শেষের পাতা

বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য ও আন্দোলনের খসড়া রূপরেখা তৈরি

কাফি কামাল

১৮ আগস্ট ২০১৮, শনিবার, ৯:৪৫ পূর্বাহ্ন

নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচনের দাবিতে প্রস্তুত হয়েছে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের খসড়া রূপরেখা। জাতীয় ঐক্যের রূপরেখায় রয়েছে কারাবন্দি খালেদা জিয়াসহ সব রাজনৈতিক নেতাকর্মীর মামলা প্রত্যাহার ও মুক্তি, নির্বাচনের আগে জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয়া, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, নির্বাচনের সময়ে নির্বাহী ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন, নির্বাচনে ইভিএম পদ্ধতি বাতিল, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নির্বাচনী তফশিল ঘোষণার পর বিরোধী নেতাকর্মীদের নামে নতুন মামলা ও গ্রেপ্তার অভিযান বন্ধসহ চলমান সব রাজনৈতিক ইস্যুর সমন্বয়। ইস্যুভিত্তিক যুগপৎ আন্দোলনের কৌশল ও গতি-প্রকৃতির বিষয়টিও রয়েছে রূপরেখায়। দলের তৃণমূল নেতাদের মতামত পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে শনি ও সোমবার দুই দফায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ খসড়া তৈরি করেছে বিএনপির নীতিনির্ধারক ফোরাম। প্রস্তুতকৃত খসড়াটি লন্ডনে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে পাঠানো হবে।

পাশাপাশি দলের চেয়ারপারসন কারাবন্দি খালেদা জিয়াকেও বিষয়গুলো অবহিত করা হবে। তাদের মতামত ও নির্দেশনার ভিত্তিতে ঈদের পর দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির বৈঠক ডাকা হবে। সেই বৈঠকের পরই প্রকাশ্যে আসবে জাতীয় ঐক্যের প্লাটফর্ম। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আগামী ২২শে সেপ্টেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন আহূত সমাবেশে এ রূপরেখা জাতির সামনে তুলে ধরা হবে। ২২শে সেপ্টেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঐক্য প্রক্রিয়ার ব্যানারে সমাবেশের প্রস্তুতি হিসেবে ড. কামাল হোসেনের বাসায় বুধবার একটি বৈঠক হয়। বৈঠকে সমাবেশ থেকে কী ঘোষণা দেয়া হবে, সমাবেশে কাদের আমন্ত্রণ জানানো হবে- এ নিয়েও আলোচনা হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ২২শে সেপ্টেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঐক্য প্রক্রিয়ার ব্যানারে আহূত সমাবেশেই এক মঞ্চে উঠতে পারেন দেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা। তবে এই ঐক্য প্রক্রিয়ার বাইরে থাকতে পারে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াত ইসলামী।

জাতীয় ঐক্যের রূপরেখার বিষয়ে বিএনপি স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্য জানান, রূপরেখা তৈরির আগে তারা কয়েক দফায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকগুলোতে নেতারা যেসব ইস্যুতে একমত পোষণ করেছেন সেসব বিষয়ই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে রূপরেখায়। এরমধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ সব রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মুুক্তির বিষয়টি অন্যতম প্রধান ইস্যু হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছে। এছাড়া কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গ্রেপ্তারকৃত শিক্ষার্থীদের মামলা প্রত্যাহার ও মুক্তির দাবিটিও যুক্ত করা হয়েছে সেখানে।

রূপরেখা প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিএনপির এক নেতা জানান, জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার জন্য তারা কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক ও মতবিনিময় করেছেন। ওইসব দলের নেতাদের মতামত নিয়েছেন। যুক্তফ্রন্টভুক্ত দলগুলোর পাশাপাশি বাম ও ডান দল এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেছেন বিএনপি নেতারা। কেবল বিএনপি নয়, যুক্তফ্রন্টের নেতারা এ ক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা রেখেছেন। বিএনপির দায়িত্বশীল এক নেতা জানান, বিএনপি চেয়ারপারসন কারাবন্দি খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি নিয়ে প্রথমদিকে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের। কিন্তু জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রবের একটি মতামতের মধ্যদিয়ে সে দ্বিধার সমাপ্তি ঘটেছে। তিনি পরিষ্কার বলেছেন, খালেদা জিয়া শুধু বিএনপির নেত্রী নয়, তিনি দেশের সিংহভাগ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন। গণতন্ত্রের জন্য আজ তিনি কারাগারে রয়েছেন।

তাই সুষ্ঠু নির্বাচনে তিনিসহ দেশের সব রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের জাতীয় নির্বাচনের আগে মুক্তি দেয়ার দাবিকে প্রাধান্য দিতে হবে। জাসদ সভাপতির এ মতামতের প্রেক্ষিতে অন্যান্য দলের নেতারাও এই ইস্যুতে একমত পোষণ করেছেন। বিএনপির অন্য এক নেতা বলেন, বর্তমান সরকারের অধীনে বিগত কয়েকটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রকৃত অবস্থা দেখে সব রাজনৈতিক দল একমত পোষণ করেছেন, এই সরকারের অধীনে কখনো সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থার দাবি এখন আর শুধু বিএনপির একার নয়। এটা সবার। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাওয়া আর রাজনৈতিকভাবে আত্মহত্যা করা এখন একই বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বিষয়টি বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা উপলব্ধি করতে পারছেন। আর সে কারণেই জোরালো হয়েছে বৃহত্তর ঐক্যের বিষয়টি। যুক্তফ্রন্টের দায়িত্বশীল এক নেতা জানান, বৃহত্তর ঐক্যের বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তবে অত্যন্ত ইতিবাচকভাবেই পুরো প্রক্রিয়াটি এগোচ্ছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী মাসের প্রথমপক্ষে অগ্রগতি দৃশ্যমান হবে। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের জন্য আমরা যাদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে এসেছি- তাদের অনেকেই তো এখন কথা বলছেন। ফলে বিষয়টি যে ইতিবাচকভাবে এগোচ্ছে তা পরিষ্কার।

এটি একটি প্রক্রিয়া, সংশ্লিষ্টরা এ নিয়ে কাজ করছেন। স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, দেশের বামপন্থি ও মধ্যপন্থি দলগুলোর নতুন নতুন গ্রুপ হচ্ছে। তারা জাতীয় নির্বাচনসহ সার্বিক ইস্যুতে সোচ্চার হচ্ছে। যেসব রাজনৈতিক দল গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, লুটপাট ও নৈরাজ্যমুক্ত একটি সুষ্ঠু পরিবেশ এবং সরকার চায় তারা এ নিয়ে কাজ করছে। সার্বিকভাবে বিষয়টির প্রগ্রেস হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট নেতারা জানান, ক্ষমতার বাইরে থাকা বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল নিয়ে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গঠন এবং নির্দলীয় নির্বাচনকালীন সরকারের দাবিতে রাজপথে নামার পরিকল্পনারও অগ্রগতি হয়েছে বেশ। বিকল্প হিসেবে রয়েছে প্লাটফর্মের বদলে ইস্যুভিত্তিক যুগপৎ আন্দোলনের কৌশল। বিএনপি স্থায়ী কমিটির শনি ও সোমবার অনুষ্ঠিত বৈঠক সূত্র জানায়, আগামী দিনে যুগপৎ আন্দোলনের জন্য বৈঠকে জাতীয় ঐক্য গড়ার বিষয় নিয়ে নানাবিধ পরামর্শ নেয়া হয়। এর মধ্যে আগামী মাসে জাতীয় ঐক্যের ফর্মুলা প্রকাশ্যে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এছাড়া সংকট নিরসনে সরকার সংলাপের উদ্যোগ নিলে ইতিবাচকভাবে সাড়া দেবে বিএনপি। তবে সে সংলাপ হতে হবে অবশ্যই এজেন্ডা নির্ভর। সময়ক্ষেপণের জন্য এজেন্ডাবিহীন কোনো সংলাপে যাবে না তারা।

এদিকে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের আত্মপ্রকাশের আগে আগামী ১লা সেপ্টেম্বর দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে রাজধানীতে সমাবেশের মাধ্যমে বড় ধরনের শো-ডাউন করতে চায় বিএনপি। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সমাবেশে দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষের উপস্থিতির মাধ্যমে সরকারকে একটি বার্তা দিতে চায় বিএনপি। এর আগে বিভিন্ন দলের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে আলোচনা ও সমঝোতার উদ্যোগ নেয়ার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন নেতারা। এছাড়া আলোচনার উদ্যোগ নেয়ার মাধ্যমে নিরসন করা হবে দলের অভ্যন্তরে বিরাজমান ছোটখাটো বিরোধ, কোন্দলগুলো।

এদিকে বিএনপির তৃণমূল থেকে পাওয়া মতামতের ভিত্তিতে রাজপথে জোরালো আন্দোলনের রোডম্যাপের যে খসড়াটি প্রস্তুত করা হয়েছে সেটা চূড়ান্ত হবে ঈদের পর দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভায়। তবে ঈদের আগে দলের নীতিনির্ধারক ফোরামের কয়েকজন সদস্য বিএনপি চেয়ারপারসন কারাবন্দি খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। সে সাক্ষাতের অনুমতি চেয়ে ইতিমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে। বিএনপি স্থায়ী কমিটির বৈঠক সূত্র জানায়, জাতীয় ঐক্যের প্রক্রিয়া ও আন্দোলনের পাশাপাশি আগামী জাতীয় নির্বাচনের কৌশল প্রণয়ন ও প্রস্তুতির জন্যও কাজ করবে দলের একটি দায়িত্বশীল টিম। তারা জোট ও বৃহত্তর ঐক্যের শরিকদের চাহিদা ও সেখানকার বাস্তবতা নিয়ে কাজ করবেন। এছাড়া দলের সাবেক ও সম্ভাব্য প্রার্থীদের ভোটারদের মধ্যে জনপ্রিয়তা এবং নেতাকর্মীদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও সার্বিক তথ্য-উপাত্ত ও নেতাকর্মীদের মতামত এবং স্থানীয় জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর ভিত্তিতে একটি সারসংক্ষেপও তৈরি করবেন, যা দলের ইশতেহার প্রণয়ন ও প্রার্থী বাছাই এবং জোট এবং জাতীয় ঐক্যের শরিকদের সঙ্গে আসন বণ্টন নিয়ে আলোচনায় সুবিধা হয়।

বৈঠক সূত্র জানায়, খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আগামী আন্দোলনে ঢাকা মহানগর বিএনপির ভূমিকাকে অগ্রগণ্য হিসেবে দেখতে চায় দলের নীতিনির্ধারক ফোরাম। আর সেজন্য গুরুত্বপূর্ণ দুই সাংগঠনিক ইউনিট ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের কমিটিতে বঞ্চিত নেতাদের অন্তর্ভুক্ত ও কিছু থানা কমিটি পুনর্গঠনের যৌক্তিকতা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। এছাড়া দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আগামী ১লা সেপ্টেম্বর রাজধানীর সমাবেশে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে দলের ঢাকা মহানগর দুই ইউনিটের নেতাদের তাগিদ দেয়া হয়।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status