শেষের পাতা

রাতের ঢাকায় গতির নেশা

শুভ্র দেব

২২ জুলাই ২০১৮, রবিবার, ৯:৩৮ পূর্বাহ্ন

গতির নেশা। আজব নেশা। ভয়ঙ্কর নেশা। মৃত্যুর সঙ্গে খেলা করার নেশা। আজব এ নেশায় মজেছে তরুণরা। এদের বেশির ভাগই ধনীর দুলাল। গভীর রাতের ফাঁকা সড়কে মেতে উঠে গতির নেশায়। হিন্দি-ইংরেজি গানের বিটের তালে 
তালে। সঙ্গে থাকে কোমল পানীয় ও সিগারেট। বেপরোয়া গতিতে তারা কাঁপিয়ে তুলে রাজপথ। এক-দুইজন নয়। একসঙ্গে একাধিক তরুণ নামে সড়কে। ঘুরে বেড়ায় শহরের এ প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। অনেক সময় বাড়তি বিনোদনে চলে যায় শহরের বাইরে। বেপরোয়া এই গতির নেশা অনেকের জন্য প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ভয়ঙ্কর এই নেশায় মেতে অনেকে হারিয়েছে প্রাণ। আর পঙ্গুত্ববরণ করে ঘরবন্দি হয়ে আছে অনেকেই।

রোববার রাত আড়াইটা। রাজধানীর ৩০০ ফিট সড়কে যানবাহনের চাপ অনেকটা কম। যে কয়টা যানবাহন চলাচল করছে স্বভাবতই সেগুলো একটু বেশি গতিতেই চলছে। ঠিক তখনই বিমানবন্দর সড়ক থেকে আসা ৪/৫টি স্পোর্টস কার বেপরোয়া গতিতে আসে। সেকেন্ডের ভেতরে তারা ৩০০ফিট সড়ক দিয়ে চলে যায়। মোটা সাইলেন্সারের বিকট শব্দ আর উচ্চ গানের শব্দে মুহূর্তের মধ্যে ওই এলাকার শান্ত পরিবেশ অশান্ত হয়ে ওঠে। প্রায় আধাঘণ্টা পর তারা ফিরে এসে হোটেল লা মেরিডিয়ান এলাকায় থামে। সেখানেই কথা হয় ওই রেসিং কারের এক সদস্যর সঙ্গে। উত্তরার বাসিন্দা রায়হাত ইবনে সাঈদ রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। সাঈদ জানান, তিনি এইচএসসি পরীক্ষার পরপরই কার চালানো শিখেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হওয়ার পরপরই বন্ধুদের সঙ্গে কার রেসিং এ যোগ দেন। নিজের স্পোর্টস কার না থাকায় প্রথমে বন্ধুদের কার দিয়ে শুরু হয় তার রেসিং লাইফ। কিছুদিন পর তার ব্যবসায়ী বাবাকে বলে তিনি নতুন একটি কার কিনে নেন। সেই কারকে পরে স্পোর্টস কারে রূপান্তর করেন। সাঈদ বলেন, মূলত বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে কার রেসিংয়ের উৎসাহ পাই। এখন সপ্তাহে অন্তত ২/৩ দিন গভীর রাতে রেসিং এ বের হই। এটা আমার কাছে অনেকটা নেশার মতো হয়ে গেছে। আমরা প্রায় ৮/১০ জন বন্ধু একসঙ্গে বের হয়ে রেসিং করি। অনেক সময় হাইওয়ে সড়ক দিয়ে অনেক দূর চলে যাই। দ্রুত গতিতে গাড়ি চালানো অনেকটা বিপদের কারণ হতে পারে তাই আমরা চেষ্টা করি নিজেদের সেইফ রাখার।

শুধু ৩০০ফিট সড়কে নয়, রাজধানীর ভেতরে মানিক মিয়া এভিনিউ, বিজয় সরণি সড়ক, বিমানবন্দর সড়ক, ধানমন্ডি-মিরপুর সড়ক, গাবতলী- সাভার সড়ক, মহাখালী-বনানী- বিশ্বরোড সড়ক, বছিলা সড়ক, গুলশান এলাকার সড়ক, হাতিরঝিল সড়কে প্রায়ই গভীর রাতে ভয়ঙ্কর গতির নেশায় মেতে উঠে তরুণরা। রাত যত গভীর হয় বেপরোয়া গতির গাড়ির আনোগোনা ততই বেড়ে যায়। সোমবার রাত ১২টার দিকে হাতিরঝিল এলাকায় বাইক রেসিং করছিলেন বেশকিছু তরুণ। বিদ্যুত গতির রেসিংয়ের সঙ্গে তারা আবার স্ট্যান্টবাজিও করছিলেন। ওই দলের স্টান্ট বয় রাবিত মানবজমিনকে জানান, স্টান্টবাজি একটা খেলার মতো। বাইক দিয়ে এখানে বিভিন্ন ধরনের কসরত দেখানো হয়। যারা স্টান্ট করে তারা অনেক সাহসী হয়। তবে আমরা কোন গ্রুপের সদস্য না।

সারা দেশে বাইক স্টান্ট ও রেসের সঙ্গে জড়িতদের কিছু গ্রুপ আছে। এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশ রেসিং ক্লাব, ক্লাব ৬৯, ক্লাব বাংলাদেশ, কেবি রাইডার্স, এমএসবি রাইডার্স, বিডি ঘোস্ট রাইডার্স, ফেরোশাস ফ্লাশ, হান্ট রাইডার্স, অল অ্যাবাউট রোড রাইডার্স, এক্সাইল রাইডার্স, বিডি রাইডার্স ক্লাব, ব্লাইন্ডেড হুইলম্যানস অব রংপুর, নারায়ণগঞ্জ রাইডার্স, নোয়াখালী রাইডার্স, রাজশাহী রাইডার্স, বগুড়া স্ট্রিট রাইডার্স, সৈয়দপুর ক্রেজি রাইডার্স ও পটুয়াখালী রাইডার্স। এছাড়াও নামে বেনামে ইদানীং আরো অনেক গ্রুপ করা হয়েছে।

এমএসবি রাইডার্সের সদস্য আবরার মানবজমিনকে বলেন, মূলত ইউটিউবে বিভিন্ন দেশের স্টান্ট বয়দের স্টান্ট করা ভিডিও দেখে আমাদের দেশের তরুণেরা উৎসাহ পায়। তারা মনে করে বিদেশিরা পারলে আমরা কেন পারবো না। তাই ইউটিউবে ভিডিও দেখে দেখে এখন আমাদের দেশেও স্টান্ট করা হয়। বলতে গেলে ঢাকার অলি-গলিতে এখন স্টান্ট করা হয়। কিন্তু বিদেশিরা স্টান্ট করতে গিয়ে যে রকম নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখে আমাদের দেশে সে রকমটা করা হয় না। বিদেশিরা তাদের বুক, মাথা, হাত, পাসহ শরীরের অন্যান্য অঙ্গ সেফ করার জন্য ব্যবস্থা রাখে। আবরার বলেন, এখন প্রতিটি এলাকায় স্টান্ট ও রেসিং আলাদা আলাদা গ্রুপ করা হয়েছে। একেক গ্রুপ একেক এলাকায় রেসিং করে। তাদের আলাদা আলাদা ফেসবুক পেজ আছে। সেখানে তাদের নিজেদের করা অনেক ছবি ও ভিডিও আপলোড করা হয়েছে।
বাইক স্ট্যান্ট করতে গিয়ে কিছুদিন আগে মোহাম্মদপুরের এমএসবি গ্রুপের এক সদস্য মারা গেছেন। তার নাম শূন্য রাকিব। সে বাইক নিয়ে শূন্য উড়তে পারত বলে বন্ধুরা তাকে শূন্য রাকিব বলে ডাকতো। মৃত্যুর আগে ইউটিউবে আপলোড করা তার অনেক ভিডিও রয়েছে। সেখানে দেখা যায় বাইক নিয়ে নানা কসরত করছে। আর পাশে দাঁড়িয়ে উৎসুক জনতা তার এই কসরত দেখছেন। শূন্য রাকিবের বন্ধু আবরার বলেন, সে অনেক ভালো স্টান্ট করতে পারত। তার কাছ থেকে অনেকেই স্টান্ট করা শিখেছে। এই বাইক স্টান্ট করতে গিয়েই তার মৃত্যু হয়েছে। আবরার বলেন, আমাদের গ্রুপের সজল নামে আরেকজন বাইক রেসে গিয়ে আহত হয়েছেন। পায়ে রড থাকার কারণে এখন তিনি আর স্টান্ট করতে পারেন না।

মানিক মিয়া এভিনিউয়ে প্রায়ই বাইক রেসিং হয়। বিশেষ করে শুক্র-শনি অথবা কোন সরকারি ছুটির দিনে প্রশস্ত এই সড়কে বাইক রেসিংয়ে নেমে পড়ে। তাদের বেপরোয়া গতির রেসে আতঙ্কে থাকে ওই এলাকা দিয়ে চলাচলকারীরা। কারণ বেপরোয়া গতির এসব রেসিং শুধু তাদের জন্যই বিপজ্জনক নয়। সড়কে চলাচলকারী অন্য যানবাহন ও পথচারীদের জন্যও বিপজ্জনক। মানিক মিয়া এভিনিউ এলাকার ভাসমান পান-সিগারেট ব্যবসায়ী মোতাহের আলী বলেন, রাতের বেলা দেখা যায় হঠাৎ করে সাঁ সাঁ করে আসবে। এসেই মোটরসাইকেল নিয়ে নানা ভঙ্গি দেখানো শুরু করে। আমরা যারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি তাদের কাছেও এটা বিপজ্জনক মনে হয়। অনেক সময় পড়ে গিয়ে অনেকেই আঘাত পায়। ভেঙে যায় বাইকের বিভিন্ন অংশ।

বাংলাদেশের সড়ক রেসিং এর জন্য নিরাপদ নয় বলে মন্তব্য করেছেন রেসিং এর সঙ্গে জড়িতরা। তারা বলেছেন একদিকে যেমন সড়ক উপযোগী না, ঠিক তেমনি আমাদের দেশে স্পোর্টস রেসিং জন্য বাইক ও কার পাওয়া যায় না। স্পোর্টস কারগুলো সাধারণত অনেক দামি হয়। ২ হাজার সিসি’র ইঞ্জিন ও ৬০০ অশ্বশক্তির হয়। তাই আমাদের দেশে সাধারণ কারকে স্পোর্টস কারে পরিণত করা হয়। ইঞ্জিনের ও বডির কিছু যন্ত্রাংশ সংযোজন, বিয়োজন করা হয়। ইঞ্জিনের শব্দ আরো বাড়ানো হয় ও গাড়ির বডি নিচে নামানো হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমাদের দেশে বেপরোয়া গতিতে রেসিং করা সম্পূর্ণ অবৈধ। নিয়মনীতি না থাকার কারণে গভীর রাতে মরণ খেলায় মেতে উঠছে তরুণেরা। আর এ নেশা সবার জন্যই বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ট্রাফিকের যুগ্ম কমিশনার মফিজ উদ্দিন আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, সড়কে যে ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করবে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর গভীর রাতে যারা ভয়ঙ্কর রেসিং করে তাদের বিষয়ে তাদের অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে। কারণ এসব রেসিংয়ে বিপদ ঘটতে পারে যে কোনো সময়। আর রাতের বেলা সব সড়কে ট্রাফিকের কর্মকর্তারা থাকে না। তারা এই সুযোগটাই কাজে লাগায়।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status