চলতে ফিরতে

মাদাম তুসোতে নেই বঙ্গবন্ধু, নজরুল

ইশরাক পারভীন খুশি

২৭ আগস্ট ২০১৮, সোমবার, ১১:৫৩ পূর্বাহ্ন

সোম থেকে শুক্র রোজ সকাল ৭টায় ঘুম থেকে উঠে ঢুলু ঢুলু চোখে এক কাপ চা আর দুটো টোস্ট খেয়ে এক গাদা শীতের জামা, জুতো, কোট মাফলার, টুপি আর হাতমোজা কোনো কিছু বাদ যায় না গায়ে চড়িয়ে বের হয়ে যাই স্টেশনের উদ্দেশে। এক বস্তা কাপড় চোপড় পড়ার পরও দাঁত কামড়ানো শীতে হু হু করতে করতে বাসে চড়ে স্টেশনে যাই পাতাল রেল ধরার জন্য। ঘুমাতে ঘুমাতেই রেলে চড়ি বসি। ভাগ্য ভালো হলে সিট পাই আর আরাম করে একটা ঘণ্টা ঘুমিয়ে পড়ি অসমাপ্ত ঘুমকে পূর্ণতা দেয়ার জন্য। আর বসার জায়গা না পেলে দাঁড়িয়ে ঘুম ঘুম আচ্ছন্নতা নিয়ে আফসোস করতে থাকি আহা ঘুম! আর পাতাল রেলের টিউব অন্ধকার টানেল ধরে হুস হুস করে চলতে থাকে সেন্ট্রাল লন্ডনের দিকে।

গা ঠেসাঠেসি ভিড় থাকে এ সময়। দুই সারি সিটে মানুষ বসে আর মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকে। এত ভিড় তবু কেউ কারো গায়ে হাত দেয় না লোলুপের মতো। প্রসূতি মা দেখলে সিট ছেড়ে দেয়, বৃদ্ধ বা শিশুদের জন্য একই ব্যবহার। আছে বা
চ্চা বহনকারী স্টলার রাখবার সুবন্দোবস্ত।

আমি যেখানে বসবাস করতাম সেখান থেকে আমার কাজে যেতে দেড় ঘণ্টা লাগত। পুরো লন্ডন শহরটা ছয়টা জোনে বিভক্ত। বৃত্তাকারে একটা বৃত্তের মাঝে আরেকটি বৃত্ত। মাঝের বৃত্তটিই সেন্ট্রাল লন্ডন। অক্সফোর্ড স্ট্রিট, মার্বল আর্চ, পিকাডেলি সার্কাস, ট্রাফলগার স্কয়ার এসব এলাকা শহরের ব্যস্ততম প্রাণকেন্দ্র। সেই কেন্দ্রবিন্দুতেই আমি কাজ করতাম। প্রাণভোমরও একটা জিমে ও একটা ফাস্ট ফুডের দোকানে কাজ করতো পার্টটাইম। তার কাজ ছিল শনি রবি আর বাকি পাঁচ দিন স্কুল, আমি কাজ করতাম সোম থেকে শুক্র আর শনি রবি বাসার রান্না বান্না ইত্যাদি। দু’জনের একসঙ্গে বন্ধ পাওয়া যেত না তারপরও অনেক ঘুরেছি। লন্ডনের দর্শনীয় স্থানগুলো শেষ করার পর শুধুমাত্র ডাবল ডেকার বাসে চড়েই ঘুরেছি কত! যেকোনো একটা বাসে উঠে বসতাম আর নামতাম নাম না জানা শেষ কোনো স্টপেজে। সেখান থেকে আবার ফেরত আসতাম পরের বাসে। পথের সৌন্দর্য্য দেখতে দেখতে গল্প চলতো ফেলে আসা পরিবারের সবার কথা নিয়ে।

লন্ডনের পাবলিক বাসে চড়তে অসম্ভব মজা লাগে। একটা বাস আছে নাম ২৫, কেঁচোর মতো লম্বা, দুটো বাসকে জোড়া লাগালে যেমন হয় তেমন। আর ডাবল ডেকারে বসলে পুরো শহরকে দেখতে দেখতে যাওয়া যায়। স্টার্টফোর্ড, পপলার, স্টেপনি গ্রিন, সেন্টপল, পিকাডেলি সার্কাস, অক্সফোর্ড স্ট্রিট,  ব্রিকলেন সব তুই ঘুরতে পারবি এ মাথা থেকে সে মাথা। বাসের মধ্যেই স্ট্রলার, হুইল চেয়ার রাখার জায়গা শুধু আছে তা নয় আছে হুইল চেয়ার উঠাবার অত্যাধুনিক ব্যবস্থাও।
একদিন বাস চলতে চলতে হঠাৎ মাঝ রাস্তায় থেমে গেল। বেশ অবাক হলাম। স্টপেজ ছাড়া বাস থামবার তো কথা নয়। দেখলাম ড্রাইভার নেমে গেল। কি হলো উৎসুক হয়ে তাকিয়ে দেখি ড্রাইভার এক বৃদ্ধ মহিলাকে হাত ধরে নিয়ে আসছে। বুঝলাম ওদের ভদ্রতার মাত্রা কতখানি। বৃদ্ধাকে যাতে স্টপেজ পর্যন্ত হাঁটতে না হয় আর তার ফলে বাস মিস না করে তার জন্য বাস তাকে মাঝ পথেই তুলে নিলো। ওখানে তো রিকশা চলে না কাজেই বাস স্টপেজ বা স্টেশন যতদূরেই থাক শীত কি গ্রীষ্ম, তুষার কি বৃষ্টি তোমাকে হাঁটতেই হবে সেখানে পৌঁছাতে।

অক্সফোর্ড স্ট্রিটের রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকলে রাস্তার দু’ধারে সমস্ত বড় বড় বিপণী বিতান, রেস্তোরাঁ, অফিস বলা যায় মানুষের সমাগম আর ব্যস্ততায় মুখরিত নগর। একটা বিপণিকেন্দ্রের কথা বলি যার নাম সেলফ্রিজ। ওই অভিজাত বিপণিকেন্দ্রটি রাজপ্রাসাদের মতো দেখতে। বাইরের বিশাল কাঁচ ঘেরা জানালাগুলো প্রতি মাস অন্তর অন্তর সাজানো হতো একেকটা বিষয় নিয়ে। কখনো ১৮০৭ সালের একটি দিন সাজসজ্জায় শোভা পাচ্ছে, কখনো স্নো ঘেরা পরিবেশ তৈরি করেছে আবার কখনো বিশেষ দিন যেমন ক্রিসমাসের ঝলমলে কোনোদিন। এত নিখুঁত আর এত চমকপ্রদভাবে সাজানো যে দেখতে দেখতে হারিয়ে যাওয়া যায় ওই সাজানো পরিবেশের ভেতর। ক্রিসমাসে তো শহর অন্য এক নগরীতে রূপান্তরিত হয় এখানে। পুরো অক্সফোর্ড স্ট্রিট রূপকথার রাজ্য হয়ে যায়। দোকানপাট রাস্তাঘাট বিভিন্ন আলোক সজ্জায় যাদুকরী হয়ে ওঠে তখন। কেনসিংটনে আছে হেরডস নামে আরেকটি প্রাসাদতুল্য অভিজাত বিপণিবিতান। একসময় সৌদির ধনাঢ্য ব্যবসায়ী দোদি আল ফায়াদের বাবা যার মালিক ছিল। লন্ডন শহরের সমস্ত ভবনে প্রাচীন চারুকারুকে ধরে রাখার জন্য সব দোকানপাট অফিস আদালত, মিউজিয়াম সব কিছুতেই ঐতিহ্যের ছোঁয়া পাওয়া যায়।

পিকাডেলী সার্কাস আরেকটি কেন্দ্রবিন্দু। এখানে দ্য স্ট্যাচু অব ইরোস, রয়েছে নিয়ন আলোর বিজ্ঞাপন বার্তা, যেখানে কোকাকোলা কোম্পানির প্রথম নিয়ন বিজ্ঞাপন চালু হয়। আরেকটি মজার জিনিস আছে, তোর কি মনে আছে ছোটবেলার দেখা বিটিভির ‘বিলিভ ইট অর নট’ শো? পৃথিবীর সব আশ্চর্য বিষয় নিয়ে সেই জাদুঘর।

ট্রাফলগার স্কয়ারে ফোয়ারা, ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারি, হাইড পার্ক, বার্কিংহাম প্যালেসে কালো ভাল্লুক টুপি পরিহিত দারওয়ান, ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে বিশালাকারের ডাইনোসরের ফসিল দেখতে দেখতে প্রাগৈতিহাসিক কোনো জগতে চলে যাওয়া যায়। এসবের ছবি ও বিস্তারিত বর্ণনা ইন্টারনেটের যুগে মোটেই হাতের নাগালের বাইরে নয়। সমস্ত পৃথিবীটাই একটা ছোট মুঠোফোনে বন্দি। চিচিং ফাঁকের মতো খুলজা সিমসিম বললেই গুগল রাশি রাশি রতœভান্ডারের মতো তথ্যভান্ডার উন্মুক্ত করে দেবে।

এই লন্ডনেই রয়েছে ভারতের সবচেয়ে বড় হীরে কোহিনূর। যা নিয়ে নানা কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। যার ভেতর থেকে নীল অথবা লাল কিংবা আশ্চর্য কোনো দ্যুতি ঠিকরে বের হচ্ছে। অভিযোগ আছে, ব্রিটিশরা সমস্ত পৃথিবীর সব রাজ্যের সমস্ত নামি দামি দুর্লভ ও ঐতিহাসিক জিনিসগুলো এনে যতœ করে সাজিয়ে রেখেছে তাদের মিউজিয়ামে। না হলে কিভাবে তাদের এই বিশাল সংগ্রহ। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রয়েছে আট মিলিয়ন সংগৃহীত উপাদান। ব্রিটিশ মিউজিয়াম ও ব্রিটিশ লাইব্রেরি আলাদা জায়গায় আলাদা ভবন হলেও তারা সংযুক্ত। কোহিনূর হীরে অবশ্য বৃটিশ মিউজিয়ামে নেই। আছে টাওয়ার মিউজিয়ামে। বৃটিশ মিউজিয়ামে প্রতিটি উপমহাদেশের অতি দুর্লভ সব জিনিস নিয়ে সাজানো আছে এক একটি মহাদেশ। একেকটি মহাদেশে যেন একেকটি আলাদা জগত। সেখানে মিশরের মমি কাঁচের ঘরে শুয়ে আছে।  সেখানে মানুষগুলো ভীষণ দাপটের সঙ্গে মিশরের বালুর পাহাড়ের ওপর ঘোড়া অথবা উটে সাওয়ার হয়ে ছুটছে। হয়তো কোনো হাবসি কালার পিঠে চাবুক মেরে পিরামিড তৈরির পাথর বহন করতে বাধ্য করেছে। আজ সে নিজেই দেখবার বস্তু। সোনা হীরা খচিত দামি কফিনে সোনার মোহর ছড়ানো শয্যাই নিছক এক অস্থি কঙ্কাল।

মাদাম তুসোর মোম দিয়ে বানানো পৃথিবীর সমস্ত বিখ্যাত ব্যক্তিদের ভাস্কর্যের এক অত্যাশ্চর্য জাদুঘর। মোম দিয়ে এত চমৎকার ও অবিকল মানুষের মতো এক একটি এমনভাবে সামনে দাঁড়ায় যে মনে হবে আরে অমিতাভ! আরে আরে ঐশ্বর্য রায়, শাহরুখ, সালমান! দিশাহারা হয়ে আমি একেকটা ব্যক্তিত্ব আইনস্টাইন, ওবামা, গান্ধী, রানী এলিজাবেথের সঙ্গে ছবি তুলছি। হাত ধরে, গা ধরে কত নকশা! প্রাণভোমর হঠাৎ বলল এই দেখো ওর সামনে দিয়ে যেওনা ও ছবি তুলছে। চমকে উঠে লজ্জা পেয়ে একপাশে সরে দাঁড়ালাম। খুব স্মার্ট এক মহিলা ঘাড়ে ঝোলা ব্যাগ হাতে দামি একটা ক্যামেরা নিয়ে সামনের এক মোম মানবের ছবি তুলছে। সরি বলতে যাব সে সময় অট্টহাসি বেরিয়ে এলো মুখ দিয়ে, আরে ও নিজেই তো এক মোম মানবী।

মাদাম তুসোতে আরো দুটি জিনিস খুব ভালো লেগেছে তাহলো ছোট ট্রেনের মতো একটা গাড়িতে চড়িয়ে সময় ভ্রমণ। সেই প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে রাজাদের হুকুমে জল্লাদের মানুষের মাথা কাটবার সমস্ত বিষয় আলো আঁধারি দিয়ে অবিকল সেই আমেজে তৈরি করা। আর একটা ভূতুড়ে গুহা হেঁটে পাড়ি দিতে হয় যেখানে প্রবেশের আগেই হার্ট কতটা মজবুত জিজ্ঞেস করা হয়। আমি পুরো গুহাটা প্রাণভোমরের হাত জাপটে ধরে চোখ বন্ধ করে পার হয়েছিলাম। চোখ বন্ধ থাকলে কি, কান তো বন্ধ নয়। শুনতে পাচ্ছিলাম ভয়ঙ্কর সব আওয়াজ। কানের খুব কাছে চিৎকার, ফিসফিসানি আর নানাবিধ ভয়ঙ্কর শব্দ। তার মধ্য আমার পাশের সঙ্গীটিও দু একবার ভয়ে চিৎকার করে উঠল আ আ উ উ বলে। পরে শুনলাম আচমকা এ-গলি সে-গলি থেকে ভূত প্রেত ড্রাকুলা বের হয়ে এসেছিল বার কতক। কতগুলো ছেলে মেয়ে সেসব সাজসজ্জা করে সত্যিকার ভূতপ্রেত হয়ে আচমকা সামনে আসছিল ভয় দেখাবার জন্য। খুব ভালো লেগেছিল, তারপরও মন খারাপ করে মুখটা হাঁড়ি করে বাড়ি ফিরলাম। কেন মন খারাপ করবো না বল মোমের জাদুঘরে পৃথিবীর তাবৎ বিখ্যাত মানুষ আছে, আছে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, আছে বলিউড হলিউডের নানা চরিত্র অথচ আমাদের বঙ্গবন্ধু নেই, নেই আমাদের নজরুল রবীন্দ্রনাথ।
লেখক: টেক্সাস (যুক্তরাষ্ট্র) প্রবাসী
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status