বিশ্বজমিন

সামরিক পরাশক্তি হয়েও সৌদি আরব কেন জিততে পারছে না ইয়েমেনে?

মানবজমিন ডেস্ক

১৯ জুলাই ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:২৯ পূর্বাহ্ন

গত সপ্তাহে প্রকাশিত হওয়া ইউএস নিউজ অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড রিপোর্টের বার্ষিক ‘পাওয়ার র‌্যাংকিং’য়ে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি ক্ষমতাধর দেশের তালিকায় স্থান পেয়েছে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। স্থান ছিল যথাক্রমে নবম ও দশম। এই র‌্যাংকিংয়ে স্থান পাওয়ার ক্ষেত্রে সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তিমত্তা ছিল প্রধান বিবেচ্য বিষয়। অথচ, এরপরও এই দুই দেশ চার বছর ধরে বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্রতম দেশের একটি ইয়েমেনে যুদ্ধে জড়িয়ে আছে। ইরান-সমর্থিত বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে দেশ দু’টির নেতৃত্বাধীন জোটবাহিনী না পারছে জিততে, না পারছে বেরিয়ে আসতে।
সৌদি ও আমিরাতের সামরিক বাহিনীর বাজেট বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ। স্টোকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউটের মতে, ২০১৭ সালে এমনকি রাশিয়ার চেয়েও সামরিক খাতে বেশি অর্থ  ব্যয় করেছে সৌদি আরব। বিশ্বে সামরিক খাতে তৃতীয় সর্বোচ্চ ব্যয় করে থাকে দেশটি। মোট ৬৯৪০ কোটি ডলার। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে সৌদি আরব ছিল বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ অস্ত্র আমদানিকারক। গত ছয় বছরে এই আমদানি বেড়েছে ২০০ শতাংশ।
তবে সৌদি সামরিক বাহিনীর সীমাবদ্ধতাও সবার জানা। বিরাট বাজেট ও অস্ত্র সরঞ্জাম ক্রয় সত্ত্বেও, সৌদি সামরিক বাহিনীর অভিজ্ঞতা কম। রিফুয়েলিং ও রিসাপ্লাইং-এর ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতা ও সীমিত মানবসম্পদও সৌদিদের দুর্বলতা।
তবে হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে জিততে না পারার ক্ষেত্রে সামরিক অভিজ্ঞতা কম থাকাকেই দায়ী করছেন অনেক বিশ্লেষক। তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজ ইন্সটিটিউটের জ্যেষ্ঠ পরিচালক ড. ইয়োয়েল গুজানস্কি বলেন, ‘সৌদি আরব ১৯৯১ সালের পর কোনো যুদ্ধে জড়ায় নি। অপরদিকে হুতি বিদ্রোহীদের রয়েছে কয়েক দশকের গেরিলা যুদ্ধের অভিজ্ঞতা। এছাড়া রয়েছে গিরিখাদে লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা, যেটি খুব কঠিন।’
ইরান সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ বন্দরনগরী হোদেইদাহ দখল করতে গিয়ে অচলাবস্থায় আটকে পড়েছে সৌদি-আমিরাত সামরিক জোট। মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে প্রক্সি যুদ্ধরত ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন ও সৌদি গোয়েন্দা সংস্থার অভিযোগ, দেশটি এই হুতিদের অস্ত্র ও রকেট দিয়ে সহায়তা করছে।
জোট বাহিনী দাবি করছে, তাদের উদ্দেশ্য হলো হুতি বাহিনীর প্রধান সাপ্লাই লাইন বন্ধ করা। এবং, পরিণতিতে এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে আলোচনার টেবিলে আনা। তবে সেই লক্ষ্য অর্জনে অগ্রগতি হয়েছে সামান্যই। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র আশঙ্কা করছে, নতুন করে অভিযান শুরু হওয়ায় ইয়েমেনে আরও ব্যাপক হারে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। কারণ, বন্দর ছিল ইয়েমেনে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার একমাত্র উপায়। বর্তমানে সেখানে ৮৪ লাখ মানুষ না খেয়ে দিনতিপাত করছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইয়েমেনে গুরুভার বইতে হচ্ছে মূলত আরব আমিরাতকে, সৌদি আরবকে নয়। সৌদি আরব মূলত বিমান সহায়তা দিচ্ছে। অপরদিকে স্থল সেনা নামিয়েছে আমিরাত, যদিও এদের অনেকেই সুদান থেকে যাওয়া মার্সেনারি।
সৌদি আরবের মতো আরব আমিরাতের সামরিক বাহিনীরও রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে সর্বাধুনিক অস্ত্রসস্ত্র। স্টোকহোম রিসার্চ ইন্সটিটিউট দাবি করে, বিশ্বের শীর্ষ ১৫ সামরিক খার্তে অর্থ ব্যয়কারী দেশের মধ্যে থাকা উচিৎ আমিরাতের। তবে দেশটির এই সংক্রান্ত তথ্যউপাত্ত পাওয়া মুশকিল। তবে সৌদি আরবের যেই অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে, তা আমিরাতের নেই। আফগানিস্তান, সোমালিয়া ও বসনিয়াতে বহু অভিযানে অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে দেশটির। বর্তমানে আরব আমিরাতের আংশিক প্রধান হলেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক জেনারেল মাইক হিন্ডমার্শ। যিনি বর্তমানে ইউএই প্রেসিডেন্সিয়াল গার্ডের কমান্ডার। এই বাহিনীও ইয়েমেনে সক্রিয়। ইউএই’র সামরিক দক্ষতার বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ড. গুজানস্কি বলেন, দেশটি হলো একমাত্র আরব দেশ যেটির নিজ সীমান্তের বাইরেও ঘাঁটি রয়েছে। ইরিত্রিয়ায় নৌ ও বিমান ঘাঁটি আছে ইউএইর। লোহিত সাগর ও লিবিয়ায়ও ঘাঁটি গাড়তে চায় দেশটি।
অবশ্য ইয়েমেন অভিযান নিয়ে সমস্যা কম পোহাতে হচ্ছে না আমিরাতের। গত সপ্তাহেই আমিরাতের এক প্রিন্স কাতারে আশ্রয় নিয়েছেন। ইয়েমেন যুদ্ধের সমালোচনা করে তার দাবি সেখানে নিহত সেনার সংখ্যা কম করে তুলে ধরছে সরকার। এরপর প্রাণের ভয়ে কাতারে আশ্রয় নেন তিনি। গত সপ্তাহে আমিরাতি পুরুষদের জন্য বাধ্যতামূলক সামরিক সেবা ১২ থেকে ১৬ মাস করেছে সরকার।
সৌদি সামরিক বাহিনীর বড় সমস্যা হলো এর অপারেশনাল কাঠামো বেশ কেন্দ্রীভূত। এই সমস্যা অনেক অগণতান্ত্রিক দেশকে পোহাতে হয়েছে। নিয়োগ, পদায়ন ও পদন্নোতির ক্ষেত্রে আনুগত্যই এখানে প্রধান মাপকাঠি। গত ফেব্রুয়ারিতে বাদশাহ সালমান যখন নিজ ছেলে মোহাম্মদ বিন সালমানকে ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে বেছে নিলেন, তখন তিনি তার সকল শীর্ষ সামরিক কমান্ডারকে বরখাস্ত করেন। ক্রাউন প্রিন্স আবার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়েরও প্রধান। এসব কারণে সৈন্যরা নৈতিক শক্তি পান না। আবার কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার দেশগুলোতে সৃজনশীলতা ও কার্যদক্ষতাও কম থাকে। সৌদি আরবকে এখনও প্রশিক্ষণ ও রিফুয়েলিং-এর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করতে হয়। এছাড়া যুদ্ধে নিজ সেনা হতাহত হওয়ার সংখ্যা বেশি হলে দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে বলেও আশঙ্কা থাকে সৌদি শাসকগোষ্ঠীর। ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান এ বিষয়ে বেশি সতর্ক। এ কারণেই হয়তো ইয়েমেন যুদ্ধে কতজন সৌদি সেনা ও নাগরিক হতাহত হয়েছেন, তার সরকারী হিসাব একবারও প্রকাশ করা হয়নি।
তাই ইয়েমেনে সৌদি আরবের ব্যর্থতার কারণ দু’টি: বিদেশী বাহিনী প্রতিরোধে হুতি বিদ্রোহীদের দীর্ঘদিনের দক্ষতা ও সৌদি সামরিক বাহিনীর কাঠামোগত দুর্বলতা।
(হারেৎস অবলম্বনে)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status