খেলা

‘কী ছিলাম আর এখন কী হয়েছি’

২১ আগস্ট ২০১৮, মঙ্গলবার, ৩:৫২ পূর্বাহ্ন

মাইকেল ভনের মনে কোনও সংশয় নেই। এই প্রজন্মে তিনিই বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান। ইংল্যান্ডের প্রাক্তন অধিনায়ক সাফ বলে দিতে চান, এ রকম ধারাবাহিকতার পরে আর কারও সঙ্গে তুলনার জায়গাই নেই।

তিনি মানে বিরাট কোহালি। যাঁকে সচিন তেন্ডুলকর পরবর্তী যুগে ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন ব্যাটিং সম্রাট ধরা হচ্ছে। লর্ডসে তাঁর দল যখন দুরমুশ হচ্ছে, তখন তিনি নিজে পিঠের ব্যথায় আক্রান্ত ছিলেন। মনে হচ্ছিল, ট্রেন্ট ব্রিজে তো বটেই বাকি সিরিজেই না অনিশ্চিত হয়ে পড়েন! লন্ডনে এর পর তিন দিন ধরে রিহ্যাব করেন কোহালি। ট্রেন্ট ব্রিজ টেস্টে নেমেছেন নেটে কোনও বোলারকে না খেলে। শুধু ব্যাটিং কোচ সঞ্জয় বাঙ্গার এবং থ্রো-ডাউন স্পেশ্যালিস্ট বল ছুড়ে ছুড়ে তাঁকে ব্যাটিং প্র্যাক্টিস করিয়েছেন। আধা-ফিট অবস্থায় ব্যথা কমানোর ওষুধ খেয়ে খেলতে নেমে দুই ইনিংসে করে গেলেন ৯৭ এবং ১০৩। এবং কোন পরিস্থিতিতে? না, তাঁর দলকে সিরিজে টিকে থাকতে গেলে ট্রেন্ট ব্রিজ টেস্টে জিততেই হবে!

কোহালির দুই ইনিংসের ব্যাটিং বিক্রম, অজিঙ্ক রাহানে-চেতেশ্বর পূজারার যোগ্য সঙ্গত, হার্দিক পাণ্ড্যর অলরাউন্ড প্রদর্শনী এবং প্রথম ইনিংসের দুরন্ত বোলিং পারফরম্যান্সের উপরে দাঁড়িয়ে সত্যিই জয়ের স্বপ্ন দেখা শুরু হয়ে গিয়েছে। দ্বিতীয় ইনিংসে ৩৫২-৭ তুলে ৫২০ রানে এগিয়ে থেকে ডিক্লেয়ার দিলেন কোহালি। বাকি থাকা ৯ ওভারে কোনও উইকেট তুলতে পারেননি তাঁর বোলাররা। অশ্বিন পুরো ফিট আছেন কি না, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। তবু হাতে থাকছে দু’দিন এবং মহম্মদ শামি, যশপ্রীত বুমরারা যদি এই টেস্ট হাত থেকে গলিয়ে দেন, তা হলে ২০০১-এর ইডেনে স্টিভ ওয়ের বিশ্বজয়ী দলকে ভারতের হারানোর মতোই অভাবনীয় ফলাফল হবে।

আপাতত ট্রেন্ট ব্রিজ ভাসছে কোহালি বন্দনায়। মাইকেল ভন থেকে নাসের হুসেন। সুনীল গাওস্কর থেকে হরভজন সিংহ। প্রত্যেকে মুগ্ধ ভারতের নতুন রানমেশিনে। গ্যালারিতেও তাঁকে নিয়ে যা সব ছবি দেখা যাচ্ছে, সচিন অবসর নেওয়ার পরে আর দেখা যায়নি। এ দিন যেমন এক ভারতীয় দর্শক পোস্টার তুলে ধরলেন যে, কোহালির ব্যাটিং দেখবেন বলে ভারত থেকে এসেছেন।  

চলতি সিরিজে বোলাররা এমনই চাবুক হাতে শাসন করছেন যে, ব্যাটসম্যানেরা তিরিশ পেরোতে পারছেন না। টিম স্কোর ২০০ মানে উৎসব করার মতো ব্যাপার। সেখানে কোহালি তিন টেস্টের ছয় ইনিংসে ইতিমধ্যেই তুলে ফেলেছেন ৪৪০ রান। গড় ৭৩.৩৩। দু’টো সেঞ্চুরি হয়ে গিয়েছে। এজবাস্টনে দুই ইনিংস মিলিয়ে ২০০। ট্রেন্ট ব্রিজে দুই ইনিংস মিলিয়ে ২০০।

এ সব সংখ্যাতত্ত্বের বাইরেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে উঠতে থাকা কোটি কোটি খুদে ক্রিকেটারের কাছে শিক্ষামূলক ভিডিয়ো হয়ে থাকবে দু’টো দৃশ্য। প্রথম ইনিংসে তিন রানের জন্য সেঞ্চুরি হারানো ব্যাটসম্যান দ্বিতীয় ইনিংসে ফিরে এসে তুলে নিলেন সেঞ্চুরির সঙ্গে আরও তিন রান। সংকল্প কী ভাবে এক রাতের মধ্যে স্বপ্নভঙ্গের হতাশাকে স্বপ্নপূরণের উৎসবে পাল্টে দিতে পারে, তার উদাহরণ হয়ে থাকল ট্রেন্ট ব্রিজ।

মাঠে কোহালির সেঞ্চুরি আর ভিআইপি স্ট্যান্ডে স্ত্রী অনুষ্কার উপস্থিতি। থার্ডম্যান দিয়ে বাউন্ডারি মেরে সেঞ্চুরি হওয়া মাত্র হেলমেট খুলে দু’হাত ডানার মতো মেলে প্রথমে ড্রেসিংরুমের দিকে ব্যাট তুললেন ভারত অধিনায়ক। তার পরেই উল্টো দিকের গ্যালারির দিকে ঘুরে ব্যাট বাড়িয়ে সেই উড়ন্ত চুম্বন। ক্রিকেট মাঠে প্রকাশ্যে স্ত্রীর প্রতি ভালবাসাকে এমন আবেগপূর্ণ ভঙ্গিতে স্বীকৃতি দিতে দেখা যায় না। ফুটবল মাঠে দেখা গিয়েছে। লুইস সুয়ারেস প্রত্যেকটি গোল করে বিয়ের আংটিতে চুম্বন করেন স্ত্রী সোফিয়ার অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য। কোহালি-অনুষ্কার কাহিনির সঙ্গে দারুণ মিলও রয়েছে সুয়ারেস-সোফিয়ার প্রেমকাহিনির।

কোহালির মতোই সুয়ারেস পথভ্রষ্ট হয়ে পড়তে পারতেন। উরুগুয়েতে মাথা দিয়ে ঢুসো মেরে সাসপেন্ড হওয়ার সময়ে সোফিয়ার সঙ্গে দেখা হয় তাঁর। সেই সান্নিধ্যই পুরোপুরি পাল্টে দেয় আধুনিক ফুটবলের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকারকে। কোহালিও জীবনের রাস্তায় অনুষ্কাকে পাওয়ার পরে এলোমেলো রাস্তায় ড্রাইভিং বন্ধ করে মসৃণ হাইওয়েতে ওঠেন। ভারত অধিনায়ক নিজেই এক বার এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ‘‘অনুষ্কা আমার জীবনকে পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছে। আমি কী ছিলাম আর এখন কী হয়েছি, সেটা ফিরে দেখলেই আরও ভাল বুঝতে পারি।’’

ক্রিকেট মাঠে দু’জনের প্রেমে কোথাও যেন ‘প্যায়ার করনেওয়ালে কভি ডরতে নহী’ গান বাজতে থাকে। এই ইংল্যান্ডেই চার বছর আগে অনুষ্কাকে নিয়ে এসেছিলেন কোহালি। চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়েছিলেন সেই সফরে। ভারতীয় জনতা এবং সংবাদমাধ্যমের কাছে প্রবল ভাবে আক্রান্ত হন অনুষ্কা। সোমবার তাঁর স্বামী সেঞ্চুরি করামাত্র অনুষ্কাকে উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিতে দেখা গেল। চোখেমুখে চাপা অভিমান আর আবেগ ঠিকরে বেরোচ্ছে। মাঠ থেকে কোহালি ফ্লাইং কিস দিচ্ছেন। গ্যালারি থেকে স্ত্রী ‘রিটার্ন গিফ্ট’ ফিরিয়ে দিচ্ছেন। ক্রিকেট আর ‘রব নে বনা দি জোড়ি’ যেন মিলেমিশে একাকার।

নিশ্চিত থাকা যায় অনুষ্কাকে তিনিই বলেছেন, এ বারের সফরে থাকতে। ঠিক যেমন অস্ট্রেলিয়ায় চার টেস্টে চার সেঞ্চুরির সফরের আগে তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘ইংল্যান্ডে ওরা আমাদের আক্রমণ করেছিল। অস্ট্রেলিয়ায় চলো আমার সঙ্গে। একটার পর একটা সেঞ্চুরি করব আর তোমার দিকে ফ্লাইং কিস ছুড়ে দেব।’’ কোহালির জেদ কী জিনিস, সেই সফরেই বোঝা গিয়েছিল। এ বারে রুটের ইংল্যান্ডকেও প্রেমের জয়গানের মুখে খেসারত দিতে হচ্ছে।

তাঁর দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে গিয়েছিল। সেটাকে দূর করার সংকল্প নিয়ে এসে কী করলেন? না, গত বার তাঁকে সব চেয়ে বেশি বিব্রত করা জেমস অ্যান্ডারসনকে এ বার উইকেটই দেননি। এখনও পর্যন্ত অ্যান্ডারসনের বিরুদ্ধে ৩২৫ বল খেলে ১৫৫ রান করেছেন তিনি। এক বারও তাঁর বলে আউট না হয়ে।

৬৯ টেস্টে হয়ে গেল ২৩ সেঞ্চুরি। ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের মধ্যে টেস্ট সেঞ্চুরির সংখ্যায় সামনে শুধু তিন জন। সচিন তেন্ডুলকর (৫১), রাহুল দ্রাবিড় (৩৬) এবং সুনীল গাওস্কর (৩৪)। কিন্তু কোহালি সবাইকে ছাপিয়ে যাচ্ছেন সেঞ্চুরি করার দ্রুততার হারে। এবং, অবিশ্বাস্য ‘কনভার্শন রেট’। এই নিয়ে শেষ ১৩বার হাফ সেঞ্চুরি পেরিয়ে ৯বার সেটাকে সেঞ্চুরিতে পরিণত করলেন।

উৎকর্ষ, প্রভাব, ধারাবাহিকতা এবং পরিসংখ্যান— সব দিক থেকে মনে হচ্ছে এক নতুন মাস্টারের আলোর ছটা ছড়িয়ে পড়ছে ক্রিকেট পৃথিবীতে। দিলীপ দোশী বলছিলেন, ‘‘তুলনায় যেতে চাই না। কিন্তু এত বড় ম্যাচউইনার আর ক’জন এসেছে, তা সত্যিই ভেবে দেখার মতো। চাপের মুখে দলকে জয়ের দিকে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অসাধারণ!’’

চার বছর আগের ইংল্যান্ড ব্যাটসম্যান এবং প্রেমিক কোহালিকে নিদ্রাহীন রাত উপহার দিয়েছিল। এ বার দু’জনকেই হাসি ফিরিয়ে দিচ্ছে। ক্রিকেট মিশে যাচ্ছে জীবনের সঙ্গে!
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status