মত-মতান্তর

এতে করে মত প্রকাশের স্বাধীনতা উধাও হয়ে যায় কি না?

শান্তনা রহমান

৯ আগস্ট ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৩:১৩ পূর্বাহ্ন

বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতারা মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ৪৬ বছর আগে যখন তারা এই সংবিধান রচনা করেছিলেন তখন তাদের মনে হয়েছিল পরাধীনতা থেকে আমরা স্বাধীন হচ্ছি। মন মানসিকতার পরিবর্তন রাতারাতি হবে না। ভবিষ্যৎ চিন্তা করে তারা সংবিধানে মত প্রকাশকে মান্যতা দিয়েছিলেন। সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো এই, স্বাধীনতা বার বার হোঁচট খেয়েছে। সংবিধান রচনার অল্প দিন পরই এই স্বাধীনতা খর্ব হতে থাকে। সেনাশাসনে মত প্রকাশের স্বাধীনতা আশা করা যায় না। মেলাকাল ফৌজি শাসনের কবলে ছিল বাংলাদেশ। এই সময়ে দাবি উঠেছে মত প্রকাশের। সেনাশাসকেরা স্বাধীন গণমাধ্যমে বিশ্বাস করতেন না। তাদের বড্ড ভয় ছিল এই স্বাধীনতা। তাই বারবার সাংবাদিকরা নিগৃহীত হয়েছেন।  জেলে গেছেন। স্বাধীনতার দাবি জোরালো হলেও কোনো সরকারই তা মেনে নেয়নি। বরং কথায় কথায় সংবাদপত্র বন্ধ হওয়ার ঘটনা ঘটতে থাকে। এরশাদ জমানার শেষ দিকে একটি যুগান্তকারী রায় আসে আদালত থেকে। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদ মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে রায় দিয়েছিলেন। সাপ্তাহিক খবরের কাগজ নিষিদ্ধ হওয়ার পর বিষয়টি আদালতে নেয়া হলে শাহাবুদ্দীন বিশেষ ক্ষমতা আইনের কতিপয় ধারা বাতিল করে দেন। ‘দুর্নীতিপরায়ণদের উল্লাসের নৃত্য’ কলাম লেখার কারণে পত্রিকাটি নিষিদ্ধ করেছিলেন এরশাদ। মতিউর রহমান চৌধুরীর লেখা এই কলামে রূপক অর্থে সমালোচনা করা হয়েছিল এরশাদের। এরপর থেকে পত্রিকা বন্ধ করার প্রবণতা কমে যায়। দুয়েকটি টেলিভিশন ও পত্রিকা যে বন্ধ হয়নি তা নয়। নব্বই এর পর সাংবাদিকরা পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে থাকেন। বের হয়ে আসেন কলঙ্কিত অধ্যায় থেকে।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা এই দুটো বিষয় বাইরের দুনিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। গণতান্ত্রিক শাসনামলে কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তা বহাল ছিল। জরুরি জমানায় আবার ধাক্কা খায়। ফের গণতান্ত্রিক শাসন। শুরুতে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ। আস্তে আস্তে  নিয়ন্ত্রণ আরোপ হতে থাকে। একপর্যায়ে  সেলফ সেন্সরশিপ কাবু করে ফেলে এই স্বাধীনতা। সময় যত যাচ্ছে ততই ‘সমালোচনা’ নির্বাসিত হতে চলেছে। সাংবাদিকরা নির্যাতিত হচ্ছেন রাজপথে যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি। এর ফলে গুজবের উপর মানুষের নির্ভরশীলতা বাড়ছে। সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনকালে সংবাদ মাধ্যমই রিপোর্ট করেছে কেউ মারা যায়নি। ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনাও ঘটেনি। দায়িত্বশীল সংবাদ মাধ্যম এ ব্যাপারে রিপোর্ট না করলে পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নিতে পারতো। অথচ সংবাদ কর্মীদেরকে যেভাবে রাজপথে হেলমেট বাহিনী পেটালো তা নজিরবিহীন। ইদানিং ফেক নিউজও গিলে খাচ্ছে সাংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতাকে। নয়া এই নিউজের জন্মদাতা সরকারি-বেসরকারি উভয় শিবিরেই। এতে করে মানুষের পক্ষে বাছাই করা কঠিন কোনটা আসল, কোনটা নকল। সম্পাদকদের সঙ্গে তথ্যমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বৈঠকে এ নিয়ে কথা হয়েছে। মন্ত্রী বলেছেন, শেখ হাসিনার সরকার মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। আমরাও তাই বিশ্বাস করতে চাই। এই মুহূর্তে স্যোশাল মিডিয়ার ওপর এক ধরনের ক্র্যাকডাউন শুরু হয়ে গেছে। পুলিশি অ্যাকশনে অনেক অ্যাকাউন্ট বন্ধ। অনেক সাইটও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। গ্রেপ্তার অভিযানে অনেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কথায় কথায় রিমান্ড এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি করেছে। এই আতঙ্ক থাকলে মত প্রকাশ নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। এটা গণতান্ত্রিক শাসনের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফটোগ্রাফার ড. শহীদুল আলমের গ্রেপ্তার মুক্ত দুনিয়ায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। গার্ডিয়ানের সম্পাদকীয় দেখে এটা সহজেই অনুমেয়। পৃথিবীর এমন কোনো মানবাধিকার সংগঠন নেই যারা তার মুক্তি দাবি করেনি। ভারতের সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবীরা সোচ্চার হয়েছেন। এই লেখা যখন লিখছি, তখন শুনলাম দিনাজপুরে একজন ‘খুনি’কে জনতা পুড়িয়ে হত্যা করেছে। এটা মোটেই ভালো খবর নয়। যাই হোক ভুয়া  খবর, ভুয়া পোস্ট কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়। যারা এসব করেন তাদেরকে আইনের আওতায় আনাটাকে কেউই হয়তো বিরোধিতা করবেন না। কিন্তু দেখতে হবে এই অভিযানে মত প্রকাশের স্বাধীনতাই উধাও হয়ে যায় কি না? ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় দুনিয়াতে যে সব শাসকেরা সমালোচনাকে প্রতিহিংসা ভেবে দমনের চেষ্টা করেছেন তা বুমেরাং হয়েছে। উল্টো ইতিহাস হয়ে গেছেন তারাই।
শেষ কথা: মত প্রকাশের স্বাধীনতা আর ফেক নিউজকে কোনো পক্ষেরই এক করে দেখা ঠিক হবে না। কারণ মত প্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে ফেক নিউজের কোনো সম্পর্ক নেই।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status