প্রথম পাতা

রাশিয়ায় বাংলাদেশি তরুণদের আর্তনাদ

সামন হোসেন, মস্কো (রাশিয়া) থেকে ফিরে

২০ জুলাই ২০১৮, শুক্রবার, ১০:১৬ পূর্বাহ্ন

বিশ্বকাপ শেষে ধরপাকড় শুরু হয়েছে পুরো রাশিয়াজুড়ে। এতে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে বাংলাদেশিরা। বিশ্বকাপ  আসর শেষে পরের দু’দিনে রাশিয়ার বিভিন্ন সীমান্তে পাঁচশতাধিক বাংলাদেশি যুবক আটক হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। কারো কারো মতে সংখ্যাটা হাজারের উপরে। তল্লাশি শুরু হয়েছে রাশিয়াতে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের বাসায়-বাসায়। বিভিন্ন দালালের মাধ্যমে কালিনিনগ্রাদ, সেন্ট পিটার্সবার্গ, একতিয়ানবার্গ, সারাঙ্ক, সামারা, রোস্তভের বিভিন্ন সীমান্তে হাজার-হাজার বাংলাদেশি যারা সুযোগের অপেক্ষায় আছেন, যে কেনো মুহূর্তে তারা আটক হতে পারেন- এমন আশঙ্কা রয়েছে।

রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা সুবিধার না। দেশটির মুদ্রাস্ফীতির কারণে ডলারের দাম ৬৬ রুবলে গিয়ে ঠেকেছে। একবছর আগেও যার মূল্যমান ছিল ৩৫-৪০ রুবল। এখানে ভালো নেই প্রবাসী বাংলাদেশিরাও। চাকরি কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যে সুবিধা করতে না পেরে অনেকে দেশের পথ ধরেছেন। যারা আছেন, তারা টিকে আছেন অনেকটা লড়াই করেই। সেখানে বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে এক শ্রেণির দালালের মাধ্যমে রাশিয়ায় এসেছেন হাজার-হাজার বাংলাদেশি তরুণ। কাগজপত্রে তাদের সফরের উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বকাপ, আসল উদ্দেশ্য রাশিয়া হয়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশে পাড়ি জমানো। বিশ্বকাপ উপলক্ষে রুশ সরকারের উদারনীতির সুযোগে ৫ থেকে ৮ লাখ টাকার বিনিময়ে তাদের ইউক্রেন, বেলারুশ, ফিনল্যান্ড পাঠানোর কথা বলে তাদের রাশিয়ায় এনেছেন দালাল দত্ত বাবু, মোশাররফ হোসেন, আবুল বশর বাদল ও শহিদুল। রাশিয়ার ইমিগ্রেশনের তথ্যমতে প্রায় ৫ হাজার বাংলাদেশি টিকিট কেটে ফ্যান আইডি খুলে রাশিয়া এসেছেন।

২০১৫ সালে এই শহিদুলের হাত ধরেই মস্কো আসেন ফখরুল ইসলাম। তিনি জানান, ১১ লাখ টাকার বিনিময়ে মস্কো আসার পর তার পাসপোর্ট নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কাগজপত্র করে দেয়ার কথা বলে সঙ্গে আড়াই হাজার ডলারও নেয়া হয়। বিভিন্ন অজুহাতে সময়ক্ষেপণের পর অতিরিক্ত ১ হাজার ডলার নিয়েছেন শহিদুল। কিন্তু কাগজপত্র করে দিতে পারেননি, ফেরত দেননি পাসপোর্টও। বিশ্বকাপ উপলক্ষে অন্তত ৬০-৭০ ব্যক্তিকে এভাবে রাশিয়ায় এনেছেন তিনি।’ নোয়াখালীর মাইজদী এলাকার ২৮ বছর বয়সী যুবক ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘মোটা অংকের অর্থে লোকজন আনার পর কাগজপত্রের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে আরো অর্থ হাতিয়ে নেন শহিদুল। এটাই তার পেশা। মানুষকে বিপদে ফেলে হাতিয়ে নেয়া অর্থ দিয়ে এখানে ভোগ-বিলাস করেন তিনি।’ ফখরুল জানান, বিশ্বকাপ শেষে রুশ সরকার ১০ দিন সময় দেবে অবৈধ অভিবাসীদের দেশ ত্যাগের জন্য। তারপর শুরু হবে অভিযান। ওই অভিযানে অবৈধদের ধরে দেশে ফেরত পাঠানো হবে। ফখরুলের মতো উন্নত ভবিষ্যতের আশায় রাশিয়া গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন শহিদুলের স্ত্রীর ফুপাতো ভাই মুস্তাফিজুর রহমান সবুজ। ২০১২ সালে শহিদুলের হাত ধরেই রাশিয়া গিয়েছিলেন নোয়াখালীর এ যুবক। তার সেনজেন ভিসাও ছিল। ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর কথা বলে শ্যালকের কাছ থেকে ১ হাজার ডলার ও পাসপোর্ট নেন শহিদুল। বারবার যোগাযোগ করেও পাসপোর্ট ও অর্থ ফেরত পাননি। ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে আউট পাস নিয়ে দেশে ফিরতে বাধ্য হন সবুজ। সবুজ জানান, ‘আমি শহিদুল ভাইয়ের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করেছি, অনুরোধ করেছি কাজ করে দিতে না পারলে আমার পাসপোর্টটা যাতে ফেরত দেয়া হয়। কিন্তু তিনি আমার কাছ থেকে রীতিমতো পালিয়ে বেড়িয়েছেন।’ সবুজ বলেন, ‘তাকে না পেয়ে আমি বারবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি, এসএমএস দিয়েছি। যার স্ক্রিনশট আমার কাছে রয়েছে। কিন্তু তিনি কোনো ধরনের উত্তর দেননি। বাধ্য হয়েই আমি দেশে ফিরে এসেছি।’ উন্নত ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিয়ে হাজারো যুবককে রাশিয়া এনে বিপদে ফেলেছেন শহিদুল। তাদের অন্যতম মোশাররফ হোসেন ও আবুল বশর। উন্নত ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিয়ে দেশ থেকে মানুষ এনে বিপদে ফেলে অর্থ আদায়ের পাশাপাশি মস্কোর বিভিন্ন এলাকায় বসবাসকারী বাংলাদেশিদেরও নানাভাবে জটিলতায় ফেলছেন তারা। এ চক্রের হাতে প্রতারিত হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জের সুমন জানান, সাড়ে চার লাখ টাকা দিয়ে রাশিয়া এসেছি এখান থেকে ফিনল্যান্ড যাবো বলে। বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার আগেই আমাকে ফিনল্যান্ড পাঠানোর কথা। কিন্তু এখন দত্ত বাবু আমার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন না। মস্কোর একটি মেসে থাকা সুমনের সঙ্গে আছেন আরও ১৫/২০ জন এরা সবাই বাবুর হাত ধরে রাশিয়া এসেছেন। এমন অনেক মেস আছে মস্কোতে। যেখানে বিশ্বকাপ শেষে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন এসব যুবক। এদের মধ্যে সিলেটীদের সংখ্যা বেশি। প্রতিদিন মস্কো থেকে এরা কালিনিনগ্রাদ, সেন্ট পিটার্সবার্গ, ইয়েকাতরিনবার্গের বিভিন্ন সীমান্তে গিয়ে রুশ পুলিশের হাতে ধরা পড়ছেন। এতে রাশিয়ায় সববাসকারী বাঙালিদের উপর চাপ পড়ছে বলে জানান দীর্ঘদিন রাশিয়া বাস করা শাহিন আহম্মেদ। তৈরি পোশাক ব্যবসায়ী শরীয়তপুরের এই ব্যক্তি জানান, বিশ্বকাপ শেষে এরই মধ্যে রাশিয়ায় বিভিন্ন সীমান্তে প্রতিদিন বাংলাদেশিদের আটক করছে রুশ পুলিশ। তল্লাশি চালাচ্ছে এখানে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের বাড়িতে। মুষ্টিমেয় দু’-একজনের জন্য হাজার হাজার বাংলাদেশি বিপদে পড়েছেন বলে জানান তিনি। যার বিরুদ্ধে আদম পাচারের ভয়াবহ অভিযোগ সেই শহিদুলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এক সাংবাদিকের পরিচয় দিয়ে বলেন, ওনার কাছে জেনে  নেবেন আমি কে? আর আমার বিরুদ্ধে কিছু মানুষ কুৎসা রটাচ্ছে। পরে মস্কোতে থাকাকালীন শহিদুল এই প্রতিবেদকের সঙ্গে বার বার যোগাযোগ করে দেখা করার চেষ্টা করেন। সিলেটের দত্ত বাবু শুরুতে অস্বীকার করলেও পরে বলেন, ঝুঁকি আছে জানিয়েই আমি ওদের এখানে এনেছি। এর বেশি কিছু বলতে চাননি তিনি। বাকি দুই দালালের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে এদের মাধ্যমে যারা প্রতারিত হয়ে এখানে আছেন, কিংবা রুশ পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন, যারা সীমান্তে আছেন তাদের আর্তনাদে তাদের দুর্বিষহ জীবনের জানান দিচ্ছে। ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status