প্রথম পাতা

রোগটির নাম সেলফাইটিস

মরিয়ম চম্পা

১২ আগস্ট ২০১৮, রবিবার, ১০:৪১ পূর্বাহ্ন

মানুষ নিজেকে ভালোবেসে একে অন্যকে দেখাতে চান। এডিথ হ্যামিল্টনের ‘মিথলজি’ বইয়ে ‘নার্সিসাস’ নামে এক দেবতার গল্প আছে। তাকে অনেক দেবীই পছন্দ করতো। কিন্তু সে কাউকেই পাত্তা দিতো না। এই নিয়ে দেবীদের মধ্যে ক্ষোভ ছিল। একদিন এক দেবী নার্সিসাসের শাস্তি  চেয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেন। উত্তরে ঈশ্বর বললেন, হয়তো নার্সিসাস অন্যকে নয় শুধুমাত্র নিজেকেই ভালোবাসে। একদিন নার্সিসাস পরিষ্কার পানির উপর
তাকায় এবং তার নিজের চেহারা দেখতে পায়। সঙ্গে সঙ্গে সে নিজের প্রেমে পড়ে যায়। সেই পানির ওপর দিনের পর দিন অপলক তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে রোগা হতে থাকে এবং একদিন তার মৃত্যু হয়। কিন্তু এখন পানিতে বা আয়নাতে নয় স্মার্টফোনে নিজের ছবি তুলে তা নিজে দেখার জন্য। এবং অন্যকে দেখানোর জন্য মুখের বিভিন্ন ভঙ্গিমায়, নানা ঢঙে বিপজ্জনক স্থানে সেলফি তুলতে গিয়ে দুর্ঘটনার মুখে পড়ছেন। এতে করে প্রায়ই মৃত্যুর খবরও পাওয়া যায়।

সেলফি অন্যের বিরক্তির কারণও হয় যখন অনেকে ঘন ঘন সেলফি পোস্ট করে অন্য বন্ধুদেরকে ট্যাগ করে। আবার এই ছবিগুলো পোস্ট হওয়ার পর লাইক বা কমেন্টের সংখ্যা কম হলে বিষণ্নতায় ভোগেন। নিজের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন। এতে করে আরো অ্যাগ্রেসিভ হয়ে বেশি করে ছবি পোস্ট করতে থাকেন। এক সময় মানুষ বিরক্ত হয়ে ইগনোর করতে থাকেন। আর তখন চরম হতাশায় ডুবে গিয়ে মানসিকভাবে আরো ভেঙে পড়েন। আর এ জন্যই সেলফিকে মানসিক ব্যাধির সঙ্গে তুলনা করা হয়। এর প্রমাণ পাওয়া যায় সামপ্রতিক এক গবেষণায়। আমেরিকান সাইক্রিয়াটিক অ্যাসোসিয়েশন (এপিএ) মানসিক ব্যাধির সঙ্গে সেলফি তোলার সম্পর্কের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। গবেষকরা দাবি করেছেন, অতিরিক্ত মাত্রায় নিজের ছবি তোলার প্রবণতা এবং সেই ছবি সোশ্যাল মিডিয়াতে দেয়ার এই মানসিক সমস্যার নাম ‘সেলফিটিস’। গবেষকরা এই মানসিক সমস্যার আপাতত কোনো সমাধান নেই বলে জানিয়েছেন।

সেলফি তোলা মানসিক রোগ!
সেলফি তোলা এক ধরনের মানসিক রোগ। এবং তা নিরাময়ের জন্য সঠিক চিকিৎসা দরকার। ব্যাঙ্গাত্মকভাবে প্রচলিত অতিরিক্ত সেলফিতে মেয়েদের মাথায় উকুন হয়। সমপ্রতি ভারতে এক সমীক্ষা চালিয়ে এ কথাই জানিয়েছে দেশটির একদল গবেষক। রাস্তাঘাটে হোক কিংবা একা একা, যে কোনো মুহূর্তে সেলফি মাস্ট। বন্ধুদের আড্ডা হোক বা বিয়েবাড়ি। সেলফি না তুললে যেন তা অসম্পূর্ণ। বর্তমান সময়ে এটিকে অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবেই ধরা হয়। কিন্তু আসলে তা নয়। এক ধরনের অবসেসিভ ডিসঅর্ডারের জেরেই এই সেলফি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এবং তা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, বিপজ্জনক সেলফি তোলা থেকেও বিরত হচ্ছে না মানুষ। তাতে প্রাণও যাচ্ছে, তবু হুঁশ ফেরে না। এবার এই সেলফি তোলার প্রবণতাকে অসুস্থতা হিসেবেই চিহ্নিত করলেন বিজ্ঞানীরা।

নটিংহাম ট্রেন্ট ইউনিভার্সিটি এবং তামিলনাড়ুর থিয়াগারাজার স্কুল অব ম্যানেজমেন্টের গবেষকরা যৌথভাবে এ বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন। স্থান হিসেবে বেছে নেয়া হয় ভারতকেই। কারণ এ দেশেই ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তাছাড়া সেলফি তুলতে গিয়ে মৃত্যুর নিরিখেও ভারত এগিয়ে। ফলে এখানকার নির্বাচিত জনগণের ওপর সমীক্ষা চালিয়েই মানসিক অসুখের হদিস পেতে চেয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। এবং তারা তা পেয়েছেন। রোগটির নাম, তাদের মতে সেলফাইটিস। এবং তার বেশ কয়েকটি ধাপও আছে।

সেলফিটিস ব্যাধির তিনটি স্তর হতে পারে। বর্ডার লাইন সেলফিটিস হচ্ছে প্রথম ধাপ। এতে যারা আসক্ত তারা দিনে তিনবার নিজের ছবি তোলে, কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা পোস্ট করে না। অ্যাকিউট সেলফিটিস দ্বিতীয় ধাপ। এটা তুলনামূলক ভয়াবহ। এতে যারা আসক্ত তারা দিনে কমপক্ষে তিনটি নিজের সেলফি তোলে। আর তোলাতেই শেষ নয়, তিনটি ছবিই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করে। আর ক্রনিক সেলফিটিস হচ্ছে চূড়ান্ত বা ভয়াবহ ধাপ। এই পর্যায়ের লোকদের কোনোভাবেই সেলফি তোলা থেকে বিরত রাখা যায় না। দিনে সর্বনিম্ন এরা ছয়বার সেলফি তুলে এবং সব ছবিই তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করে। কেন এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ?

জানা যাচ্ছে, আত্মবিশ্বাস বাড়ানো। সামাজিকভাবে নিজেকে সংযুক্ত রাখা বা নিজের পরিপার্শ্বের রেকর্ড রাখার তাগিদেই তারা এ কাজ করে চলেছে। অনেকে আবার মুড ভালো রাখার উপায় হিসেবে এটিকেও দেখে। আসলে সামাজিক বিচ্ছিন্নতাই ক্রমাগত ঠেলে দিচ্ছে সেলফির দিকে। বহু মানুষের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে শেষমেশ এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হয়েছেন গবেষকরা। তবে এ নিয়ে আরো গবেষণার প্রয়োজন আছে বলেই মনে করেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীরা। ঠিক কী কারণে এরকম একটি ব্যবহারিক বিকৃতি বা অবসেসিভ ডিসঅর্ডারের স্বীকার হচ্ছে মানুষ, তার মূল খোঁজা প্রয়োজন বলেই মত বিজ্ঞানীদের।

এদিকে বর্তমান সময়ের ‘সেলফি কিং’ নামে খ্যাত বেনি উইনফিল্ড ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথম সেলফি আপলোড করেন। তারপর থেকে প্রতিদিনই তিনি হাসিমুখ নিয়ে একই রকম সেলফি আপলোড করে আসছেন। নিজেকে আধুনিক যুগের মোনালিসা মনে করেন ৩৮ বছর বয়সী বেনি। সেলফির মাধ্যমে প্রাপ্ত জনপ্রিয়তাকে ব্যবসায়িক কাজে লাগিয়েছেন তিনি। নিজের মুখের ছবির লোগো সম্বলিত ৩ হাজার টি-শার্ট তৈরি করে বিক্রি করেছেন বেনি। তিনি বলেন, নিজের অবয়ব বিক্রি করে আমি ব্যবসা করতে চাই। আর তাই নিরাপত্তারক্ষীর চাকরি ছেড়ে দিয়ে এখন ব্যবসা বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিয়েছেন তিনি।

অন্যান্য দেশের মতো সেলফিতে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশিরাও। টাইম ম্যাগাজিনের একটি পরিসংখ্যান মতে, সেলফি তোলায় ঢাকা বিশ্বের ৪৫৯টি শহরের মধ্যে ৪৩৪তম স্থান দখল করেছে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. নাসরীন ওয়াদুদ বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না নিজের মধ্যে অ্যাওয়ারনেস তৈরি হবে ততক্ষণ পর্যন্ত সেলফি নামক রোগ থেকে মুক্তি নেই। যখনই ভাবা হয় ফেসবুকে আমার একের পর এক ছবি দিতে হবে। এবং ওই ছবিতে যতবেশি লাইক কমেন্ট পাবো তত বেশি হিরো বনে যাবো। এই মানসিকতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যক্তি তথা আমার (নিজের) মধ্যে সচেতনতা তৈরির বিকল্প নেই।
অপরাধ বিজ্ঞানী তৌহিদুল হক বলেন, আমরা অভিভাবকরা সন্তানদের হাতে আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন একটি মোবাইল ফোন কিনে দিয়ে জাতে উঠতে চাই। এতে তাদের কি ধরনের অকল্যাণ বয়ে আনছে সেটা কী আমরা একবারও ভেবে দেখেছি। এক্ষেত্রে মোবাইল ফোন কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, কোন কোন বিষয়গুলো করা যাবে এবং যাবে না- এ বিষয়ে আমরা একদমই সচেতন নই। এবং সামাজিকভাবে কিছু আদব-কায়দা বা নিয়ম-কানুন রয়েছে। একই সঙ্গে অন্যের নিরাপত্তার বিষয়টি চিন্তা করতে হবে। যেখানে বড় ধরনের একটা গ্যাপ রয়েছে। অনেকেই মনে করেন নতুন প্রজন্ম তাদের নিজেদের মতো করে প্রযুক্তি ব্যবহার করবে। সেক্ষেত্রে তাদের সবার আগে যে বিষয়টি জানা দরকার তাহলো যথাযথ ব্যবহার। না হলে কিছু বিড়ম্বনা তৈরি হবে। আর আমাদের দেশের সেলফি বিড়ম্বনার ঘটনা একেবারেই অপরিপক্ব। অন্যান্য দেশে যেগুলো হওয়ার কোনো সুযোগ নেই সেটি আমাদের দেশে হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ বা মেজর ফ্যাক্টর হচ্ছে প্রযুক্তি ব্যবহারের অ্যাওয়ারনেসের ক্ষেত্রে আমাদের বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে।

সমাজবিজ্ঞানী নেহাল করিম বলেন, ৮০-এর দশকে ক্যামেরাটা এতটা সহজলভ্য ছিল না। তার পরেও কিন্তু ক্যামেরা ধার করে কমবেশি ছবি তোলা হতো। এর দুই দশক পরে ক্যামেরাটা মানুষের হাতে হাতে চলে আসে। কাজেই নিজেকে প্রকাশ করার এই যে কৌতূহল সেটাতো থাকবেই। এটাকে আমরা মানসিক রোগ না বলে কৌতূহল বলতে পারি। আমরা অবশ্যই ছবি বা সেলফি তুলবো। তবে সেটা ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে না হয়ে রেলিংযুক্ত বারান্দা বা ঝুঁকিমুক্ত পরিবেশ হতে পারে। যেখানে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে না। সেলফি আছে, সেলফি থাকবে। এবং এটা আরো ব্যাপকভাবে হবে। তবে সচেতনতা বৃদ্ধি করা উচিত যেন এটা আসক্তিতে পরিণত না হয়।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status