প্রথম পাতা

সড়কে বেপরোয়া অনিয়মকারীরা

শুভ্র দেব ও সুদীপ অধিকারী

১২ আগস্ট ২০১৮, রবিবার, ১০:৪৭ পূর্বাহ্ন

সড়কে নৈরাজ্য, অরাজকতার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন আন্দোলন নাড়া দিয়েছে পুরো দেশবাসীকে। অনেকে বলছেন শিশু-কিশোরদের এ আন্দোলন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সড়ক ব্যবস্থাপনায় কোথায় কী গলদ। ব্যাপক আন্দোলন আর সমালোচনার মুখে তড়িঘড়ি করে ট্রাফিক সপ্তাহ শুরু করেছিল পুলিশ। সাতদিন শেষে এ সপ্তাহকে ১০ দিন টানার ঘোষণা এসেছে পুলিশের পক্ষ থেকে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন আর ট্রাফিক সপ্তাহেও খুব একটা হেরফের হয়নি সড়ক ব্যবস্থাপনায়। বরং অনিয়মকারীদের আগের মতোই বেপরোয়া দেখা গেছে সড়কে। সেই লক্কড়ঝক্কর গাড়ি আগের মতো দাপিয়ে চলছে। চালকের আসনে বসছেন সহকারী। যে বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু ঘিরে এতো বড় আন্দোলন রুট পারমিট বাতিলের পরও সেই বাস চলছে সড়কে। রং মেখে নাম বদলে একই সড়কে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মালিক সমিতির ঘোষণার পরও বেশিরভাগ বাস এখনো সড়কে চলছে চুক্তিতে। ট্রাফিক সপ্তাহ চলাকালে বেপরোয়া বাসের ধাক্কায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের গাড়ি।

পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীর গণপরিবহন নিয়ন্ত্রণে সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা না গড়তে পারলে অবস্থার পরিবর্তন হবে না। ট্রাফিক পুলিশ সূত্র বলছে, চলমান ট্রাফিক সপ্তাহের ৭ দিনে ১ লাখ ২৯ হাজার ৮৭১টি যানবাহনের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি জরিমানা আদায় করা হয়েছে ৪ কোটি ৪৯ লাখ ৯ হাজার ২২৩ টাকা। এ সময় ৪৬ হাজার ৭২৩ চালকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা ও ৩ হাজার ৭৭৭ যানবাহন আটক করা হয়েছে। কিন্তু এখনো ঢাকার সড়কে লাইসেন্স ছাড়াই যানবাহন চালাচ্ছেন চালকরা। বিমানবন্দর সড়কে যে বাস শিক্ষার্থীদের চাপা দিয়েছিল ওই বাসের চালকেরও ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না। শুক্রবার চলমান ট্রাফিক সপ্তাহের মধ্যেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের গাড়িকে ধাক্কা দিয়েছে নিউ ভিশন পরিবহনের একটি বাস। শুক্রবার রাত ৯টার দিকে জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটে এক রোগীকে দেখে বের হওয়ার সময় কলেজগেট এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। পুলিশ জানিয়েছে, নিউভিশনের ওই বাসটির চালকের আসনে ছিলেন চালকের সহকারী। তার কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না। চালক ও সহকারী দুজনকেই পুলিশ আটক করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে।

পরিবহন মালিকরা জানিয়েছেন, সড়কে চালকদের রেষারেষির বেশ কয়েকটি কারণ তারা উদঘাটন করেছেন। তার মধ্যে অন্যতম হলো চুক্তি গাড়ি চালানো। চুক্তিতে গাড়ি চালানোর জন্য চালকদের মধ্যে একটা বেপরোয়া ভাব চলে আসে। তখন এক বাস আরেক বাসের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। কে কত বেশি ট্রিপ মারবে আর কত বেশি টাকা আয় করবে। তাই এই রেষারেষি বন্ধ করতে পরিবহন মালিকদের এক বৈঠকে চুক্তিতে বাস চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। সেই সঙ্গে যে সকল বাসের ফিটনেস সনদ নাই সেসব বাসও সড়কে না নামাতে বলা হয়। বৈঠকে আরো সিদ্ধান্ত হয় এই নীতি যারা অমান্য করবে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। সেজন্য পরিবহন মালিক- শ্রমিকদের কয়েকটি টিম তৈরি করা হয়। যারা সড়কে চুক্তিতে বাস চালানো ঠেকানোর জন্য পাহারা দিবে। গত বৃস্পতিবার ওই টিমগুলো নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পাঁচটি কোম্পানির বাসের চুক্তিতে চালানোর সত্যতা খুঁজে পায়। পরিবহন মালিক সমিতিকে অবগত করলে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়। আজমেরী পরিবহন, সুপ্রভাত পরিবহন, স্কাইলাইন পরিবহন, ডিএমকে পরিবহন ও গাবতলী-সদরঘাট (সাত নম্বর রোড) পরিবহনের সাংগঠনিক চুক্তি বাতিল করা হয়। তবে পরিবহন শ্রমিকরা জানিয়েছেন, চুক্তিভিত্তিক বাস চালাতেই তাদের আগ্রহ বেশি। কারণ চুক্তিতে চালালে তাদের ভালো আয় হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সুপ্রভাত বাসের চালক রুবেল বলেন, চুক্তিতে না চালালে আমাদের পোষায় না। কারণ আমাদের যা টাকা দেয়া হয় তা দিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে খেয়ে পরে থাকা কঠিন। তবে সড়কে কিছু অদক্ষ চালকের কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। অনেকেই বেশি ট্রিপ পাবার আশায় গতি ও রেষারেষি করে। তাদের কারণেই মূলত দুর্ঘটনা ঘটে।

গত ২৯শে জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীকে চাপা দেয় জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাস। ঘটনার পর পরই ওই কলেজের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে শতাধিক বাস ভাঙচুর করে। পরের দিন থেকে ঢাকা শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ঘাতক বাস চালকের ফাঁসি ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) ঘাতক পরিবহনটির নিবন্ধন বাতিল করেন। এরপর থেকেই রাজধানীর সড়কে আর নামতে পারেনি জাবালে নূর পরিবহনের বাস। কয়েকদিন মাঠে নামতে না পারলেও এই সুযোগে তারা নতুন সাজে নতুন নামে মাঠে নামার পরিকল্পনা করে। অন্য কোম্পানির নামে বাস চালানোর প্রস্তুতিও চলছে। র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে জাবালে নূর পরিবহনের ৬টি বাস জব্দ করেছে। র‌্যাব জানিয়েছে, মিরপুর ও ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে বাসগুলো আটক করা হয়েছে। বিআরটিএ রুট পারমিট বাতিল করার পরও তারা যদি বাস চালায় তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। এর আগে শিক্ষার্থীদের চাপা দেয়ার পর জাবালে নূরের দুটি বাসের চালক, চালকের সহকারীকে গ্রেপ্তার করে ওই দুটি বাসের নিবন্ধন সাময়িকভাবে বাতিল করে বিআরটিএ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর আগারগাঁও বিজ্ঞান জাদুঘরের অপর পাশের জায়গা অবৈধ দখল নিয়েছিল জাবালে নূর। বানানো হয়েছিল বাস ডিপো। এখানেই থাকতো পরিবহনটির প্রায় ৭০টি বাস। কিন্তু আন্দোলনের পর থেকেই স্থানটিতে দেখা যাচ্ছে না সেই লক্কড়ঝক্কর গাড়ি। ডিপোর কর্মচারীরা জানান, বাসগুলোর রং ও নাম পাল্টানো হবে। আর এই জন্যই বেশিরভাগ বাস বিভিন্ন মালিকের অধীনে দেয়া হয়েছে। তারাই এর রং বদলানোর কাজ করছেন। তবে এর বেশিরভাগ বাসেরই কাজ চলছে মিরপুরের বিভিন্ন অলিগলিতে। সরজমিন গতকাল মিরপুর চিড়িয়াখানা রোডে গেলে দেখা যায়, সেখানে সারিবদ্ধভাবে বিভিন্ন গাড়ি দাঁড় করানো রয়েছে। এর মধ্যে জাবালে নূর পরিবহনেরও কয়েকটি গাড়ি দেখা যায়। যাদের সব কয়টিতেই চলছে ঘষা-মাজার কাজ। বাসের শ্রমিক আজিজ ও সোহরাব জানায়, পরিবহনের একটা বাসের দুর্ঘটনায় সবগুলো বাস বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। জাবালে নূরের নিবন্ধন বাতিল করায় এই নামে তো আর অন্য বাস রাস্তায় নামানো যাচ্ছে না। তাই মালিক পক্ষ ব্যানার বদলে অর্থাৎ নতুন নামে, নতুন রঙে আবার রাস্তায় বাস নামাবেন। এদিকে একই স্থানে আল-মক্কা, বিকল্পসহ বিভিন্ন নামে আরো বেশ কয়টি বাসের লক্কড়ঝক্কর বাসের রং বদলে দৃশ্যমান ফিটনেস পরিবর্তনের কাজ করতে দেখা যায়। বিআরটিএ সূত্র মতে, রাজধানীতে ৩৫৯টি রুটে বাস-মিনি বাস চলে সাড়ে ৭০০০ এর মতো। এর মধ্যে ফিটনেস সনদ হাল নাগাদ আছে সাড়ে ৪ হাজারের মতো গাড়ির।
এবিষয়ে জাবালে নূর পরিবহনের মালিক (একাংশ) আবদুল গাফ্‌ফার বলেন, বিআরটিএ থেকে পারমিট নেয়ার পর সড়কে ট্রাফিক সার্জেন্টরাই কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করেন। আর এসবের তত্ত্বাবধানে থাকেন ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই)। টিআইদের সঙ্গে মাসিক বা সাপ্তাহিক চুক্তির মাধ্যমেই সবাই গাড়ি নামায় রাস্তায়। এ বিষয়ে বিআরটিএ পরিচালক শেখ মাহবুব-ই রাব্বানী বলেন, প্রত্যেকটা গাড়িকেই আলাদা আলাদা অনুমোদন নিতে হবে। তাদের অবকাঠামো আছে কিনা, তাদের সামর্থ্য আছে কিনা যাবতীয় বিষয়ে আমরা যাচাই-বাছাই করছি। তিনি আরো বলেন, রাজধানীতে ৩৫৯টি রুটে ৫ হাজার ২৪৭টি বাস ও ২ হাজার ৩৫২টি মিনি বাসের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। নিয়ম মানলে আর ঠিকঠাক নজরদারিতে রাখলে এর বেশিরভাগই রাস্তায় চলার কথা নয়।

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, সড়কে নৈরাজ্য ঠেকাতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ফিটনেসবিহীন ও অদক্ষ চালকদের কারণে সড়কে দুর্ঘটনা বাড়ছে। পাশাপাশি চুক্তি ভিত্তিক গাড়ি চালানোর জন্য চালকদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি ঢাকায় আর কোনো চুক্তি ভিত্তিক বাস চলতে দেয়া হবে না। চুক্তি ভিত্তিক বাস চলার কারণে বৃহস্পতিবার আমরা সমিতির পক্ষ থেকে ৫টি বাসের সাংগঠনিক চুক্তি বাতিল করেছি। আমরা এ বিষয়টি নজরদারির জন্য বিভিন্ন পয়েন্টে টিম রেখেছি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status