বিনোদন

স্মরণে নায়করাজ

২১ আগস্ট ২০১৮, মঙ্গলবার, ৯:৩৯ পূর্বাহ্ন

সুচন্দা
অনেক কাছ থেকে দেখেছি চলচ্চিত্র নিয়ে কীভাবে কাজ করেছেন তিনি, চলচ্চিত্রের স্বর্ণালি দিন তৈরি করতে কতটা কষ্ট করতে হয়েছে তাকে। আজ তার এই স্মৃতিগুলো মনে করতে অনেক বেশি কষ্ট হচ্ছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি নিজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান করেছিলেন, সেখানে আমিও বেশ কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেছি। তিনি চলে যাওয়ার পর মনে হয়েছে আমরা পরিবারের একজন অভিভাবক হারিয়েছি।
গাজী মাজহারুল আনোয়ার
আমার সঙ্গে রাজ্জাকের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। রাজ্জাককে নিয়ে আমি ১৮টি ছবি করেছি। প্রতিটি ছবির ক্ষেত্রেই মনে হয়েছে, রাজ্জাক যেন চলচ্চিত্রে নতুন এসেছেন। নতুন করে শিখছেন। এছাড়া যেহেতু শুরুটা ছিল খুব কষ্টের। সেটা রাজ্জাক সবসময় মনে রাখতেন। এসব গুণ তাকে শীর্ষে নিয়ে গেছে। তার মতো অভিনেতা পাওয়া ছিল দুষ্কর।
সোহেল রানা
১৯৭৮ সালে প্রয়াত দীলিপ বিশ্বাসের ‘জিঞ্জির’ ছবিতে আমি, রাজ্জাক ও আলমগীর একসঙ্গে কাজ করেছিলাম। ছবিটি সুপারহিট ব্যবসা করে। এরপর কামাল আহমেদের ‘লালু ভুলু’ ছবিটিও ছিল ব্যবসাসফল। এরপর এফ আই মানিকের ‘জজ ব্যারিস্টার পুলিশ কমিশনার’ ছবিতে সবশেষ আমরা কাজ করি। আমাদের কাজের বাইরে অনেক স্মৃতি রয়েছে। রাজ্জাক অসাধারণ মনের মানুষ ছিলেন। তার চলে যাওয়াটা আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।
আলমগীর
তিনি ছিলেন একজন দক্ষ অভিনয়শিল্পী। আমার সঙ্গে অনেক ভালো সম্পর্ক ছিল, যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। তিনি আমাদের সকলের চোখের মনি ছিলেন। উনার সঙ্গে অনেক স্মৃতি যা বলে শেষ করা যাবে না। তার বাসা থেকে ফিরে আসার সময় সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতেন সব সময়। রাজ্জাক সব শ্রেণির, সব পেশার মানুষের প্রিয় অভিনেতা হয়ে ওঠার বড় একটি কারণ হচ্ছে সব ধরনের চরিত্রে স্বাচ্ছন্দ্যে মিশে যাওয়ার সহজাত গুণ ছিল তার।
ফারুক
রাজ্জাক ভাই খুব সম্ভবত ১৯৬৫ সালে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন। আর আমি এসেছি ১৯৬৮ সালের দিকে। তিনি কাজের দিক দিয়ে আমার আড়াই বছরের সিনিয়র ছিলেন। আর বয়সেও সিনিয়র। তবে আমাদের মধ্যে অভিনয়ের বাইরে একটা ভালো সম্পর্ক ছিল। মান-অভিমান তো ছিল, তবে ভ্রাতৃত্ববোধও ছিল দারুণ। উনাকে যখন আহমদ জামান চৌধুরী ‘নায়করাজ’ উপাধি দিলেন তারপর থেকে তার এই সম্মান কেড়ে নেয়ার জন্য কিছু মানুষ পেছনে পড়ে গেল। বলা যায় চলচ্চিত্রের রাজনীতিতে পড়ে গেলেন তিনি। তখনই অনেকেই চেয়েছিল আমি যেন তার পাশে না থাকি তবে সবকিছু উপেক্ষা করে আমি তার পাশে ছিলাম। মানুষের ভালোবাসায় এবং অভিনয় যোগ্যতায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের এক নাম্বার জায়গাটা তিনি অর্জন করেন।
কবরী
প্রথমে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের ‘যোগাযোগ’ ছবিতে কাজ করার কথা ছিল আমার এবং রাজ্জাক সাহেবের। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে ছবিটি শেষ পর্যন্ত তৈরি হয়নি। তবে ‘যোগাযোগ’ ছবি নিয়ে আলাপ করতে করতে আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কও তৈরি হয়ে যায়। এরপর ‘ময়নামতি’ ছবির পর আমাদের নিয়ে চারদিকে হইচই শুরু হয়। এর আগে ও পরে অনেক ছবিতে কাজ করি। ছবিগুলো করতে গিয়ে আমাদের মধ্যে অনেক মিষ্টি মুহূর্ত পেয়েছি। আমাদের এই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চলচ্চিত্রের লোকেরা খুব উপভোগ করতো। তারা নিশ্চিত ছিলেন, রাজ্জাক ও কবরীর মধ্যে অদৃশ্য কোনো সম্পর্ক নেই। তারা শুধুই বন্ধু। আমাদের জুটি তৈরি হয়েছে বাস্তবতার নিরিখে। আমাদের খুনসুটি হতো। এ নিয়ে মান-অভিমানেরও শেষ ছিল না। একটা সময় তো তার পরিবারের সঙ্গেও আমার দারুণ একটা বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তিনি চলে যাওয়ার কারণে ইন্ডাস্ট্রির অনেক বড় ক্ষতি হয়েছে। গুণী একজন অভিনয় শিল্পী ও ভালো মানুষকে হারিয়েছি আমরা।
মৌসুমী
রাজ্জাক ভাই এক কথায় একজন গুণী শিল্পী ছিলেন। তার সঙ্গে কাজ করাটাও ছিল অনেক ভাগ্যের ব্যাপার। সেই সুযোগ আমার হয়েছে। মানুষ হিসেবেও তিনি অনন্য। আমাদের চলার পথে অনেক ভুল হয়েছে, রাজ্জাক ভাইকে কোনো দিন তা ধরে রাখতে দেখিনি। ২০০২ সালের একটা কথা মনে পড়ছে আজ। আমি তখন ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’ ছবিটি পরিচালনা করবো বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তার আগে রাজ্জাক ভাই হৃদরোগে আক্রান্ত হন। তখন অবশ্য কিছুটা সুস্থ তিনি। ডাক্তারের নিষেধের কারণে কোনো কাজ করছিলেন না। একটি চরিত্রের জন্য তাকে খুব দরকার ছিল। তখন আমি তাকে প্রস্তাব দেয়ার পরই তিনি রাজি হয়ে গেলেন। রাজ্জাক ভাইয়ের মতো এত বড় মাপের অভিনেতা আমাদের মাঝে আর আসবে না। তার ছায়া যতদিন ছিল চলচ্চিত্রে কোনো অশুভ ছায়া ছিল না। তার আলোয় এফডিসি আলোকিত ছিল সব সময়। আমি তাকে সব সময়ই মিস করি।
শাকিব খান
রাজ্জাক স্যারের পরিবারের মানুষরা জানেন আমি তার কত কাছের ছিলাম। অনেক স্নেহ করতেন আমাকে। জীবনের দুর্যোগপূর্ণ সময়ে তিনি আমার পাশে ছিলেন। তিনি সব সময় আমাকে পরামর্শ দিয়েছেন, সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। তিনি আমাকে বলেছেন জীবনে কীভাবে এগিয়ে যেতে হবে। সেগুলো আমার সারা জীবনের শিক্ষা হয়ে থাকবে। তার দরজা সবার জন্য খোলা থাকতো। সবাইকে সাহায্য করেছেন, মন থেকে ভালোবেসেছেন। আমাদের ইন্ডাস্ট্রি দাঁড় করিয়েছেন তিনি। আমি আমার অভিভাবককে হারিয়েছি। আমার মাথার ওপর ছায়া হিসেবে ছিলেন তিনি। একজন সাধারণ মানুষ আবদুর রাজ্জাক চলচ্চিত্রে নাম লিখিয়ে নায়করাজ নামে পরিচিত হন। সাফল্যকে মুঠোবন্দি করতে করতে একসময় তিনি হয়ে ওঠেন অনন্য এক মানুষ। অভাবনীয় সাফল্যের গুণে তিনি ভূষিত হন ‘নায়করাজ’ উপাধিতে।
শাবনূর
রাজ্জাক আঙ্কেলকে নিয়ে আজ অনেক কিছু মনে পড়ছে। তিনি যেমন হাসাতেন তেমন ছিলেন অভিনয়ে দক্ষ একজন শিল্পী। আমরা অনেক কিছু শিখেছি তার কাছ থেকে। একটা কথা আজ মনে পড়ছে। একবার দুবাইয়ে একটা অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার সময় সঙ্গী হিসেবে রাজ্জাক আঙ্কেল এবং কবরী ম্যাডামকে আমি পেয়েছিলাম। তখন দুষ্টুমি করে কবরী ম্যাডাম আমাকে বললেন, এই, তুই কিন্তু ওর সঙ্গে কথা বলবি না। কথাটা রাজ্জাক আঙ্কেল কীভাবে যেন শুনে যান। এরপর তা নিয়ে হাসির রোল পড়ে যায়। দীর্ঘ অভিনয় জীবনে রাজ্জাক আঙ্কেলের সঙ্গে অনেক ছবির কাজ করেছি। সেটে তিনি থাকলে খুব ভালো লাগতো। নিশ্চিত থাকতাম সকলে। মনে হতো, আমি আমার বাবার সঙ্গে আছি। আমাকে ‘তুই’ সম্বোধন করে কথা বলতেন। দেখা হলে মা ছাড়া কথা বলতেন না। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। তার পুরো পরিবারের সঙ্গে আমার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। সবই মনে পড়ছে আজ।
পূর্ণিমা
তিনি ছিলেন আমার চলচ্চিত্রের রাজা। চলচ্চিত্রে যদি কাউকে কিংবদন্তি বলা হয় তিনি হচ্ছেন রাজ্জাক সাহেব। যার ন্যাচারাল অ্যাকটিং, রোমান্টিক দৃশ্যে অভিনয়সহ নানা বিষয় ছিল এক কথায় অসাধারণ। তার অভিনয় এবং এক্সপ্রেশন কাছ থেকে দেখে আমরা অবাক হতাম। তার অভিনীত ছবিগুলো যখন টিভিতে এখনো দেখি সব কাজ বাদ দিয়ে তাকিয়ে থাকি। একমাত্র তাকে আমার একজন ‘ন্যাচারাল অ্যাক্টর’ মনে হতো।
নিপুণ
২০০৬ সালে এফ আই মানিক পরিচালিত ‘পিতার আসন’ ছিল আমার প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি। ক্যারিয়ারের শুরুতেই এ ছবিতে রাজ্জাক আঙ্কেলের সঙ্গে আমার কাজ করার সৌভাগ্য হয়। শুরুতেই তাকে আমি পেয়েছিলাম। এটা শিল্পী হিসেবে আমার জন্য ছিল সৌভাগ্যের বিষয়। আমি উনার সম্পর্কে শুধু একটা কথাই বলতে চাই সেটা হচ্ছে তিনি ছিলেন আমাদের জন্য একটি ইনস্টিটিউশন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status