দেশ বিদেশ

‘আজি শরততপনে প্রভাতস্বপনে...’

কাফি কামাল

১৬ আগস্ট ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৯:৪৬ পূর্বাহ্ন

‘আজি শরততপনে প্রভাতস্বপনে/ কী জানি পরান কী যে চায়.../ আজি মধুর বাতাসে হৃদয় উদাসে, রহে না আবাসে মন হায়...!’ শরতের আগমনে এভাবেই উন্মনা হয়েছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলা বর্ষ পঞ্জিকা মতে আজ পহেলা ভাদ্র। ঋতু পরিক্রমায় বিদায় নিয়েছে শ্রাবণ মাস। সজল বরষা। আকাশে রৌদ্র-মেঘের লুকোচুরি খেলা আগমনীবার্তা দিচ্ছে শরতের। আকাশে তুলোট মেঘের ছুটোছুটি, শুভ্র শিউলির মন মাতানো ঘ্রাণ আর দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠে নিরন্তর ঢেউ খেলানো দোল। বাংলার প্রকৃতি আজ থেকে আন্দোলিত হবে শরতের স্নিগ্ধ পরশে। বাংলার প্রকৃতি হয়ে উঠবে দিজেন্দ্র লাল রায়ের কবিতা পঙ্‌ক্তির মতো- ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁঁজে পাবে নাকো তুমি’।   

শরতের প্রভাত সূর্য শিশিরসিক্ত বাতাসে ভর করে নীল আকাশকে রাঙিয়ে লাজুক করে তোলে। গগনে গগনে শুধু অপরূপ রূপের লীলাখেলা। ভুবন জুড়ে এক নতুন দৃশ্যপট রচিত হয়- ‘আজি কি তোমার মধুর মুরতি/হেরিনু শারদ প্রভাতে!/হে মাত বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ/ঝলিছে অমল শোভাতে...।’ গ্রীষ্মের অগ্নিবাণ পেরিয়ে সজল বরষা সাঁতরে ঋতুচক্র মেনে বাংলার প্রকৃতিতে আগমন ঘটেছে শরতের। সদ্যবিগত বর্ষার প্রসন্নতার পর এক আশ্চর্য রূপমাধুরী নিয়ে শরত ফেরে বাংলার দুয়ারে। তার পরশে প্রকৃতি হয়ে ওঠে লাবণ্যময়, ধরণী শ্যামল সুধাময়। কবিগুরুর ভাষায়- ‘তুলি মেঘভার আকাশ তোমার করেছ সুনীল বরণী/শিশির ছিটায়ে করেছ শীতল/ তোমার শ্যামল ধরণী।’ সোনা ঝরানো এই ঋতু অবিরল আনন্দের ফল্গুধারা বইয়ে দেয় হৃদয় ও মনে। শরৎ মানেই বনতল, গৃহআঙিনায় সুবাস ছড়ানো জুঁই-শেফালি-শিউলি-বেলিসহ নানা ফুলের বাহার। আর আকাশে শুভ্র মেঘের ভেলা। জলহারা মেঘমালা পেঁজা তুলোর মতো নীল নভোতলে ভেসে বেড়ায় পথহারা উদাসী পথিকের মতো। আকাশে কখনো ঝকঝকে রোদ, কখনো সাদা মেঘের ঘনঘটা। তুলোট মেঘের দিগ্বিদিক ছুটোছুটি। আবার কখনওবা মেঘের গর্জন। শরতের প্রকৃতির বর্ণনা দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন- ‘আজি ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা-/ নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই- লুকোচুরি খেলা...।’

শরতের বৃষ্টি আনন্দের বার্তা বয়ে আনে মনে। চারপাশের শুভ্রতার মাঝে বৃষ্টির ফোঁটা যেন আনন্দ-বারি! বৃষ্টি শেষে আবারও রোদ। দিগন্তজুড়ে একে সাতরঙা হাসি দিয়ে ফুটে ওঠে রংধনু। প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ শরতের চরিত্রের সঙ্গে বর্ণনা করেছেন প্রিয়তমাকে। প্রেম-দ্রোহের কবি নজরুল ইসলামকেও আলোড়িত করেছিল শরতের প্রকৃতি। বিশেষ করে শরতের শিউলি তাকে মুগ্ধ করেছিল। ‘এসো শারদ পাতের পথিক এসো শিউলি-বিছানো পথে/ এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ-কিরণ-রথে...।’ বর্ষার শেষ দৃশ্য আসে শরতের মাহ ভাদরে। শরৎকালে মাপা বৃষ্টি হয়। দিনের বেলায় কখনো বৃষ্টি কখনো রোদ্দুর। রোদ্দুরের সোনা আর তুলোট মেঘের হাওয়া সাঁতারে প্রকৃতি হয় অপরূপ। কবির ভাষায়- ‘সোনালী ঊষার সাদা মেঘেদের ভেলা/আকাশে জমিয়ে তুলে মাধুকরী খেলা।’

শরৎকালের বৃষ্টির রূপ যেন স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ার মতো। শরতের চরিত্র যেনো- কপোলে ওই অশ্রু তো, আঁখিতে এই দুষ্টুমি। এই তর্কের খই ফুটছে তো, পরক্ষণেই কর্তা-গিন্নী সিনেমা দেখতে বেরিয়ে গেলেন দিব্যি হাসিমুখে।
শরতের সম্ভার ওই শিশিরাশ্রু শেফালি, কাশমেঘ; আর আগমনী উৎসবে তার সমাপ্তি। শরৎ হচ্ছে আকাশ ও মাটির মিলন। ভাদ্র মনকে উদ্বেলিত করে। হয়তো তাই, যখন চিরন্তন প্রেমের প্রতীক শ্রীকৃষ্ণের জন্মমাস এ মাহ ভাদর। এ সময় প্রকৃতির সবুজ ছড়িয়ে পড়ে মাঠে-ঘাটে। এই স্নিগ্ধরূপ তারুণ্যকে উচ্ছ্বসিত আনন্দে ভাসতে উদ্বেল করে তোলে। প্রকৃতি তার ভালোবাসা দিয়ে আপন করে নিতে চায় সকল মন। মহাকবি কালিদাস শরতের বন্দনা করেছেন- ‘প্রিয়তম আমার! ঐ চেয়ে দেখো, নববধূর ন্যায় সুসজ্জিত শরৎকাল সমাগত।’

ভাদ্র মাসে কেবল তাল পাকে না, কুশারও সুমিষ্ট হয়। হরেক রকম তালপিঠার ম ম গন্ধে ভরে উঠে গ্রামীণ জনপদ। যেমন কবির আহ্বান- ‘ঋতুমতি রসবতী বরষার শেষে/তালপিঠা খাবে যদি এসো এই দেশে।’ ভাদ্র মাসের প্রথমপক্ষেই দেশের উত্তরাঞ্চলে শুরু হয় ঐতিহ্যবাহী উৎসব ভাদর কাটানি। লোকবিশ্বাস মেনে কালের পর কাল ধরে শ্রাবণ-ভাদ্রের লগনে নববধূরা নাইওয়ে যায় বাপের বাড়ি। আর দীর্ঘবিরহে পুরুষ প্রাণে বাজে বৈষ্ণব কবি চণ্ডিদাসের বিরহী চরণ- ‘এ ভরা বাদর মাহ ভাদর/শূন্য মন্দির মোর...।’ ভাদ্রমাসে কেবল বিরহই নয়, এ মাসে বিধিনিষেধ রয়েছে বিবাহে। আর শরতেই মর্তে আসেন দেবী দুর্গা। আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ থেকে দশম দিন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় বাংলার হিন্দুধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় শারদীয়া দুর্গাপূজা। আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষকে বলা হয় ‘দেবীপক্ষ’। দেবীপক্ষের সূচনার অমাবস্যাটির নাম মহালয়া; এই দিন হিন্দুরা তর্পণ করে তাঁদের পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধানিবেদন করে। দেবীপক্ষের শেষ দিনটি হলো কোজাগরী পূর্ণিমা। এই দিন পূজিত হন হিন্দু দেবী লক্ষ্মী। ভূয়োদর্শন অনুযায়ী, তেরই ভাদর নাকি শীতের প্রসব। সেদিন তাই পালিত হয় শনিপূজা। ভাদ্রমাসেই পালিত হয় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম পূজা মধুপূর্ণিমা। আশ্বিনী পূর্ণিমায় আসে প্রবারণা উৎসব। গ্রাম বাংলায় এ সময় সত্যপীরের শিরনি ও সত্যনারায়ণের পূজা হয়। শরতকালেই বরেন্দ্র এলাকার আদিবাসীরা পালন করে সোহরাই ও কারাম। শরতে ম্যালেরিয়া ও আমাশয়ের প্রকোপ বাড়ে। কুকুর উতলা হয়, তাই কুকুরের কামড়ে দেখা দেয় জলাতঙ্ক রোগ। হেমন্ত মানেই ফসলের সম্ভার। কিন্তু হেমন্তের অগ্রগামী ঋতু শরতের আশ্বিন এবং কার্তিকের প্রথম পক্ষে এককালে খাদ্যাভাব দেখা দিতে এ বাংলায়।
সেকালের রাজারা নাকি শরৎকালে বেরোতেন মৃগয়ায়। অরণ্যের উপান্তে যে নীল সরোবরে সেখানে ফুটতো নীলপদ্ম, কাশগুচ্ছ নদীর কিনারে। শরৎকালের এই সময়ে প্রশ্ন, কোথায় সেই অরণ্য, উপবন। নিরন্তর প্রকৃতিকে তছনছ করে বাড়ছে শহর। বড় শহরে বসে তাই এখন আর উপভোগ করা যায় না শরৎকাল। শহরের উপান্ত দিয়ে কখন শরৎ আসে কখনই বা চলে যায় তা টেরই পায় না নগরের মানুষ। শরৎ তাই আমাদের কাছে স্মৃতি হয়ে উঠছে দিনদিন। শরৎকালে দলবেঁধে বিল-ঝিলে মাছধরার দৃশ্যও এখন বিলুপ্ত প্রায়। তাহলে কি ষড়ঋতু থেকে খসে যাচ্ছে- শরৎকাল?
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status