দেশ বিদেশ

এখনো দুরবস্থা সাভারের চামড়া শিল্প নগরীর

এমএম মাসুদ

১৬ আগস্ট ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:০৮ পূর্বাহ্ন

গত বছর এপ্রিল মাসে পরিবেশ অধিদপ্তর গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ও টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার পর ট্যানারিগুলোকে রাজধানীর হাজারীবাগ ছাড়তে বাধ্য করা হলে সাভারে স্থানান্তর শুরু করেন মালিকরা। স্থানান্তরের এক বছর পার হলেও দুরবস্থা কাটেনি সাভারের চামড়া শিল্প নগরীর রাস্তা-ড্রেনেজ কাঠামোর। নেই পরিবেশ সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা। এতে গ্রীষ্মর প্রচণ্ড দাবদাহে নাভিশ্বাস, আর বর্ষার ভোগান্তি পোহাতে হয় শ্রমিক-কর্মচারীদের। পাশাপাশি এখনও বাকি রয়েছে প্রায় ৪১ ট্যানারি স্থাপনের কাজ।
ট্যানারি সংশ্লিষ্টরা জানান, সারা দেশ থেকে কোরবানির পশুর চামড়া আসলে সেগুলো প্রক্রিয়াকরণের সক্ষমতা তাদের রয়েছে। উৎপাদনে কোনো সমস্যা হবে না। তবে কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে বিসিক চামড়া শিল্প নগরীর ভেতরের সংযোগ সড়কগুলোর কাজ শুরু করেছে। এছাড়া বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি। আর নদীদূষণের মাত্রা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশন (বিসিক) সূত্র মতে, সাভারের হেমায়েতপুরের হরিণধরায় ধলেশ্বরী নদীর তীরে ১৯৯.৪০ একর জমিতে ১৫৬ ট্যানারিকে ২০৭টি প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়। এরপর ১৫২ ট্যানারির লে-আউট প্ল্যান অনুমোদন দেয়া হয়। এর মধ্যে ১১১ প্রতিষ্ঠান কারখানা চালু করেছে। নির্মাণ কাজ ঠিকভাবে না করায় ইতিমধ্যে কমলা ট্যানারি ও নবীপুর ট্যানারির প্লট বাতিল করা হয়েছে। অধিকাংশ ট্যানারি ওয়েট ব্লু থেকে ফিনিশড পর্যন্ত কাজ শেষ করছে। পরে ফিনিশড ও ক্রাস্ট চামড়াগুলো রপ্তানি করে আসছে। আবার কিছু ট্যানারি সাভারে ওয়েট ব্লুসহ কয়েকটি ধাপের কাজ করার পর শুকানোর কাজ করছে ঢাকার হাজারীবাগে।
সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রকল্প পরিচালক আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, পিছিয়ে থাকা ও কাজ বন্ধ রাখা ট্যানারিগুলো দীর্ঘদিন ধরে নানা জটিলতার কথা বলে আসছে। কিছু ট্যানারি আর্থিক সংকটের মধ্যেও রয়েছে।
জানা গেছে, দীর্ঘ দিন অতিবাহিত হলেও বিসিক কঠিন বর্জ্যগুলো ফেলার বিষয়টির কোনো সমাধান করতে পারেনি। কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারের মারাত্মক ক্ষতিকর রাসায়নিক মিশ্রিত তরল বর্জ্যগুলো পাইপ দিয়ে সরাসরি ধলেশ্বরী নদীতে পড়া বন্ধ হয়নি। এ ছাড়া ট্যানারির ভেতরের এলাকার ড্রেনগুলো বন্ধ থাকায় ও ম্যানহোলগুলোর মুখ খোলা থাকায় অল্প বৃষ্টি হলে তা গিয়ে পড়ছে ধলেশ্বরী নদীতে। ট্যানারি মালিক পক্ষের ও শ্রমিকদের অভিযোগ বিসিকের গাফিলতির কারণে ড্রেনেজ ব্যবস্থা সঠিকভাবে নির্মাণ না হওয়ায় ট্যানারির এমন বেহাল অবস্থা। ট্যানারিগুলো হাজারীবাগ ঠিকই ছেড়েছে। কিন্তু গুণগত কোনো পরিবর্তন আসেনি। ট্যানারিগুলো হাজারীবাগ থেকে সাভারে আসার পর ১১৫টি উৎপাদন শুরু করার ফলে নদীদূষণ থেকে শুরু করে বর্তমানে সংযোগ সড়কগুলোর বেহাল দশা। যদিও কিছু দিন আগ থেকে সড়কগুলো মেরামত শুরু হয়েছে।
এদিকে চামড়ার উচ্ছিষ্ট, ঝিল্লি, চামড়ার টুকরা, পশুর কান, শিং, ইত্যাদি কঠিন বর্জ্য ফেলার জন্য এখন পর্যন্ত ডাম্পিং ইয়ার্ড নির্মাণ করতে পারেনি বিসিক। বর্জ্য ফেলা শুরু হওয়ায় ডাম্পিং ইয়ার্ড নির্মাণের জন্য ৫ একর জমির বিশাল একটি পুকুর ভাগাড়ে পরিণত হয়। বৃষ্টি হলে সেই বর্জ্য ধলেশ্বরী নদীতে পড়ে। ফলে নদীর পানি পশু-পাখি পর্যন্ত খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে পড়ে।
ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ মাহিন বলেন, অর্থসংকটের কারণে এসব ট্যানারি তাদের কারখানা চালু করতে পারেনি। সবার ট্যানারি একসঙ্গে চালুর জন্য উদ্যোগ নেয়ার প্রস্তাব আগে থেকেই অ্যাসোসিয়েশন থেকে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বিসিক এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়নি। তিনি বলেন, ট্যানারি মালিকদের প্লট বরাদ্দ দিলেও এখনও জমির দলিল বুঝিয়ে দেয়নি। জমি বন্ধক না রাখতে পারার কারণে কিছু ট্যানারির কাজ বন্ধ আছে। যেসব প্রতিষ্ঠান ট্যানারি চালু করেছে তারা অন্য ব্যবসার টাকা অথবা অন্য জমি বন্ধকসহ নানাভাবে অর্থের ব্যবস্থা করে কারখানা স্থাপন করেছে।
এদিকে চামড়া শিল্পনগরীর ভেতরের সংযোগ সড়কগুলোর পাশের ড্রেনগুলো দীর্ঘ দিন থেকে বন্ধ রয়েছে। ফলে সামান্য বৃষ্টি হলে ট্যানারিগুলোর রাসায়নিক তরল পদার্থ, ক্যামিকেলমিশ্রিত রঙিন ও চুনা পানিতে সয়লাব হয়ে যায়। এমন কী বেশির ভাগ ম্যানহোলের মুখ খোলা থাকায় তরল বর্জ্যগুলো সারাক্ষণ বের হয়।
মালিক ও শ্রমিকদের অভিযোগ, বিসিক কর্তৃপক্ষের চরম উদাসীনতা আর গাফিলতির কারণে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। ট্যানারির বর্জ্যগুলো যে ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে তা এখন পর্যন্ত সরানো হয়নি। তবে বিসিক কয়েকবার ঢাকা সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে তা সরানোর জন্য উদ্যোগ নিলেও শেষ পর্যন্ত কাজের কাজ কিছুই হয়নি। জানা গেছে, সাভার চামড়া শিল্পনগরীর কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারের (সিইটিপি) নির্মাণকাজ চায়নার লিং জি এনভায়রনমেন্ট ২০১৪ সালের মার্চ থেকে কাজ শুরু করে। ইতিমধ্যে চারটি মডিউল চালু করা হয়েছে। যদিও মারাত্মক ক্ষতিকর রাসায়নিক ক্রোমিয়াম পুনরুদ্ধার বা রিকভারি ইউনিটটি চালু হয়নি।
সূত্র জানায়, সিইটিপি প্রতিদিন বর্জ্য পরিশোধের ক্ষমতা ২৫ হাজার ঘনমিটার। বর্তমানে ২৮ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। চামড়ার মওসুম না হয়ে যদি ২৮ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য তৈরি হয়, তাহলে কোরবানি ঈদের পর তা অনেক বাড়বে। ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সদস্য ফয়েজ জানান, সড়কের কাজ চলছে খুবই ধীরগতিতে, যা অত্যন্ত নিম্নমানের। তিনি জানান, সাভারে খুবই খারাপ অবস্থায় আছি। এখানে আমাদের বাসস্থানসহ অনেক সুবিধাই নেই। আমাদের হাজারীবাগ থেকে এসে কাজ করতে হয়। ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ জানান, সাভারের চামড়া শিল্পনগরীতে ভালো আবাসন না থাকা, বাচ্চাদের স্কুল-কলেজের অপ্রতুলতা এবং রাস্তাঘাটের সমস্যার কারণে অনেকেই পরিবারসহ এখানে স্থানান্তর হতে পারছেন না।
ট্যানারি চালু হওয়ার পর আশপাশের গ্রামগুলোতে বাসা ভাড়াও হাজারীবাগ থেকে অনেক বেশি। প্রতিটি কারখানার ভেতরে ক্যান্টিনের ব্যবস্থা থাকার কথা থাকলেও একটি কারখানাতেও এ ব্যবস্থা নেই।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহীন আহম্মেদ বলেন, চামড়া শিল্পনগরীর কাজের অগ্রগতি তেমন উন্নতি নেই। তিনি বলেন, ৫০ বছরের কাজ রাতারাতি করা সম্ভব নয়। আমাদের জমি রেজিস্ট্রেশন দেয়নি। আর সিইটিপি কোনোমতে চলছে। বিসিক প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানান, আমরা একবার ড্রেনগুলো পরিষ্কার করে দিয়েছি। বিসিকের টাকা বরাদ্দ নেই যে, ৩ মাস ৪ মাস পর পর তা পরিষ্কার করবে। পরবর্তীকালে ট্যানারি মালিকরা ড্রেনগুলো পরিষ্কার করবে। এ ব্যাপারে আমরা ট্যানারি মালিকদের চিঠির মাধ্যমে তা জানিয়ে দিয়েছি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status