক নির্যাতনের এক পর্যায়ে অন্ত:সত্ত্বা হয়ে পড়েন ডরফি। অথচ সন্তান ধারণ করার মতো বয়সও তখন তার হয়নি।

মানি ওয়াইফ বা অর্থের বিনিময়ে বিক্রি হওয়া বউ হওয়ায় ডরফির যেন সাহায্য চাওয়ারও কোন জায়গা ছিল না।

বেশেরে সম্প্রদায়ে মূলত দুই ধরণের বিয়ে রয়েছে। একটি হল লাভ ম্যারেজ বা ভালবাসার বিয়ে এবং অপরটি এই মানি ম্যারেজ।

লাভ ম্যারেজে স্ত্রীর জন্য কোন পণ দিতে হয়না। নববধূ স্বাধীনভাবে বাবার বাড়ি আসতে যেতে পারে এবং তার ঘরে যে সন্তান জন্ম নেবে সেটা মায়ের পরিবারের উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচিত হয়।কিন্তু মানি ম্যারেজে কম বয়সী মেয়েদের বিক্রি করে দেয়ায় তারা তাদের স্বামীর পরিবারের সম্পত্তিতে পরিণত হয়। এমনটাই জানান স্থানীয় মিশনারি ও শিশু অধিকার আন্দোলনকারী পস্তোর রিচার্ড। তিনি বলেন,

"একজন মানি ওম্যানের কোন সম্মান থাকেনা। তাদের স্কুলে যাওয়ার অনুমতি নেই, তাদেরকে ঠিকঠাক খেতেও দেয়া হয়না। সে সবার উচ্ছিষ্ট খায়। তারা শিশুশ্রম থেকে শুরু করে অমানবিক যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। অনেকে অন্ত:সত্ত্বা হলেও মায়ের বাড়ি যাওয়ার সুযোগ পায়না।"

এই সম্প্রদায়েরই আরেকজন সদস্য মনিকা।

তিনি থাকেন গাছপালা বেষ্টিত একটি এলাকায় যার চারপাশ উঁচু পাহাড় আর সবুজের গালিচায় ছাওয়া।

তবে সেই সুন্দরের ছোঁয়া মনিকার পরিবারে নেই। তিনি তার দুই নাতনিকে খুব ছোট থাকতেই মানি ম্যারেজের জন্য বিক্রি করে দিয়েছেন।

এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, পরিবারকে জুজু নামের অভিশাপ থেকে রক্ষা করতে মোটা অংকের অর্থ দরকার ছিল। আর এজন্যই তিনি নাতনিদের বিক্রি করে দিয়েছিলেন।

তবে এক বছর পর সেই সিদ্ধান্তের জন্য ভীষণ অপরাধবোধে ভুগছেন মনিকা।

তার নাতনি হ্যাপিনেসের এখন বয়স ১৫ বছর। গত বছর সে তার মানি ম্যারেজ থেকে পালিয়ে এসেছে। হ্যাপিনেস জানান,

"ওই লোকটার এতোই বয়স যে তার নাতি নাতনির ঘরেও সন্তান রয়েছে। লোকটা প্রায়ই আমাকে মারত আর বলতো, আমাকে যদি সে পিটিয়ে মেরেও ফেলে তাকে কেউ কিছু বলতে পারবেনা। আমাকে মেরেও ফেললেও তার কিছু হবে না। কারণ আমি তার মানি ওয়াইফ।"

ওই ঘটনার কারণে মনিকার সঙ্গে তার দুই মেয়ে ও দুই নাতনির সম্পর্ক আজও স্বাভাবিক হয়নি। এখনো দাদীর প্রতি তীব্র ক্ষোভের কথা জানান হ্যাপিনেস।

"আমি আমার দাদিকে একটা মেসেজ পাঠিয়েছি। সেখানে আমি লিখেছি যদি আমি মারা যাই এবং সে যদি আমার শেষকৃত্যে আসে, বাইকে করে। তাহলে একটা দুর্ঘটনায় তার হাত পা ভেঙ্গে যাবে।"

তিনি আরও বলেন, "যেদিন আমি স্বামীর বাড়ি ছেড়ে এলাম, সেদিন তাকে আমি বলেছি, কোনদিন আমি এতোটাই রেগে যাব যে আমি একটা ছুরি নিয়ে তাকে খুন করে ফেলতে পারি।"তবে এই সম্প্রদায়ের প্রধান চিভসামদে চিলে জানান, এখন মানি ওয়াইফ প্রথার কোন অস্তিত্ব নেই।

যাদের বয়স ১৮ বছরের নীচে তাদের কাউকে মানি ওয়াইফ হিসেবে বিয়ে করা যায়না। তিনি বলেন,

"এখনও অনেক মানুষ মনে করে যে বেশেরে সম্প্রদায়ে এখনও মানি ম্যারিজ হয়ে থাকে। কিন্তু এখন আর এসব হয়না। এটা নব্বই দশকের শুরুর দিকেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। "

তবে বাস্তব চিত্র পুরোই উল্টো। দুর্ভাগ্যবশত বেশেরের বেশিরভাগ গ্রাম প্রধানকেই মানি ওয়াইফ রাখতে দেখা যায়।

পাস্তোর রিচার্ড বিদ্রূপের সুরে বলেন, "এই মানি ম্যারেজের ঘটনা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেও গ্রাম প্রধানরা বলবে, এই বিয়ে সবশেষ হয়েছিলো সেই ১৯৯৯ সালে। অথচ কয়েকদিন আগেই আমরা ১৭ বছর বয়সী একটি মেয়েকে উদ্ধার করেছি।"

২০০৯ সালেই নাইজেরিয়া থেকে মানি ম্যারেজ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হলেও দায়ীদের কাউকে শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। এ ধরণের প্রথাকে নিশ্চিহ্ন করতে পাস্তর রিচার্ডের মতো আরও অনেক আন্দোলনকারী কাজ করে যাচ্ছে।

তবে এখনও মানি ওয়াইফ রাখা সামাজিক মর্যাদার বিষয় হয়ে দাঁড়ানোয় আর এই প্রথা বিলুপ্তির কোন আভাস দেখা যাচ্ছেনা।

হ্যাপিনেসকে যখন বিয়ে দেয়া হয় তখন সে ছিল নিতান্তই শিশু।

দিনে দিনে দাদির প্রতি তার ক্ষোভ অনেকটাই হালকা হয়ে এসেছে। এখন তার দাদিকে দেখলেই করুণা হয়।

তিনি বলেন, "যখন আমি তাকে দেখি, অনেক খারাপ লাগে। আমি দোয়া করেছি যেন তার দোষ সব মাফ করে দেয়া হয়। কারণ সে সময় তিনি জানতেন না যে কি করছেন।"

সূত্রঃ বিবিসি
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status